পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কল্যাণে আজ পৃথিবীর সমস্ত দেশেই ধনকুবেরের প্রাসাদের পাশে ফুটপাথের ডাস্টবিন খুঁটে খাওয়া মানুষের দেখা মেলে৷ সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব বৈষম্য রিপোর্টেও ফুটে উঠেছে মানুষে মানুষে বিপুল পার্থক্যের সেই মর্মান্তিক ছবি৷ দেখা যাচ্ছে ধনী–গরিবে এই বৈষম্য দিনে দিনে আকাশছোঁয়া হয়ে উঠছে৷ বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দার পর এই বৈষম্য তীব্রতর হয়েছে৷
পাঁচ প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদের তত্ত্বাবধানে তৈরি বিশ্ব বৈষম্য রিপোর্ট বলছে, আমেরিকায় আয়ের বিচারে সবচেয়ে উঁচুতে থাকা মাত্র ১৩০০টি পরিবারের উপার্জন গত ১২ মাসের মধ্যে বেড়েছে ৬৩৬ শতাংশ৷ এই পরিবারগুলি সে দেশের মোট উপার্জনকারীদের মাত্র ০.০০১ শতাংশ৷ পাশাপাশি, আয়ের বিচারে একেবারে নিচের দিকে থাকা আমেরিকার ৫০ শতাংশ উপার্জনকারীর গড় আয় গত চার দশক ধরে একই রকম রয়েছে৷ অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির সমস্ত ধাক্কা সহ্য করে সংসার চালাতে হচ্ছে ওই একই টাকায়– একদিন–আধদিন নয়, দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে৷ রিপোর্টে আরও দেখা যাচ্ছে, ১৯৮০ সালে যেখানে আমেরিকার সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষের দখলে ছিল দেশের মোট সম্পদের ২৪ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৩৯ শতাংশ৷ অর্থাৎ দেশের সম্পদ আরও বেশি মাত্রায় গিয়ে জমা হচ্ছে অল্প কিছু মানুষের হাতে৷ বলা বাহুল্য, এই সম্পদ তৈরি হয়েছে সেইসব মেহনতি মানুষের ঘাম–রক্ত নিংড়ানো পরিশ্রমের বিনিময়ে, যারা দিনে দিনে তলিয়ে যাচ্ছে দারিদ্রের অতল অন্ধকারে৷
শুধু আমেরিকা নয়, সর্বত্রই একই ছবি৷ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপ, চিন, রাশিয়া ও কানাডার সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষের দখলে রয়েছে দেশের মোট সম্পদের যথাক্রমে ৩৭, ৪১, ৪৬ ও ৪৭ শতাংশ৷ সাব–সাহারান আফ্রিকা, ব্রাজিল ও ভারত – এই দেশগুলির প্রতিটিতে প্রায় ৫৫ শতাংশ সম্পদের দখল রয়েছে ধনকুবের ১০ শতাংশের হাতে৷
গত নভেম্বরে প্রকাশিত হয়েছে এ সংক্রান্ত আরও একটি রিপোর্ট৷ ক্রেডিট–সুইস সংস্থার তৈরি ওই রিপোর্ট দেখিয়েছে, বিশ্বের মোট সম্পদের প্রায় ৫০ শতাংশই রয়েছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের নিয়ন্ত্রণে৷ রিপোর্ট আরও বলেছে, বিশ্বজোড়া আর্থিক মন্দা শুরু হওয়ার সময়ে ২০০৮ সাল নাগাদ বিশ্বের সবচেয়ে ধনী কিছু মানুষের দখলে ছিল মোট বিশ্বসম্পদের ৪২.৫ শতাংশ৷ ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০.১ শতাংশে৷
সুতরাং এটা গোপন করার উপায় নেই যে, গোটা দুনিয়া জুড়েই ক্রমে বেড়ে চলেছে ধনী–গরিবের ব্যবধান৷ শুধু তাই নয়, ভয়ঙ্কর আর্থিক মন্দার ধাক্কায় গোটা পৃথিবীর সাধারণ মানুষের জীবন যখন জেরবার, তখনও বহাল তবিয়তে থেকেছে টাকার কুমির পুঁজিমালিকরা৷ বরং দেশে দেশে পুঁজিবাদের স্বার্থবাহী সরকারগুলির কৃপায় তাদের সমৃদ্ধি বেড়েছে৷
গোটা বিশ্ব জুড়েই চলছে অর্থনৈতিক মন্দা৷ নতুন কর্মসংস্থান দূরের কথা, পুরনো কল–কারখানাগুলিও একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ রুজি–রোজগার হারিয়ে পথে বসছে মানুষ৷ এই সময়েই প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ এইচ ও) এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কের আরও একটি রিপোর্ট৷ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দুনিয়া জুড়ে চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে ভিটে–মাটি হারিয়ে রাস্তার ভিখারিতে পরিণত হয়েছে ১০ কোটিরও বেশি মানুষ৷ বাস্তবে এই সংখ্যা যে আরও অনেক বেশি তা বলাই বাহুল্য৷
এভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রক্ত জল করা পরিশ্রমের বিনিময়ে মুনাফার ভান্ডার ক্রমেই ফুলে ফেঁপে উঠছে অতি ক্ষুদ্র এক অংশের৷ শোষণের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এটাই নিয়ম৷ যতদিন এই ব্যবস্থা বজায় থাকবে ততদিন মানুষে মানুষে এই জঘন্য বৈষম্যের অবসান ঘটবে না৷