দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, স্পষ্ট বুঝছেন চা শ্রমিকরা

বড়দিঘি বাগানে চা-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলছেন গণদাবীর প্রতিনিধিরা

সকালবেলা চায়ের কাপ হাতে অধিকাংশ মানুষেরই দিন শুরু হয়। এই চা তৈরি হয় উত্তরবঙ্গের পাহাড় ও সমতল এলাকায়। পাহাড়ের কোলে ঘন সবুজ চা-বাগিচায় ঘেরা ডুয়ার্সের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটকদের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকে। কিন্তু যে মানুষগুলি ওই বাগানে শ্রমিক হিসাবে কাজ করেন, তাদের জীবন কাটে নিতান্তই অন্ধকারে। তাদের বাঁচার মতো মজুরি নেই, ন্যূনতম পুষ্টিকর খাবার নেই, চিকিৎসা-শিক্ষার যথাযথ সুযোগ নেই। লুটেরা বাগান-মালিক আর পেটোয়া সরকারের যোগসাজশে, ক্ষমতালোভী ট্রেড ইউনিয়নগুলির কিছু নেতার বিশ্বাসঘাতকতায় সহজ-সরল লক্ষ লক্ষ চা-শ্রমিক চরম শোষণ-বঞ্চনার জীবন কাটাচ্ছেন।

অমানুষিক বঞ্চনার জীবন

জলপাইগুড়ি জেলার কয়েকটি চা-বাগান ঘুরে সেই ছবিই চোখে পড়ল। তিলাবাড়ি ডিভিশনের বড়দিঘি চা বাগানে কাজ করছিলেন সীমা টুডু, রোজলে খারিয়ারা। শীর্ণ শরীরে অপুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। বললেন, সকাল ৭টায় কাজ শুরু হয়। দিনে অন্তত ২৫ কেজি চা-পাতা তুলে মালিকের ঘরে জমা দিতে হয়–তবেই মেলে ২০২ টাকা। এর বেশি পাতা তুলতে পারলে কেজি পিছু ৩ টাকা করে মেলে। প্রশ্ন করলাম, ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই টাকায় সংসার চলে? করুণ চোখে অসহায় হাসি মুখে পাল্টা প্রশ্ন তাঁদের–তাই কখনও চলে?

–তাহলে?

–ওই সরকারি রেশনের চালটুকু পেলে, কচুপাতা আর ঢেঁকিশাক তুলে কোনও রকমে চালাই।

রেণু ছেত্রীর তিন ছেলেমেয়ে। স্বামী টিবিতে ভুগছেন। অসুখ-বিসুখ হলে কোথায় চিকিৎসা করান? বললেন, বাগানের একটা ডিস্পেনসারি আছে, কিন্তু সেখানে ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্র পর্যন্ত নেই। তা হলে কী করেন? – ওই একজন কম্পাউন্ডারবাবু আছেন। তিনিই দেখেন। প্রশ্ন করলাম, বাগান মালিক থাকার কোয়ার্টার দেয়? রক্তাল্পতার ছাপ মাখা মুখে করুণ হেসে রেণু জানালেন, ঘরের টিনের চাল ফাটা, দরজা ভাঙা আজ দু’বছর। মালিক সারিয়ে দেয় না। বললেন, আগে বাগান থেকে লকড়ি দিত, জ্বালানি দিত, এখন সেসবও বন্ধ। তাঁদের কথায়, আমরা ছোটা আদমি, আমাদের কথা শুনবে কে?

যাওয়া হয়েছিল নেপুচাপুর বাগানে। শ্রমিক রজনী ওরাওঁ বললেন, ‘বছরে তিন মাস কোনও কাজ থাকে না। আয়ও বন্ধ। গত ছ’বছর ধরে কাজ করছি। স্বামী ও আমার মজুরি মিলে পাই ৪০৪ টাকা। তা দিয়ে সন্তানদের নিয়ে শুধু খাবারের সংস্থানটুকুও হয় না। অন্য প্রয়োজন মেটানো তো দূর অস্ত। চা-শ্রমিকদের ইউনিয়ন আছে কি না জিজ্ঞাসা করায় বললেন, মাঝে মাঝে মিটিং হয়। কিন্তু ইউনিয়ন নেতারা আমাদের হয়ে মালিককে আদৌ কিছু বলে কি না বুঝতে পারি না।

