দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের অন্যতম দেশ সার্বিয়ায় কয়েক মাস ধরে চলছে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন। রাজধানী বেলগ্রেড সহ নানা শহরে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। ছাত্রদের নেতৃত্বে সে দেশের জনসাধারণের এই আন্দোলন চরম মাত্রায় পৌঁছয় গত ১২ এপ্রিল। ওই দিন দেশের দক্ষিণপন্থী সরকারের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুসিক-এর অনুগামীরা পাল্টা মিছিল করলে ক্ষোভে ফেটে পড়েন এই বলকান দেশের জনগণ। ছাত্রদের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে রাশ টানতে এই পাল্টা মিছিলের আয়োজন করেছিল সরকার পক্ষ।
আন্দোলনের সূত্রপাত গত নভেম্বরে। সার্বিয়ার এক রেল স্টেশনের শেড ভেঙে ১৬ জন মানুষের মৃত্যুতে সরকারের বিরাট দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসে। একদিকে প্রেসিডেন্ট ভুসিকের স্বৈরাচারী ভূমিকার বিরুদ্ধে, অন্যদিকে এই যথেচ্ছ দুর্নীতির তদন্তের দাবিতে দেশজোড়া আন্দোলনে সামিল হন সাধারণ মানুষ। আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ছাত্রদের আন্দোলনে বিপুল সমর্থন জানান কৃষকরা, সমর্থন জানান বিচারপতি, আইনজীবী, অভিনেতা থেকে শুরু করে সমাজের প্রথিতযশা ব্যক্তিবর্গ। প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার সেই আন্দোলন কড়া হাতে দমনের চেষ্টা করেন। সরকারের সমালোচকদের, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলিকে দমন করতে শুরু করে স্বৈরাচারী সার্বিয়া সরকার। পুলিশ আন্দোলনকারী ছাত্র এবং জনসাধারণকে লাগাতার শাসানি দিতে থাকে। এর প্রতিবাদে ছাত্ররা ইউনিভার্সিটিতে ধর্মঘট ডাকলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেয় প্রশাসন। জানুয়ারি মাসে রাজধানী বেলগ্রেডে ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে ১০ হাজারের বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে অবরোধ করে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং অধিকাংশ স্কুলের ছাত্ররা তাদের প্রতিষ্ঠানে ২ মাস ধরে প্রচার চালায়।
আন্দোলনের তীব্রতা দেখে সার্বিয়ার বিচারবিভাগ দুর্নীতির তদন্তে ১ জন মন্ত্রী ও বেশ কিছু সরকারি পদস্থ কর্তা সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের ‘অভাবে’ পূর্তমন্ত্রী গোরান ভেসিক জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যান। সরকারের এই ন্যক্কারজনক ভূমিকায় ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্ররা। ‘আমাদের শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে রক্ত রয়েছে দান করার জন্য’– রাজপথের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে সোচ্চার হয় তারা।
প্রশাসন বেলগ্রেডের সংসদ ভবন সহ প্রধান জায়গাগুলি বন্ধ করে দেয়, যাতে প্রতিবাদের আগুন আরও ছড়িয়ে পড়তে না পারে। জনসাধারণের দাবি মানা দূরের কথা, রাজধানীতে জাতীয়তাবাদী হাজার হাজার সমর্থকের জন্য নাচ-গানের আসরের মঞ্চ স্থাপন, তাদের জন্য অসংখ্য তাঁবু এবং খাবারের স্টলের ব্যবস্থা করে সার্বিয়া সরকার। প্রতিবেশী দেশ কসোভো ও বসনিয়া থেকেও কিছু মানুষ এতে যোগ দেন। আপাতদৃষ্টিতে প্রশাসনিক ভবন রক্ষা করার নামে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদকে কেন্দ্র করে তার অনুগামীরা কয়েক ডজন ট্রাক্টর নিয়ে অবস্থান করে।
প্রেসিডেন্ট অনুগামীদের এই কর্মকাণ্ড দেখে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনকারীরা প্রবল ক্ষোভে ফেটে পড়ে। আন্দোলনকারী ছাত্ররা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন আরও জোরদার করার অঙ্গীকার নেয়।
সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর পূর্ব ইউরোপ ‘গণতন্ত্রের স্বর্গ’ হয়ে উঠেছিল বলে কিছুদিন আগেও গলা ফাটাচ্ছিল পুঁজিবাদী প্রচারকরা। অথচ দেখা যাচ্ছে একদিকে পুঁজিবাদী শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দিকে দিকে ফেটে পড়ছে। অন্য দিকে সেই বিক্ষোভ দমন করতে তথাকথিত ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারগুলোর পাশবিক নখ-দাঁত বেরিয়ে পড়ছে। সার্বিয়ার আন্দোলনেও দেখা গেল পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ছে সর্বশক্তি নিয়ে।