Breaking News

দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের চাপে সঙ্কটে চিকিৎসকরা

 

শাসকদলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-মন্ত্রীরা ইডি, সিবিআইয়ের গ্রেফতারির সামনে পড়ে যেভাবে অসুস্থতার নামে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তোড়জোড় করে থাকেন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ডাক্তারদের ওপর প্রকাশ্যে ও গোপনে যে চাপ সৃষ্টি করা হয়, তা এক ধরনের প্রশাসনিক সন্ত্রাসেরই নামান্তর।

আজ এস এস কে এম থেকে বোলপুর হাসপাতাল– সর্বত্র এ জিনিস চলছে। প্রভাবশালীদের অঙ্গুলি হেলনেই চিকিৎসকদেরকে প্রেসক্রিপশন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। ইডি, সিবিআইয়ের তাড়া খেয়ে মন্ত্রী-নেতারা সরাসরি ভর্তি হয়ে যাচ্ছেন পিজির উডবার্ন ওয়ার্ডে। তখন বাধ্য হয়ে ব্যক্তি চিকিৎসক বা মেডিকেল বোর্ডকে তাদের ভর্তির কারণটা বৈধ বলে প্রতিপন্ন করতে হচ্ছে। কোথায় সেখানে মেডিকেল এথিক্স! বোলপুর হাসপাতালে শাসক দলের নেতারা নির্দেশ দিলেন, হাসপাতাল সুপারকে ওই বিশেষ নেতাদের বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা করার জন্য মেডিকেল টিম পাঠাতে। হাসপাতাল সুপার মেডিকেল এথিক্স, সার্ভিস রুলসের তোয়াক্কা না করে এবং অগ্র-পশ্চাৎ না ভেবেই, সর্বোপরি মেডিকেল টিমের লিখিত নির্দেশ তৈরি না করে টেলিফোনে চিকিৎসককে নির্দেশ দিলেন ইডি-র নিশানায় থাকা ওই নেতার বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা করতে। নেতা চিকিৎসককে নির্দেশ দিলেন, সাদা কাগজে ১৪ দিনের বিশ্রামের পরামর্শ লিখে দিতে। ঘটনা জানাজানি হতেই নেতা থেকে জেলা সভাধিপতি এবং হাসপাতাল সুপার সকলেই বলছেন, আমরা তো ডাক্তারকে নির্দেশ দিইনি, কেবল অনুরোধ করেছিলাম মাত্র!

আজ কে না জানে, ওই ‘অনুরোধ’ কী ভয়ঙ্কর! সরকারি কাজে নির্দেশের চেয়ে অনুরোধ আসে অনেক বেশি পরিমাণে। আর সেই অনুরোধ না মানলে একজন সাধারণ সরকারি কর্মচারীর জীবনে কি ভয়াবহ বিপদ নেমে আসে, তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন।

সবচেয়ে বড় কথা, স্বাস্থ্য বিভাগের কোনও কাজের নির্দেশ বা অনুরোধ কে করতে পারেন আর কে পারেন না, সে প্রশ্নটিই তো আজ ডাক্তারদের কাছে গোলক ধাঁধার মতো। এবেলা কোনও নির্দেশ বা অনুরোধ যদি স্বাস্থ্যভবন থেকে আসে, দুঘন্টা যেতে না যেতেই ওই অনুরোধ আসে সাধারণ প্রশাসনের কাছ থেকে। আবার বিকেল গড়াতে না গড়াতেই নির্দেশ আসে জেলা পরিষদ কিংবা স্থানীয় নেতা মন্ত্রীদের কাছ থেকে। যত না লিখিত নির্দেশ, তার বহু গুণে আসে মৌখিক নির্দেশ। লিখিত নির্দেশ চাইলে বলা হয়, আমি বলছি, এটাই কি যথেষ্ট নয়? স্বাস্থ্য দপ্তরের উপর এই রকম মৌখিক নির্দেশ যতটা না স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে আসে, তার চেয়েও বহুগুণে আসে অন্য দপ্তর, সাধারণ প্রশাসন, নেতা মন্ত্রীদের কাছ থেকে। আর এই নির্দেশ না মানলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের নামে অভিযোগ যায় স্বাস্থ্য দপ্তরে। অমনি স্বাস্থ্যকর্তারা খড়গ হস্তে ওই চিকিৎসকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অন্য দপ্তরের অথবা নেতা মন্ত্রীদের দেওয়া স্বাস্থ্য দপ্তর বহির্ভূত এইসব নির্দেশ মানা যায় কি না জানতে চাইলে স্বাস্থ্য কর্তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন, অথবা ওই চিকিৎসকের উপরে শাস্তির খাঁড়া নামিয়ে আনেন। কারণ, ওই স্বাস্থ্য প্রশাসকের টিকিটাই তো ওখানে বাঁধা রয়েছে! ফলে স্বাস্থ্য দপ্তরের এই নৈরাজ্য দীর্ঘদিন ধরে চলতে চলতে চিকিৎসকরাও আজ আর কোনও ঝুঁকি নিতে চান না। অনেকে ভুলেই গেছেন কে বা কারা তাকে নির্দেশ দিতে বা অনুরোধ করতে পারে। এই ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’র ফাঁদে পড়ে পিজি থেকে বোলপুর, বোলপুর থেকে প্রত্যন্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র– সর্বত্রই চিকিৎসকেরা আজ দিশেহারা। একটা দপ্তরের গণতন্ত্র এবং একই সাথে তার স্বাধিকার নষ্ট হলে এই পরিণতিই তো হয়! এভাবে চিকিৎসার নৈতিকতাকে বরাবরই টুঁটি টিপে ধরেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস।