মুনাফালুটের নেশায় বাগানগুলিকে ছিবড়ে করে দিচ্ছে মালিক

উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসকরা ডুয়ার্স অঞ্চলে চা চাষ শুরু করে। কাজ করানোর জন্য ছোটনাগপুর, দণ্ডকারণ্য, মালকানগিরি থেকে তারা নিয়ে এসেছিল সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওরাওঁ মানুষদের। এখনও চা বাগানগুলিতে কাজ করে চলেছেন তাঁদের বংশধররা। স্বাধীনতার পর ভারতীয় পুঁজিপতিরা মুনাফার লোভে হাত বাড়ায় চা বাগানের দিকে। ইতিমধ্যে সেখানে শ্রমিকের কাজে যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ থেকে আসা বহু উদ্বাস্তু মানুষ। এসেছেন নেপালিরা। সেই সময় আন্দোলনের চাপে বেশ কিছু অধিকার সরকারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন শ্রমিকরা। ১৯৫১ সালে তৈরি হয়েছে প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট, ১৯৫৬ সালে ওয়েস্ট বেঙ্গল প্ল্যান্টেশন লেবার রুলস। এইসব আইন শ্রমিকদের জন্য নিয়ে এসেছিল বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা। বৃদ্ধি ঘটিয়েছিল প্রাপ্যের। বাগান শ্রমিকদের পানীয় জল, চিকিৎসা, শৌচাগার সহ থাকার জায়গা, সন্তানদের পড়াশোনার জন্য স্কুলের ব্যবস্থা করা মালিকদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল।

ধীরে ধীরে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। আজ এই অঞ্চলের বহু চা বাগান বন্ধ। যেগুলি চলছে সেগুলিও রুগ্ন, দুর্দশাগ্রস্ত। শ্রমিকদের আইনি পাওনাগুলি ঠিকমতো দেওয়া দূরের কথা, মুনাফা লুটের নেশায় বাগান রক্ষণাবেক্ষণের খরচটুকু করতেও রাজি নয় মালিকরা। বহু জায়গায় বাগানের ম্যানেজার শ্রমিকদের বোঝায়–মালিকের তেমন লাভ হচ্ছে না, লাভ না হলে বাগান বন্ধ হয়ে যাবে। এই বলে কম মজুরি নিতে বাধ্য করে। পেটোয়া ইউনিয়ন মালিকের পাশে দাঁড়ায়। কোনও শ্রমিক প্রতিবাদ করলে তাঁকে তৎক্ষণাৎ ছাঁটাইয়ের নোটিস ধরিয়ে দেওয়া হয়। চা-বাগানে বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যা নগণ্য, নিয়োগ প্রায় হয় না। কারণ তাদের আইনি প্রাপ্য দিতে নারাজ মালিকরা। তাই নিয়োগ হয় চুক্তির ভিত্তিতে। চুক্তি-শ্রমিকের প্রতি মালিকের বহু দায়ভার আইনের খাতাতেই নেই। যেটুকু রয়েছে তাও দেয় না মালিক। ফলে চুক্তি-শ্রমিক মায়েদের সন্তান দেখার ব্যবস্থা নেই, নেই রেশন, নেই অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা। আগে বাগানে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্দিষ্ট ছিল। এখন শ্রমিকদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয়।

