সব রাস্তা মিলছে গিয়ে দিল্লিতে
‘দেখি, কতদিন সরকার জনগণের দাবি অবহেলা করতে পারে!’
শাহজাহানপুরের অবরোধে কমরেড সত্যবান
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের অনড় মনোভাবের সামনে দাঁড়িয়ে দেশের কৃষকরা আন্দোলনকে আরও জোরদার, আরও বিস্তৃত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করলেন। কেন্দ্রীয় সরকার কোনও মতেই কৃষি আইন এবং বিদ্যুৎ আইন বাতিলের দাবি মানতে রাজি নয়। তাই কৃষকদের সাথে দফায় দফায় বৈঠকে কোনও ফল হয়নি। দাবি আদায়ের সুদৃঢ় সংকল্প নিয়ে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা। এবার আরও বেশি সংখ্যায় কৃষকদের সমাবেশ ঘটিয়ে দিল্লি ঢোকার অন্যান্য জাতীয় সড়কগুলিও বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন তাঁরা। সারা ভারত কিষান সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির (এআইকেএসসিসি) নেতারা জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাজ্য থেকে আরও অসংখ্য কৃষক সিংঘু, টিকরি, গাজিপুর, পালওয়ালে এসে জড়ো হচ্ছেন।
রাজস্থান থেকে আসা হাজার হাজার কৃষক ১৩ ডিসেম্বর দিল্লি ঢুকতে গেলে হরিয়ানা পুলিশ তাঁদের বর্ডারে আটকে দেয়। কৃষকরা শাহজাহানপুরে রাজস্থান-দিল্লি হাইওয়ে আটকে সেখানেই অবস্থান শুরু করে দেন। এর ফলে সিংঘু, টিকরি, গাজীপুরের পর দিল্লি ঢোকার আরও একটি জাতীয় সড়ক অবরুদ্ধ হল। এখানকার সমাবেশে দাঁড়িয়ে এআইকেকেএমএস-এর সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড সত্যবান বলেন, যতদিন যাবে তত বেশি সংখ্যায় কৃষকরা দিল্লিতে এসে জড়ো হবেন। সরকারের কোনও লাঠি-গুলি, জলকামান তাদের হঠাতে পারবে না। তিনি বলেন, আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। কত দিন সরকার কৃষকদের দাবি অবহেলা করতে পারে সেটাই কৃষকরা দেখতে চায়। অবরোধে উপস্থিত সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কমরেড শঙ্কর ঘোষ বলেন, আন্দোলনে বিভেদ তৈরির কোনও চেষ্টা সফল হবে না। প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যে অপেক্ষা করতে করতে কখন কৃষকরা ফিরে যান– সরকার সেই অপেক্ষায় আছে। কিন্তু সরকারের সে আশা পূরণ হবে না। জন আন্দোলনের পরিচিত নেত্রী মেধা পাটকর বলেন, গোটা কৃষিব্যবস্থাটিকে কয়েক জন একচেটিয়া পুঁজিপতির হাতে তুলে দিতেই নয়া কৃষি আইন এনেছে সরকার। বক্তব্য রাখেন যোগেন্দ্র যাদব প্রমুখ নেতারাও।
প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের সাথে কথা বলার সময় পাচ্ছেন না। বণিকসভার মঞ্চ দাঁড়িয়ে গুণগান করে আসছেন কৃষি আইনের। কৃষি এবং বিদ্যুৎ আইনের ফলে কত বিনিয়োগ আসবে তার লম্বা ফিরিস্তি দিচ্ছেন। বণিকরা হাততালি দিচ্ছেন। এই অবস্থায় দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন আরও জোরদার করা ছাড়া কৃষকদের সামনে অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই। সেই রাস্তাই নিয়েছেন কৃষকরা। যত দিন যাচ্ছে ততই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশ জুড়ে। পাঞ্জাব-হরিয়ানা-উত্তরপ্রদেশ থেকে নতুন করে কৃষকরা কয়েক হাজার ট্রাক্টরে চেপে অবস্থানে আসছেন, তেমনই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ূ প্রভৃতি রাজ্যগুলি থেকেও হাজার হাজার কৃষক আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন। ১২ ডিসেম্বর সারা