চিকিৎসা একটি মহান পেশা। বিভিন্ন সময়ে শাসক গোষ্ঠী এই পেশাকে কাজে লাগিয়ে চিকিৎসকদের দিয়ে নানা অনৈতিক কাজ করিয়ে নিচ্ছে। কখনও বদলির ভয় দেখিয়ে, কখনও প্রমোশন আটকানো থেকে শুরু করে মাইনে বন্ধ করার মতো নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করে এবং কর্মস্থলে সার্বিকভাবে প্রশাসনিক সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে ক্রমাগত চিকিৎসকদের দিয়ে নানা ধরনের মেডিকেল-এথিক্স বিরোধী কাজ করিয়ে নিচ্ছে শাসকরা। শুধু তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীরাই নন, মোদি থেকে যোগী– সকলেই এ কাজ করছে।

চিকিৎসা পেশার নীতি নৈতিকতার ধারণা খ্রিস্টপূর্ব চারশো বছর আগেই হিপক্রেটিসের হাত ধরে তৈরি হয়। পরবর্তী কালে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জেনেভা ডিক্লারেশনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় আধুনিক মেডিকেল এথিক্স এবং ওথ বা শপথ। এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সমস্ত দেশেই চিকিৎসকরা মেডিকেল পেশায় প্রবেশের মুখে তা পাঠ করে থাকেন। বর্তমানে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অবশ্য এই শপথের পরিবর্তে ধর্মীয় অনুশাসন যুক্ত চরক শপথ চালু করার নির্দেশ দিয়েছে, যা নিয়ে প্রবল বিতর্কের পরিবেশও তৈরি হয়েছে।

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের ফলেও চিকিৎসার নৈতিকতা ব্যাহত হচ্ছে। স্বাস্থ্যকে পরিষেবা হিসেবে না দেখে যত বেশি করে পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে তত নিম্নগামী হচ্ছে মেডিকেল এথিক্সে’র মান। সর্বোচ্চ মুনাফা লুন্ঠনের উদগ্র বাসনা ধূলিসাৎ করছে মেডিকেল এথিক্সকে। বড় বড় নার্সিং হোম বা বেসরকারি হাসপাতালের মালিকরা চিকিৎসকদের ব্যবহার করছে মুনাফা লুঠের যন্ত্র হিসেবে। চিকিৎসকদের একাংশও তার শিকার হয়ে পড়ছেন। গোটা সমাজজীবনে ন্যায়-নীতি-মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়ের সাথে সাথে, তার অঙ্গ হিসেবেই সার্বিকভাবে নিম্নগামী হচ্ছে চিকিৎসকদের নীতি নৈতিকতার মান। আর এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে স্বার্থান্বেষী একদল মানুষ।

মানবসভ্যতার শত্রু ফ্যাসিস্ট হিটলার জার্মানিতে এভাবে চিকিৎসকদের ব্যবহার করেছে। হিটলারের উগ্র জাত্যভিমান ও জাতীয়তাবাদের আহ্বানে ভেসে গিয়ে চিকিৎসকরা সেখানে জীবন্ত মানুষের উপর নানা পৈশাচিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। গ্যাস চেম্বারে ছেড়ে দিলে মানুষ কতক্ষণ বাঁচতে পারে, গর্ভবতী মহিলাকে অজ্ঞান না করে অপারেশন করলে কষ্ট সহ্য করে কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে, শিশুকে বরফের মধ্যে ছেড়ে দিলে কতক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে– এই সব অমানুষিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো সেদিন চিকিৎসকদের দিয়েই করানো হয়েছিল!

একই জিনিস দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গে, ঐতিহাসিক নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময়। তদানীন্তন সিপিএম পরিচালিত সরকার গুলি চালিয়ে নন্দীগ্রামের ১৪ জন আন্দোলনকারীকে হত্যা করেছিল। আন্দোলন ধ্বংস করতে মহিলাদের গণধর্ষণ করানো হয়েছিল! আর সেই ঘটনাকে চাপা দিতে সেদিন সিপিএম-ফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী-নেতারা চিকিৎসকদের উপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিলেন। আক্রমণের ভয়াবহতা লঘু করে দেখাতে কিছু চিকিৎসককে বাধ্য করেছিল সেই ভয়াবহ আঘাতকে ‘সিম্পল ইনজুরি’ হিসাবে লিখতে, যাতে বুলেট এবং গণধর্ষণের দগদগে দাগগুলি চাপা দেওয়া যায়। মৃতদেহ ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ‘বুলেট ইনজুরি’ কথাটি চাপা দিতে রাজি না হওয়ায়, একদল চিকিৎসকের ওপর নেমে এসেছিল শাস্তির খাঁড়া। সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।

আজ সময় এসেছে সমগ্র চিকিৎসক-সমাজকে একত্রিত হয়ে মেডিকেল এথিক্সের মহান পতাকাটি ঊর্ধ্বে তুলে ধরার।