দৃঢ়পণ আন্দোলনে জয় ছিনিয়ে আনলেন জুনিয়র ডাক্তাররা

মুখ্যমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর স্বাস্থ্যভবনের সামনে আন্দোলনস্থলে বক্তব্য রাখছেন জুনিয়র ডাক্তার নেতৃবৃন্দ

সঠিক রাস্তায় লাগাতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চাপই যে দাবি আদায় করতে পারে, তা আবারও প্রমাণিত হল। ১৬ সেপ্টেম্বর জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে বৈঠকে অনেকগুলি দাবিই মেনে নিতে বাধ্য হলেন মুখ্যমন্ত্রী। কলকাতা পুলিশ কমিশনার, স্বাস্থ্য অধিকর্তা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা ও ডিসি নর্থকে সরানোর দাবি তাঁকে মানতে হল। হাসপাতালের নিরাপত্তা-ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর দাবিও মেনে নেন তিনি। মুখ্যসচিবের অধীনে এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠনের কথা তিনি ঘোষণা করেন। বৈঠক শেষে স্বাস্থ্যভবনের সামনে ধরনাস্থলে ফিরে আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের পক্ষে ডাঃ অনিকেত মাহাতো বলেন, আন্দোলনের এ এক উল্লেখযোগ্য জয়। তিনি বলেন, সিনিয়র চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, ছাত্রছাত্রী সহ সাধারণ মানুষ সক্রিয় ভাবে অংশ না নিলে এই আন্দোলন জয়যুক্ত হত না। আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের পক্ষ থেকে তিনি এঁদের সবাইকে অভিনন্দন জানান।

যে মুখ্যমন্ত্রী ঔদ্ধত্যের সাথে বলেছিলেন, অনেক আন্দোলন হয়েছে এবার উৎসবে ফিরুন, যিনি ১১ সেপ্টেম্বর নবান্ন সভাঘরে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনার লাইভ স্ট্রিমিংয়ের সামান্য দাবিটুকুও মানতে রাজি ছিলেন না– ১৪ সেপ্টেম্বর ধরনাস্থলে আসতে হয়েছিল তাঁকেই। যে সিবিআই এক মাসে তদন্তের কাজে কোনও অগ্রগতি দেখাতে পারেনি, তারাও আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ডাঃ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার ওসিকে অভয়ার খুন-ধর্ষণের মূল মামলায় গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হল। জুনিয়র ডাক্তারদের লাগাতার দৃঢ়পণ লড়াই, আর সেই লড়াইয়ে জনসাধারণের বাঁধভাঙা সক্রিয় সমর্থন না থাকলে, সরকারের দিক থেকেও এই নমনীয়তা দেখা যেত না।

সরকার ভেবেছিল, সুপ্রিম কোর্টের নাম করে ডাক্তারদের কাজে ফেরার হুমকি দিলেই জুনিয়র ডাক্তাররা ভয় পেয়ে আন্দোলন তুলে নেবেন। কিন্তু দেখা গেল জুনিয়র ডাক্তার সহ রাজ্যের সাধারণ মানুষ আন্দোলনে অনড়। স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের অবস্থান কার্যত আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল। প্রতিদিন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ তাঁদের আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ডাক্তারদের জন্য তাঁরা খাবার, জল, অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে ছুটে এলেন।

এই আন্দোলন জনগণের আন্দোলনে পরিণত হয় অনেক আগেই।জনসমর্থন আরও ব্যাপক আকার নিচ্ছে দেখেই ১৪ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী ধরনাস্থলে গিয়ে আবার তাঁদের আলোচনায় ডাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু বহু আশা জাগিয়েও আলোচনা সেদিনও হতে পারেনি। ডাক্তাররা যে সঙ্গত কারণেই স্বচ্ছতার প্রশ্নটা বারবার তুলেছেন তা মানুষ বুঝেছে। সরকার আলোচনাটা ভেস্তে দিতে বদ্ধপরিকর বুঝে তাঁরা সরাসরি সম্প্রচারের পরিবর্তে নিজেদের ভিডিওগ্রাফার দিয়ে ছবি তুলে রাখা, এমনকি সরকার তা নিয়ে টালবাহানা করার পর দুই পক্ষের সই করা মিনিটস রাখা হবে এই শর্তেও রাজি ছিলেন। কিন্তু তা সত্তে্বও সরকারি টালবাহানায় বৈঠক হতে পারেনি।

মানুষ প্রশ্ন তুলেছে, লাইভ স্ট্রিমিংয়ে জনগণ এই আলোচনা শুনলে সরকারের অসুবিধা কোথায়? যখন গোটা রাজ্যের মানুষ সরাসরি এই আন্দোলনের সাথে একাত্ম, তখন তাঁদের আলোচনার গতিপ্রকৃতি সরাসরি জানতে দিতে সরকার কি ভয় পাচ্ছে? আইনগত কোনও বাধাও যে নেই তা জানিয়েছেন বিশিষ্ট আইজীবীরাও। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, সিবিআই বন্ধ খামে আদালতকে যাই জানাক, অন্তত তার মূল কথাগুলো তারা জনগণকে জানাবে না কেন? এটা তো কেবলমাত্র সিবিআই ও কোর্টের বিষয় নয়! রাজ্য সরকারের কাছে মানুষের প্রশ্ন– সুপ্রিম কোর্ট কি শুধু জুনিয়র ডাক্তারদের কাজে ফেরার কথাটুকুই ৯ সেপ্টেম্বর বলেছে? আদালতে ভক্তি এত হলে রাজ্য সরকার বলুক তাদের পুলিশ ও প্রশাসনের যে গাফিলতিগুলি দিকে সুপ্রিম কোর্ট আঙুল তুলেছে সে বিষয়ে তারা কী করেছে। তদন্তকে কার্যত বিপথে চালনা করার চেষ্টা যে পুলিশ করেছে তা আজ মানুষ বুঝেছে। টালা থানার ওসি-র গ্রেপ্তারিতে তা আরও স্পষ্ট।

