শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িতদের কঠোর শাস্তির দাবিতে ৫ আগস্ট রাজ্যের ৯টি স্থানে কেন্দ্রীয় মিছিলের আয়োজন করে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট )। কোচবিহার, শিলিগুড়ি, মালদা থেকে শুরু করে বহরমপুর, বর্ধমান, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, জয়নগর, কলকাতায় হাজার হাজার মানুষ এই বিক্ষোভ মিছিলে সামিল হন।
দুর্নীতিগ্রস্তদের কঠোর শাস্তি চাই– এই দাবিতে এখন রাজ্যের জনমত যেমন উত্তাল, তেমনি বহু চিন্তাশীল মানুষকে যে প্রশ্ন ভাবাচ্ছে, তা হল, এই দুর্নীতির অবসান কোন পথে? রাজ্যের প্রবীণ মানুষরা দেখেছেন, ১৯৭৪ সালে কংগ্রেস সরকারের নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে দেশব্যাপী যে গণজাগরণ ঘটেছিল, তার অভিঘাতে ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সরকার উল্টে গেলেও দুর্নীতি দূর হয়নি। বরং পরবর্তী সময়ে তা আরও বৃহত্তর রূপে এসেছে। ২০১১ সালে আন্না হাজারের নেতৃত্বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হলেও এবং ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটলেও দুর্নীতি বন্ধ হয়নি। সে তার ডালপালা আরও মেলেছে এবং এটাও ঘটনা যে, স্বাধীনতার পর থেকে কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে যে দল ক্ষমতায় এসেছে প্রত্যেকেই কম-বেশি দুর্নীতিতে হাত পাকিয়েছে। স্বভাবতই যারা গভীরে ভাবছেন, তাদের প্রশ্ন– এই দুর্নীতির উৎস কী? একে দূর করার প্রক্রিয়াই বা কী? ভোটের মাধ্যমে সরকার পাল্টানোর দ্বারা যে দুর্নীতি রোধ হতে পারে না, প্রধানমন্ত্রী নেহেরু থেকে শুরু করে বর্তমান মোদি সরকার এবং রাজ্যে সিপিএম থেকে তৃণমূল কংগ্রেস, প্রত্যেকের দুর্নীতি তার জীবন্ত প্রমাণ। তাহলে কোন পথে হতে পারে দুর্নীতির অবসান?
অনেকে মনে করেন, মানব সমাজে দুর্নীতি চিরকালই ছিল এবং থাকবে, এর থেকে মুক্তি নেই। কিন্তু ইতিহাস কি তাই বলছে? ইতিহাস বলছে, লোভ-লালসা, ব্যক্তির হীন স্বার্থবোধ, যে কোনও উপায়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানাবার ও বাড়াবার মনোভাব, মুনাফাবৃদ্ধির তাগিদে অপরকে যে কোনও উপায়ে কোণঠাসা করে এগিয়ে যাওয়ার মনোবৃত্তি– যা দুর্নীতির পথে মানুষকে পরিচালনা করে, তা চিরকাল সমাজে ছিল না। সমাজে যখন শ্রেণি-বিভাজন ঘটেনি, অপরের শ্রম চুরি করে অধিকাংশ মানুষকে বঞ্চিত করে মুষ্টিমেয়র বিত্তশালী হওয়ার পরিবেশ যখন আসেনি, তখন লোভ বা দুর্নীতির প্রশ্নও ছিল না। সুতরাং সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে ব্যক্তিসম্পত্তির উদ্ভব এবং তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অসাম্যই লোভের জন্ম দিয়েছে। তারপর সময়ের সাথে সাথে এই অসাম্য যত বেড়েছে, সামাজিক শ্রমের ফসল ক্ষমতাবান শ্রেণির হাতে যত কুক্ষিগত হয়েছে, সম্পত্তির লোভ এবং মুনাফার জন্য ন্যায়নীতি বিসর্জন দেওয়াও তত স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত হয়েছে।
প্রতিটি শ্রেণি-বিভক্ত শোষণমূলক সমাজেই শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা কোনও না কোনওভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়েছে এবং গোটা সমাজ জুড়েও দুর্নীতির বিষ ছড়িয়ে পড়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়, বিশেষ করে যখন পুঁজিবাদ মুমূর্ষু, জরাগ্রস্ত, যখন জাতীয়তাবাদী আদর্শ ঐতিহাসিকভাবেই তার ভূমিকা হারিয়েছে, যখন পুঁজিবাদ কোনওরকম মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ধার ধারে না, তখন যাবতীয় দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপ এক চরম স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে। শুধু ভারতবর্ষ নয়, বিশ্বের কি শিল্পোন্নত, কি পিছিয়ে পড়া সকল পুঁজিবাদী দেশেই চোখে পড়বে চুরি-দুর্নীতি, স্বজনপোষণের দগদগে ঘা। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নানা মন্ত্রী-আমলা, পুলিশ-প্রশাসন, মিলিটারি, বিচারবিভাগ সবই আজ প্রায় প্রতিটি পুঁজিবাদী দেশেই দুর্নীতির পাঁকে ডুবে আছে। বোঝাই যায়, দুর্নীতির ব্যাধি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে যে সমস্ত দল রক্ষণাবেক্ষণ করছে, তারা দুর্নীতিগ্রস্ত হতে বাধ্য এবং হচ্ছেও। আজকের দিনে দুর্নীতি দূর করার সংগ্রামটি তাই ঐতিহাসিকভাবে এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা উচ্ছেদের সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত, যে সংগ্রামের পতাকা আজকের ভারতবর্ষে একমাত্র বহন করছে এস ইউ সি আই (সি) দল। এই দিকটি বাদ দিয়ে শুধু ‘শিক্ষামন্ত্রীর শাস্তি চাই’ স্লোগান দিয়ে লাভ হবে না। তাতে শিক্ষামন্ত্রীর শাস্তি হলেওপরবর্তী কালে যাঁরা মন্ত্রিসভায় আসবেন, তাঁরাও একই ভাবে দুর্নীতির পাঁকে ডুববেন। কারণ এই পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিই নিজে দুর্নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে এবং প্রতি মুহূর্তে দুর্নীতির জন্ম দিয়ে চলেছে।