আমফান ঘূর্ণিঝড় এবং করোনা মহামারির জোড়া আক্রমণে বিধ্বস্ত পশ্চিমবঙ্গের জনজীবনে অতিরিক্ত বিপর্যয় হিসাবে এসেছে ত্রাণ নিয়ে প্রায় সর্বব্যাপক দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, দলবাজির ধাক্কা৷ পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে তাতে শাসকদলের পঞ্চায়েত স্তরের এক নেতা পর্যন্ত চিঠি লিখে প্রশাসনকে জানিয়েছেন, ত্রাণ প্রাপকের তালিকার ৮০ শতাংশ ভুয়ো৷ প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত সমিতি কিংবা জেলা পরিষদের কর্তাদের প্রাসাদোপম বাড়ির ছবি আর তাদের ছেলে–মেয়ে–স্ত্রী এমনকি শ্বশুর–শাশুড়ি ইত্যাদি প্রায় সকলের নাম ঘরহারা মানুষের তালিকায় ওঠার সংবাদ প্রকাশিত হয়ে চলেছে৷ মুখ্যমন্ত্রীও প্রকারান্তরে স্বীকার করেই নিয়েছেন, আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে৷
বিষয়টা হয়তো পিছনেই থেকে যেত, ঝড়ে সব হারিয়েও কিছুই না পাওয়া মানুষের চোখের জল চোখেই শুকিয়ে যেত, বাতাসে মিলিয়ে যেত তাঁদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ৷ কিন্তু তা হতে পারেনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, উত্তর চব্বিশ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা সহ জেলায় জেলায় সাধারণ মানুষের সোচ্চার হয়ে আন্দোলনে নামায়৷ যার ফলে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রায়দিঘি ব্লকে এক পঞ্চায়েত সদস্যকে জনসমক্ষে কান ধরে স্বীকার করতে হয়েছে তিনি দুর্নীতি করেছেন৷ যে সমস্ত বিডিও এমনকি জেলাশাসকরা পর্যন্ত নির্বিচারে ভুয়ো নামে ভর্তি তালিকাতেই সিলমোহর দিয়ে পঞ্চায়েতি বাস্তুঘুঘুদের টাকা পাইয়ে দেওয়ার কাজটি নিশ্চিন্তে করে চলছিলেন, চাপে পড়ে এখন তাঁরা ভুয়োদের ব্যাঙ্কে জমা পড়া টাকা ফেরত চাইবার কথা বলছেন৷ তালিকা যাচাই না করে তাঁরা টাকা দিলেন কেন? কেন এভাবে একদল স্বার্থান্বেষীকে টাকা পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রশাসনিক অফিসারদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে না? যারা মিথ্যা আবেদন করে টাকা নিয়েছেন তারা ধরা পড়লে টাকা ফিরিয়ে দিয়েই পার পেয়ে যাবেন কেন? অফিসার পঞ্চায়েতি বাবু আর শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের এই চক্র তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের জানা ছিল না তা কি সত্য? তা যদি হত, তাঁরা দুর্নীতি সত্যিই না চাইতেন, তাহলে এই চক্রের পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করে তাদের গ্রেপ্তার করাতেন না কি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার প্রায় সমস্ত ব্লকে এস ইউ সি আই (সি) দল বা নানা গণসংগঠনের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ হয়েছে৷ আবার দলীয় ব্যানার ছাড়াই সাধারণ মানুষকে ত্রাণের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করে বিক্ষোভ সংগঠিত করতেও সাহায্য করেছে এই দলই৷ ভোটের বাজারে যে সমস্ত দলগুলিকে মূল বিরোধী বলে তুলে ধরতে সংবাদমাধ্যম সর্বদা সচেষ্ট, তাদের নেতাদের কিছু টিভি বিবৃতি আর ‘টুইটার’ ইত্যাদিতে কিছু প্রতিক্রিয়া জানানো ছাড়া খুঁজে পাওয়া দুষ্কর৷ খুব বেশি হলে কিছু আকস্মিক হল্লা আর ভাঙচুর ইত্যাদি করে সংবাদমাধ্যমে ছবি তোলানোর ব্যবস্থা করেই আবার এই নেতারা ফিরে যাচ্ছেন আরামের ঘেরাটোপে৷ মানুষকে সংগঠিত করে, তাদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলার রাস্তায় তাঁরা নেই৷ সিপিএম–বিজেপি–কংগ্রেসের মতো দলগুলির পক্ষে এর থেকে বেশি কিছু করা সম্ভবও নয়৷ কারণ তারা যেখানে ক্ষমতায় আছে বা ছিল, সেখানেই একই ধরনের দুর্নীতি করে চলেছে৷