দেশে কয়েক হাজার টোলপ্লাজায় অবরোধ করেন কৃষকরা। রিলায়্যান্স গোষ্ঠীর বিভিন্ন সুপার মার্কেটের সামনে কৃষক বিক্ষোভ হয়। ১৪ ডিসেম্বর সারা দিন অনশনের কর্মসূচি করেছেন আন্দোলনের নেতারা। এআইকেকেএমএস-এর সর্বভারতীয় কমিটির পক্ষ থেকে সারা দেশে এই মুহূর্তে ৩০০টির বেশি জায়গায় লাগাতার কৃষকদের ধরনা মঞ্চ চলছে। আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবাংলা, ঝাড়খণ্ড, বিহার ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কেরালায় ধরনা মঞ্চে মানুষের অংশগ্রহণ খুবই উল্লেখযোগ্য। সংগঠনের পক্ষ থেকে আরও বেশি সংখ্যায় কৃষক এবং সাধারণ মানুষকে ধরনাগুলিতে যুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। গড়ে তোলা হচ্ছে আন্দোলনের কমিটি।
সিংঘু, টিকরি, পালওয়াল, গাজিপুর প্রভৃতি সব ধরনার জায়গাতেই লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রবল ঠাণ্ডার মধ্যে খোলা আকাশের নিচে ২৬ নভেম্বর থেকে অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন পরিবারের মহিলা, শিশু, বৃদ্ধরা পর্যন্ত। ট্রাক্টরে ত্রিপল টাঙিয়ে, কোথাও ট্রাক্টর কিংবা লরির তলায় মাটিতেই ঘুমোচ্ছেন তাঁরা। লক্ষ লক্ষ কৃষক পারস্পরিক সহযোগিতার এক অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছেন এই আন্দোলনে। আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হবে বুঝেই কৃষকরা সঙ্গে করে এনেছেন বেশ কয়েক মাসের খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। এই সব কিছুই তাঁরা তুলে দিচ্ছেন পাশে থাকা আন্দোলনের সাথীদের হাতে। আশপাশের এলাকাগুলি থেকেও সাধারণ মানুষ কৃষকদের জন্য রান্নাকরা খাবার এবং অন্যান্য জিনিসপত্র প্রতিদিন ম্যাটাডোরে, গাড়িতে করে এনে দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষ নিজেদের উদ্যোগে খাবার, শীতবস্ত্র প্রভৃতি বিলি করছেন। মেডিকেল সার্ভিস সেন্টারের চিকিৎসকরা আন্দোলনকারীদের চিকিৎসার জন্য শিবির খুলেছেন। প্রয়োজনীয় ওষুধ, অন্যান্য সরঞ্জাম সবই সাধারণ মানুষ জোগাচ্ছেন। সারা দেশই আজ মানসিক ভাবে কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিক-ছাত্র-যুব-মহিলা সংগঠনগুলি আন্দোলনের প্রতি তাঁদের পূর্ণ সংহতি জানিয়েছেন। ফলে দিন যত যাচ্ছে ততই যেন কৃষকরা দাবি আদায়ে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠছেন। কৃষক আন্দোলন ধীরে ধীরে গণআন্দোলনের রূপ নিচ্ছে।
এই অভূতপূর্ব ঐক্য এবং অনমনীয় মনোভাব দেখে ভয় পেয়েছে সরকার। আম্বানি-আদানিদের মতো একচেটিয়া পুঁজির কাছে দাসখত লিখে দেওয়া বিজেপি সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা আন্দোলন ভাঙতে কুৎসা রটাতে শুরু করেছেন। কখনও বলছেন এই কৃষকরা আসলে খলিস্তানি, কখনও বলছেন পাকিস্তানি, কখনও বলছেন, আন্দোলনের দখল নিয়েছে অতিবামরা। এ থেকেই স্পষ্ট শাসক বিজেপি কৃষি আইনের পক্ষে দেশের মানুষের সামনে কোনও যুক্তিই রাখতে পারছে না– যা বিশ্বাসযোগ্য। সরকারের এই বিভ্রান্তিকর প্রচারে অবশ্য কৃষকদের কিছু যায়-আসে না।
তাঁরা এটা স্পষ্ট বুঝেছেন, পিছু হঠার কোনও জায়গা নেই। এই আইন চালু হলে তাঁরা ধ্বংস হয়ে যাবেন। ফলে আন্দোলনের ময়দান জুড়ে এখন একটাই স্লোগান– হয় জয়, না হয় মৃত্যু। বাস্তবিকই কৃষকদের কাছে যেমন, তেমনই দেশের সাধারণ নাগরিকদের কাছেও এটা অস্তিত্বের সংগ্রাম। লড়াইটা তাই চলবেই।