ন্যূনতম মজুরি পায় না চা শ্রমিক

বহু বছর আগে, ১৯৫৭ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রত্যেক শ্রমিকের দৈনন্দিন ২৭০০ ক্যালোরি শক্তিযুক্ত খাদ্যের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে সেইমতো ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টও ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ সংক্রান্ত নানা নির্দেশ দিয়েছে। দেশে একের পর এক সরকারের বদল হয়েছে। কিন্তু চা শ্রমিকদের হাল ফেরেনি। বারবার আন্দোলনে নেমেছেন শ্রমিকরা। জেলার লেবার কমিশনার, উত্তরবঙ্গের প্রশাসনিক ভবন উত্তরকন্যা, পূর্বতন ও বর্তমান শ্রমমন্ত্রীর কাছে শ্রমিকরা বারবার দরবার করেছেন, কিন্তু সরকার তাঁদের দাবি মানেনি। উত্তরবঙ্গ জুড়ে শ্রমিকরা বহুবার বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছেন। পুলিশের লাঠির ঘা মিলেছে, মজুরি বাড়েনি। পূর্বতন সিপিএম-ফ্রন্ট সরকারের আমলে যেমন, বর্তমান তৃণমূল সরকারের আমলেও তেমন, বারবার মালিক-সরকার-শ্রমিক ইউনিয়নের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু মালিকরা কোনও মতেই মজুরি বাড়াতে রাজি হয়নি। কোনও সরকারই মালিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে মজুরি বাড়াতে বাধ্য করেনি। বাধ্য করেনি জল-বিদ্যুৎ-কোয়ার্টার-চিকিৎসার মতো প্রাপ্য পরিষেবাগুলি শ্রমিকদের দিতে। তার বদলে, ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের শেষে, কখনও ১৭ টাকা, কখনও ৩ টাকা মজুরি বাড়িয়ে শ্রমিক দরদের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। সম্প্রতি শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠকে তৃণমূল সরকারের শ্রমমন্ত্রী লজ্জার বালাই না রেখে মালিকের কথা ভেবে শ্রমিকদের কম মজুরি মেনে নিতে বলেছেন। বাগান-মালিকরাও এই ধরনের নেতা, ইউনিয়নগুলিকেই খোঁজে। বাড়তি সুবিধা দিয়ে তাদের হাতে রাখে। তারা শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার করে–আন্দোলন করে কিছু হবে না, মালিক না থাকলে আমরা খাটব কোথায়, খাব কী! ফলে যা দিচ্ছে মেনে নাও। বহু জায়গায় তিন দিনের মজুরি দিয়ে ছ’দিনের কাজ করিয়ে নেওয়া হয় সরল, উদার-হৃদয় এই মানুষগুলিকে দিয়ে। অশিক্ষিত, অসচেতন শ্রমিক ভাবে–এ সব কপালের লিখন। বংশপরম্পরায় চা বাগানই যাদের ঘরবাড়ি, সেই শ্রমিকরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে মালিকি শোষণের পেষাই কলে নিজেদের নিংড়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে চা বাগানের শ্রমিকরা আজও অকল্পনীয় কম মজুরিতে অমানুষের জীবন যাপন করে চলেছেন। তাঁদের মজুরি এমনকি বিড়ি শ্রমিক বা কৃষি শ্রমিকদের দৈনিক মজুরির চেয়েও কম।

তিলে তিলে মরছে বন্ধ চা বাগানের শ্রমিক

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বন্ধ চা বাগানের যন্ত্রণা। ১৯৯০-এর দশক থেকে ডুয়ার্স অঞ্চলে একের পর এক কারখানা বন্ধ হতে শুরু করে। শ্রমিকদের প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটির টাকা ও বেতন বাকি রেখে, আগে নেওয়া বিপুল ঋণ শোধ না করে আচমকা কারখানা বন্ধ করে দিয়ে রাতারাতি মালিক নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কাজ হারিয়ে অনাহারে, অখাদ্য খেয়ে মারণ আন্ত্রিকে ভুগে মরতে থাকেন চা শ্রমিকরা। যাঁরা কোনও রকমে টিকে গেলেন, মালিকি জুলুম আর সরকারি অবহেলায় তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ থাকে না তাঁদের। সুযোগ পেয়ে মাথাচাড়া দেয় নারী ও শিশু পাচারের ব্যবসা। দলে দলে তরুণ কাজের খোঁজে ভিন রাজ্যে, ভিন দেশে পাড়ি দেয়। শুরু করে পরিযায়ী শ্রমিকের যন্ত্রণাময় জীবন।