সুপ্রিম কোর্ট নানা প্রশ্ন ইতিমধ্যেই তুলেছে। তার মধ্যে এফআইআর করতে ১৪ ঘণ্টা দেরি থেকে শুরু করে ময়নাতদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় নথি বা চালান না থাকা সহ নানা গাফিলতির কথা আছে। এই সব গাফিলতি যার নির্দেশেই ঘটুক, প্রশাসনিক কর্তা হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী এর দায় এড়াতে পারেন না। সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরাও ইঙ্গিত করেছেন তথ্যপ্রমাণ লোপাটের দিকে। ফলে ন্যায়বিচার কতটুকু আদালতের চৌহদ্দিতে মিলবে তার উত্তর ভবিষ্যতই বলবে।

জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি ছিল মাত্র পাঁচটি– ১) অভয়ার খুন-ধর্ষণের জন্য দায়ী সমস্ত দোষীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে শাস্তি দিতে হবে, ২) প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রমাণ লোপাটে যুক্ত সকলকে শাস্তি দিতে হবে। সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, স্বাস্থ্য দফতরের ডিএমই, ডিএইচএস ও স্বাস্থ্যসচিবকে অপসারণ করতে হবে, ৩) কলকাতা পুলিশের অপদার্থতার দায় নিয়ে পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে পদত্যাগ করতে হবে, ৪) সমস্ত হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দে্র সঠিক পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। সকল স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সমস্ত কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মী সহ সকল কর্মীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। ৫) প্রতিটি মেডিকেল কলেজে শাসকদলের সন্ত্রাসের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। কলেজ ও হাসপাতাল পরিচালনায় সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সমস্ত কমিটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ছাত্র-ছাত্রী ও জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এগুলি এখন সারা রাজ্যের সাধারণ মানুষেরও দাবি। লাগাতার আন্দোলনের তীব্রতা দেখে এর অনেকগুলিই মেনে নিল সরকার।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও হুমকির যে নোংরা সংস্কৃতি চলছে তার বিরুদ্ধে এতদিন ধরে বারবার নানা মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা লড়েছেন। চিকিৎসকদের নানা সংগঠনও তা বলেছেন। অভয়ার বিচারের দাবিতে আন্দোলনের অভিঘাত তাকে একেবারে সামনে এনে দিয়েছে। যে ভয়াবহ দুর্নীতির কথা শোনা যাচ্ছে তা যে অমূলক নয়, তা আরও বোঝা গেল মুখ্যমন্ত্রী যখন জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনস্থলে দাঁড়িয়ে সমস্ত হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতিগুলি ভেঙে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন। বোঝা যাচ্ছে এই বিষচক্রের কথা তাঁর অজানা ছিল না। তিনি কোনও টেন্ডারে সই করেছেন কি না সেটা বড় কথা নয়, তাঁর দফতরের এই দুর্নীতি দূর করার বিষয়ে তিনি কী করছেন এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্যই জুনিয়র ডাক্তাররা আলোচনার স্বচ্ছতা চেয়েছিলেন।

অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলনে গ্রাম-শহর সর্বত্র যে জনজাগরণ দেখা যাচ্ছে তা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সল্টলেকের স্বাস্থ্যভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সাধারণ মানুষের যে ঢল নামে তাও ঐতিহাসিক। এই দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় দিল্লির কৃষক আন্দোলনের কথা। খাবার, জল, ওষুধ থেকে শুরু করে সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে মানুষ উপস্থিত হয়েছেন প্রতিদিন। দরকার নেই, বলে আন্দোলনকারী ডাক্তাররা অনেক কিছু ফিরিয়ে দিলেও মানুষ থামেননি। ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে একটানা বৃষ্টি শুরু হলে বহু মানুষ বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন আন্দোলনকারী ছেলেমেয়েদের জন্য দুশ্চিন্তায়। অনেকে চৌকি, পাটাতন, ফোম, ত্রিপল জোগাড় করে পৌঁছে গেছেন আন্দোলনকারীদের দিতে। চাকরিজীবী, অধ্যাপক, শিক্ষক, চিকিৎসকরাই শুধু নন, ফেরিওয়ালা, হকার, অনলাইন খাবার ডেলিভারি বয় থেকে শুরু করে খবরের কাগজ বিক্রেতারাও তাঁদের রোজগারের টাকা তুলে দিয়েছেন আন্দোলনকারীদের হাতে। এই ঘটনা দেখিয়ে দিল ন্যায়সঙ্গত দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন কী ভাবে গোটা সমাজে জাগরণ আনতে পারে, পারে মনুষ্যত্বের স্ফূরণ ঘটাতে। জীবনযন্ত্রণায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে হতাশায় ভুগতে থাকা মানুষও যে সব জড়তা ঝেড়ে ফেলে আন্দোলনে এগিয়ে আসেন– দেখিয়ে দিল এই ঐতিহাসিক সময়।

জুনিয়র ডাক্তারদের এই আন্দোলন অনেকগুলি দাবিই ছিনিয়ে আনতে পারল। অভয়ার ন্যায়বিচার আদায় করতে পেরোতে হবে আরও অনেকটা পথ। পাশাপাশি এই আন্দোলন সমাজের বহু অন্যায়ের প্রতিকারের আকাঙক্ষা জাগিয়ে দিয়েছে মানুষের মনে– যা এক বড় অর্জন।