এই ত্রাণ দুর্নীতি দেখিয়ে দিচ্ছে গ্রামীণ মানুষের ক্ষমতায়ন আর প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণের নামে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা কীভাবে দুর্নীতিগ্রস্তদের ক্ষমতায়ন এবং প্রশাসনের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সার্বিক দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছে৷ কংগ্রেস আমলের সেই ইউনিয়ন বোর্ডের সময় যেমন করে গ্রামীণ মাতব্বর ধনীরাই ছড়ি ঘোরাতেন, সরকারি সুযোগসুবিধার সবটুকু ভোগ করতেন, সিপিএম আমল থেকে পঞ্চায়েত ঠিক একই ধরনের কাজ করছে৷ বরং তা আরও বাড়িয়েছে৷ রাজ্যের ক্ষমতাসীন শাসকদলের সাথে থাকলে পঞ্চায়েতে লুঠ চালানো যাবে, এটা বুঝিয়ে গ্রামীণ ক্ষেত্রে একদল রাজনৈতিক টাউটের জন্ম দিয়েছে তারাই৷ আজ সেই টাউটরাই দলে দলে তৃণমূলে নাম লিখিয়ে গ্রামীণ গরিব মানুষের ঘাড়ে পা দিয়ে চলছে৷ এরাই ছিল ছিটেফোঁটা সুবিধা, কিছু টাকা ছুঁড়ে দিয়ে আর পেশির জোর দেখিয়ে গরিব মানুষের ভোট কেনার জন্য সিপিএমের ‘সম্পদ’৷ এখন এরা অনেকেই তৃণমূলে৷ কিছু আবার লোকসভা ভোটের সময় তৃণমূলের দলীয় খেয়োখেয়িতে সুবিধা করতে না পেরে কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপিতে ভিড়েছে৷ সিপিএমের নিচুতলার নেতা–কর্মীরা আজ নিশ্চয়ই মনে করতে পারেন, তাঁদের সেই সব ‘সম্পদ’ নেতাদের প্রবল দাপটের কথা তাঁরা মানুষকে রাজনীতি না বুঝিয়ে বোঝাতেন, রাজ্যে আমরা আছি, কেন্দ্রেও কংগ্রেসের সাথে আমাদের ম্যানেজ হয়ে যাবে, পঞ্চায়েতে অন্যদের ভোট দিলে কিচ্ছু সুবিধা পাবে না৷ আমাদের সাথে থাকলে সব গুছিয়ে নিতে পারবে৷ সাধারণ মানুষকে এ কথা বুঝিয়ে আসলে গুছিয়েছেন পঞ্চায়েতি বাবুরাই৷ জঙ্গলমহলে সিপিএমের এক নেতার বাড়ি যখন জনরোষে ভাঙা পড়েছিল সে বাড়ির বৈভব দেখে মানুষের চোখ কপালে উঠেছিল৷ আজকের ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতির রমরমা তারই ধারাবাহিকতা৷
একদিকে এই দুর্নীতি রোধ এবং পঞ্চায়েতকে অন্তত কিছুটা সাধারণ মানুষের পক্ষে কাজ করাতে হলে কী দরকার? এস ইউ সি আই (সি) দল ১৯৭৮–এর প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই বলে এসেছে পঞ্চায়েতকে যেভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে তাতে বড়জোর শহুরে আমলা আর ক্ষমতাশালীদের সহযোগী হিসাবে কিছু গ্রামীণ আমলা আর ক্ষমতার কেন্দ্র পঞ্চায়েত তৈরি হতে পারে৷ এতে আদৌ গ্রামীণ সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতা আসবে না৷ সেইটা করতে হলে দরকার যথার্থ অর্থে গণকমিটি গড়ে তুলে তাদের মাধ্যমে পঞ্চায়েতে নজরদারি ও কাজ পরিচালনা৷ বশংবদ কিছু লোককে নিয়ে নাম কা ওয়াস্তে বেনিফিসিয়ারি কমিটি দিয়ে এ কাজ সম্ভব নয়৷ এর জন্য গ্রামে সব দলের প্রতিনিধি ও এলাকার শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট মানুষদের নিয়ে কমিটি গড়ে তাদের হাতে নজরদারির ক্ষমতা দিতে হবে৷ বর্তমান পরিস্থিতিতেও ২৪ জুন রাজ্য সরকারের ডাকা সর্বদলীয় সভায় এস ইউ সি আই (সি) নেতৃত্ব প্রস্তাব দিয়েছেন, ত্রাণ বন্টনের জন্য একেবারে নিচের তলায় সর্বদলীয় কমিটি গড়া হোক, তারাই গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলে ত্রাণ প্রাপকদের তালিকা তৈরি থেকে শুরু করে বন্টনের কাজে প্রশাসনকে সাহায্য করবে৷ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সদিচ্ছার কথা বললেও মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্য সরকার এই সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে নীরব থেকেছে৷ তারা শুধু প্রশাসনকে দিয়ে ত্রাণ বন্টনের কথাই বলেছে৷ অথচ এই প্রশাসনের একটা বড় অংশই শাসকদলের ক্ষমতার মধুভাণ্ডের লোভে দুর্নীতিতে মদত দিয়ে চলে তা আজ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট৷
ত্রাণে দুর্নীতি রোধ, তালিকা তৈরিতে স্বচ্ছতা এবং তৃণমূল স্তরে সর্বদলীয় কমিটির মাধ্যমে ত্রাণ বন্টনের দাবিতে তাই আন্দোলেনর ডাক দিয়েছে এস ইউ সি আই (সি)