এমনই এক বন্ধ চা-বাগান–জলপাইগুড়ির রায়পুর চা বাগানে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ১৮-১৯ বছর বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে একসময়ের বিখ্যাত এই বাগান। আপাতত একটি কমিটি তৈরি হয়েছে যারা বাগানের ছোট একটি অংশে পাতা তোলার কাজ চালাচ্ছে। পাতা বিক্রি করে যা পাওয়া যাচ্ছে, শ্রমিক ও কর্মচারীদের মধ্যে তা ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। বন্ধ বাগানে গিয়ে অজস্র শীর্ণ, রুগ্ন, দুশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত মহিলা শ্রমিকের দেখা মিলল। সারি দিয়ে বসে আছেন তুলে আনা পাতা ওজন করাবেন বলে। পাতা তুলে কোনও দিন ৫০ টাকা, কোনও দিন ৬০ টাকা মজুরি মিলছে। ভুতুড়ে বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে ভগ্নপ্রায় কারখানা-বাড়ি। তার গা বেয়ে এলাকার খেটে-খাওয়া মানুষের অবর্ণনীয় যন্ত্রণার বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুলের মতো খাড়া হয়ে রয়েছে চিমনির নল। আজ আর সেখান দিয়ে চায়ের গন্ধ মাখা ধোঁয়া বের হয় না। শ্রমিকদের থাকার জায়গায় গিয়ে দেখা গেল জঙ্গল থেকে শাকপাতা এনে ফুটিয়ে খাবারের জোগাড় করছেন মহিলারা। জল-বিদ্যুতের লাইন বহুদিন কাটা। শ্রমিকদের বসবাসের কোয়ার্টার কার্যত ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ঝোপ-জঙ্গল-আগাছায় ছেয়ে গিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্র ভুতুড়ে বাড়ির রূপ নিয়েছে। স্কুলের কথা না বলাই ভাল, টিনের শেড চুঁইয়ে বর্ষায় জল পড়ে। মিড-ডে মিলের দু-মুঠো খাবারের জন্য শ্রমিক পরিবারের অপুষ্ট, শীর্ণকায় শিশুরা উন্মুখ হয়ে থাকে। চা-শ্রমিক অনন্ত চিকবড়াইক রিকেটগ্রস্ত সন্তান কোলে দুর্দশার কথা জানালেন। বললেন চালের টিন ভাঙা। ঝড়বৃষ্টিতে ত্রিপল মাথায় দিয়ে কোনওরকমে দিন কাটাতে হয়। নিকাশির জঘন্য দশা। ফলে মশা-মাছির ব্যাপক উপদ্রব। একদিন অন্তর স্ত্রী বাগানে কাজ করে পান মাত্র ৪০-৫০ টাকা। অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক লক্ষ্মী মুণ্ডার পরিবারে সাত সাতটি পেট, দিন চলে না। হাড় ক’খানা সম্বল। বললেন, বাগানের স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ। অসুখ হলে দেখানোর জায়গা একমাত্র সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সেখানেও ওষুধ মেলে না।

শ্রমিকের প্রতি নির্মম, মালিকের প্রতি সদয় সরকার

চা ব্যবসায় মন্দার কথা বিশেষ শোনা যায় না। তবু কেন বন্ধ হচ্ছে চা বাগান? কথা হল রায়পুর বাগানের একসময়কার শ্রমিক মালু ওরাওঁয়ের সঙ্গে। বাগান বন্ধ হওয়ার আগে উনি ছিলেন এআইইউটিইউসি অনুমোদিত চা শ্রমিকদের সংগ্রামী সংগঠন নর্থ বেঙ্গল টি প্ল্যান্টেশন এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের রায়পুর বাগান ইউনিটের সম্পাদক। তাঁর কথায় উঠে এল মালিকের মুনাফা-লালসার পাশাপাশি সরকার-মালিক যোগসাজশের বীভৎস চিত্র। জানা গেল, চা বাগানের জমির মালিকানা বাগান-মালিকের নয়। এ জমি সরকারের কাছ থেকে তারা লিজ নেয়। চা পাতার দাম নির্ধারিত হয় যে নিলাম-বাজারে সেখানে ব্রোকারদের সাথে যোগসাজশ থাকে মালিকদের। মালিকের নিজের লোকই ঘুরপথে কম দামে পাতা কিনে নেয়। এরপর নিলামে চা-পাতার দাম উঠছে না বলে সরকারের কাছে লোকসানের কাঁদুনি গাওয়া শুরু করে। এভাবে শ্রমিকের মজুরি বাড়ানোর দাবি খারিজ করে দেয় মালিকরা। কারখানা বাঁচাতে সরকারি অনুদান চায়। এদিকে দ্রুত মুনাফা লুটের লোভে বাগানের রক্ষণাবেক্ষণে মাথা ঘামায় না মালিক। পাশাপাশি বাগান উন্নয়নের নামে ব্যাঙ্ক থেকে মাঝে মাঝেই তারা বিপুল টাকা ঋণ নেয় এবং সেই টাকা অন্য আরও লাভজনক কোনও ব্যবসায় খাটায়। এইভাবে চলতে চলতে যখন ব্যাঙ্কঋণের পরিমাণ, শ্রমিকদের বেতন, পিএফের টাকা ইত্যাদির বকেয়ার পরিমাণ আকাশ ছুঁয়ে ফেলে, ঠিক তখনই নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে আচমকা বাগান বন্ধ করে মালিক উধাও হয়ে যায়। এদিকে বকেয়া টাকার বোঝা সহ ওই বাগান অন্য ব্যবসায়ীরা কিনতে রাজি হয় না। ফলে দিনের পর দিন বন্ধ হয়ে পড়ে থাকে একসময়ের রমরমা চা বাগান। আচমকা কাজ হারিয়ে বাগানের ওপর সমস্ত দিক দিয়ে নির্ভরশীল দিশাহারা বাগান-শ্রমিক নিদারুণ দুরবস্থায় পড়ে।

এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত বাগান অধিগ্রহণ করে নতুন করে তা চালু করা। শ্রমিকদের দুর্দশাগ্রস্ত পরিবারগুলির প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি থাকলে, রাজ্যের সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা থাকলে ঠিক এই কাজটাই সরকার করত। কিন্তু আজ পর্যন্ত সরকারকে এই ভূমিকায় দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, আইন অনুযায়ী বাগান বন্ধ করলেও শ্রমিকদের পানীয় জল ও হাসপাতাল পরিষেবা চালু রাখার কথা মালিকের। মালিকরা তা করে না। অথচ সরকার আজ পর্যন্ত আইনভঙ্গের জন্য একজন মালিকেরও শাস্তির ব্যবস্থা করেনি। এইভাবে সরকার-মালিকের যোগসাজশে না খেতে পেয়ে, বিষাক্ত খাবার ও জল খেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মারা যায় শত শত অসহায় শ্রমিক ও তাদের পরিজন।

শ্রমিকদের প্রতি নির্মমতার এখানেই শেষ নয়। আইন অনুযায়ী আগে শ্রমিকদের রেশন দিতে বাধ্য থাকত মালিক। তৃণমূল সরকারের মালিকপ্রেম এমনই যে, ক্ষমতায় এসে তা বন্ধ করে দিয়ে বলেছে, মালিকের বদলে তারাই রেশনের ব্যবস্থা করবে। এদিকে শ্রমিক মহল্লায় ঘুরে দেখা গেল, অনেকেরই রেশন কার্ড নেই। ফলে বরাদ্দ সামান্য খাবারটুকুও বহু শ্রমিক পাচ্ছেন না। বহু শ্রমিকের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নেই। ১০০ দিনের প্রকল্পের মতো সরকারি কাজ প্রায় বন্ধ, যতটুকু হয় তার টাকাও শ্রমিকদের হাতে পৌঁছয় না। চা-বাগান একটানা তিন মাস বন্ধ থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে চা-শ্রমিকদের মাসে হাজার টাকা ‘ফাউলাই’ অনুদান দেওয়ার কথা। বন্ধ রায়পুর চা-বাগানে গিয়ে দেখা গেল, বেশিরভাগ শ্রমিকই ফাউলাই কী তা-ই জানে না। কেউ দু-একবার পাওয়ার পর আর পাননি। ‘চা সুন্দরী’ প্রকল্পের মাধ্যমে চা শ্রমিকদের পাকা বাড়ির বিজ্ঞাপন জাতীয় সড়ক কিংবা নানা স্থানে রাস্তার দু’ধারে চোখে পড়ে। কিন্তু এই প্রকল্পের সুযোগ-সুবিধা দূরের কথা, অনেক শ্রমিক জানেনই না এই প্রকল্পের কথা।

ছোট বাগানের শ্রমিকদের অবস্থাও তথৈবচ

বাগানের বাইরে রয়েছেন অসংখ্য শ্রমিক যাঁরা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন চা-চাষের জমিতে দিনমজুরি করে পেট চালান। এঁদের অবস্থাও তথৈবচ। কাজ হলে দিনে মেলে ১৯৩ টাকা। ফলে অনেককেই অন্য নানা ঠিকা কাজ করে সংসার চালাতে হয়।

অসচেতন করে রাখা হয়েছে চা শ্রমিকদের

মালিকি শোষণ ও সরকারি বঞ্চনার বিরুদ্ধে চা শ্রমিকদের দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু চা বাগান ঘুরে দেখা গেল, নিজেদের দাবি-দাওয়া-অধিকার, এমনকি নিজেদের সংগঠনের বিষয়েও শ্রমিকরা অত্যন্ত অসচেতন। চা শ্রমিক আন্দোলনের এক সংগঠক জানালেন, ভোটসর্বস্ব দলগুলির শ্রমিক সংগঠন অনেক সময়ই শ্রমিকদের অন্ধকারে রেখে দেয়। বহু ক্ষেত্রেই তাদের নেতারা মুখে শ্রমিকস্বার্থের স্লোগান দিতে দিতে কার্যত মালিকেরই মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থে কাজ করে চলে। শ্রমিকদের দরকার পড়ে শুধু মিছিল সাজাবার জন্য। এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের সচেতন করে তোলার কাজ করে চলেছে এআইইউটিইউসি অনুমোদিত সংগ্রামী শ্রমিক সংগঠন এনবিটিপিইইউ। অবসর নেওয়ার পর দুঃস্থ, বয়স্ক শ্রমিকদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু যাতে মালিক কেড়ে নিতে না পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাঁদের পাট্টা দেওয়ার দাবিও জোরের সঙ্গে তুলে ধরছে এই সংগঠন।

লড়াই-ই চা শ্রমিকদের বাঁচার একমাত্র পথ

চা শ্রমিকদের গোটা ইতিহাসটাই নির্মম বঞ্চনার ইতিহাস। সেই ব্রিটিশ আমলে বাগান-মালিক আড়কাঠি লাগিয়ে আদিবাসী মানুষদের বাগানে নিয়ে এসে কাজে লাগাত। সামান্য গাফিলতি হলেই তাদের জুটত সাহেবের চাবুক। মালিক, পেটোয়া ম্যানেজার ও বাবু শ্রেণির কর্মচারীদের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠত শ্রমিকরা। অবাধে চলত মহিলা শ্রমিকদের ইজ্জত লুট। বাগানে কাজ করতে এসে দুর্বিষহ জীবনযন্ত্রণার শিকার হতে হত আদিবাসী মানুষগুলিকে। সেই দুঃসহ যন্ত্রণার গুমরে ওঠা কান্না কান পাতলে আজও শোনা যায় তাদের নিজস্ব ভাষায় গানের সুরে সুরে।

স্বাধীনতার পর বাগানের মালিকানা পাল্টে তা এসেছে দেশীয় পুঁজিমালিকদের কাছে। কিন্তু পাল্টায়নি নির্মম শ্রমিক শোষণ, অবিশ্রান্ত লাঞ্ছনা-বঞ্চনার বাস্তবতা। শ্রমিকের হাড়ভাঙা শ্রম লুট করে মুনাফার পাহাড় বানিয়ে, তাদের সমস্ত আইনি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে, তাদের ন্যায্য পাওনা পিএফের টাকা অবাধে আত্মসাৎ করে আজও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় মালিক। নির্যাতিত শ্রমিকের আর্তনাদ চাপা পড়ে থাকে মালিকের দামি বুটের তলায়। কেন্দ্রে ও রাজ্যে একের পর এক সরকার বদল হয়েছে। কিন্তু না কংগ্রেস, না সিপিএম, না তৃণমূল সরকার– কেউই মালিকের এই চরম অন্যায় কোনওদিন চোখে দেখতে পায়নি, এখনও পায় না। এর বিরুদ্ধে বারবার বিক্ষোভ আন্দোলনে ফেটে পড়েছেন চা শ্রমিকরা। পুলিশ আর মালিকের পোষা দুষ্কৃতীদের মার খেয়ে তাঁরা রক্ত ঝরিয়েছেন বারবার। আজও জারি রয়েছে তাঁদের লড়াই।

দীর্ঘদিন ধরেই উত্তরবঙ্গে চা শ্রমিকদের নিয়ে যুক্ত আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে এনবিটিপিইইউ সহ বেশ কয়েকটি ট্রেড ইউনিয়নের ঐক্যবদ্ধ জয়েন্ট ফোরাম। নানা সময়ে প্রশাসনিক দপ্তরে বিক্ষোভ, মালিকপক্ষের সঙ্গে বা ত্রিপাক্ষিক বৈঠক ইত্যাদির মধ্য দিয়ে চা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সংক্রান্ত ১৮ দফা দাবি জানিয়ে আসছে তারা। বারবারই মালিক-সরকারের গা ঘেঁষাঘেঁষিতে দাবি আদায়ে ব্যর্থ হতে হয়েছে। কিন্তু লড়াইয়ের রাস্তা থেকে পিছু না হঠার শপথ নিয়েছেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া শ্রমিকরা। মার খেতে খেতে মরিয়া শ্রমিক আজ স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছেন, লড়াই-আন্দোলন ছাড়া বাঁচার পথ নেই। আপসহীন সেই লড়াইয়ের পথে উত্তরবঙ্গের চরম দুর্দশাগ্রস্ত শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি করে চলেছে সংগ্রামী শ্রমিক সংগঠন এনবিটিপিইইউ। যুক্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ন্যূনতম মজুরি সহ ১৮ দফা দাবি আদায়ে তারা অনড়।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ১০ জুন ২০২২