দিশাহীন হয়েই সিপিএম নেতা–কর্মীরা বিজেপির পক্ষে দাঁড়ালেন

সিপিএম কর্মী–সমর্থকরা বামপন্থী হয়েও কেন ও কীভাবে বিজেপির পক্ষে দাঁড়ালেন, রাজ্য–রাজনীতিতে আজ এটা বিরাট প্রশ্ন৷ আরএসএস–বিজেপি আদর্শগত ভাবেই বামপন্থাকে তাদের প্রধান শত্রু বলে মনে করে৷ সেই আরএসএস–বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে বামপন্থী আদর্শকে শক্তিশালী করা দরকার, বামপন্থার শক্তি বাড়ানো দরকার৷ সেই লক্ষ্য থেকেই আমরা এই সমীক্ষায় জোর দিচ্ছি৷ সিপিএম কর্মী–সমর্থকদের কাছে আবেদন, বিদ্বেষমুক্ত মন নিয়ে আমাদের কথাগুলো বিচার করবেন৷

 এ রাজ্যে বিজেপির অস্তিত্ব প্রায় ছিলই না৷ তা সত্ত্বেও যে তারা এই নির্বাচনে উল্কাগতিতে সামনে চলে এল, এর পিছনে শাসক তৃণমূলের অপশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে কাজ করেছে সন্দেহ নেই৷ মানুষ তৃণমূলের চুরি–দুর্নীতি–ঔদ্ধত্য, আর ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে৷ কিন্তু শুধু তাতেই বিজেপি এই সাফল্য পেত না৷ সিপিএমের ভোট যে ব্যাপকভাবে বিজেপিতে গিয়েছে সেটি এখন আর কোনও অনুমান বা গোপন বিষয় নয়৷ একদিকে যেমন ভোটের শতকরা হিসেবে তা স্পষ্ট, তেমনই সিপিএম নেতারাও তা স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন৷ মাত্র তিন বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলেও সিপিএম ফ্রন্টের ভোট ২৬ শতাংশ থেকে কমে ৭.২ শতাংশে পৌঁছেছে৷ কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশি উদ্বেগের বিষয় হল, বিজেপির জয়ে সিপিএম কর্মী–সমর্থকদের উল্লাস, যা তারা কিছুতেই চেপে রাখতে পারেননি৷ 

এখন এই যে সিপিএম কর্মী–সমর্থকরা দলে দলে বিজেপিকে ভোট দিলেন, এটা কি তাঁদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত? যদি তাই হয় তা হলে দার্জিলিং থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত একই সুর শোনা গেল কী করে? তা হলে নেতৃত্ব কি বলে দিয়েছিলেন? ভোটের একদম শেষ পর্বে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যে বিবৃতি কাগজে প্রকাশ করা হল, তাতে বোঝানো হল, নেতৃত্ব এই প্রবণতা চান না৷ যদি তাই হয় তবে তাঁরা আগে বলেননি কেন? এ নিয়ে অনেক অনুমান ও প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে ঘুরছে৷ আমরা সে কথায় যাব না৷

আসলে একটু পিছিয়ে তাকালে দেখব, ২০১১ সালের নির্বাচনে সিপিএম ফ্রন্টের পরাজয়, যার পিছনে সিপিএম কর্মীদের ভূমিকা কম ছিল না৷ না হলে যাদবপুরের মতো সিপিএম গড়ে এক মামুলি আমলার কাছে ১৬ হাজার ভোটে মুখ্যমন্ত্রীর পরাজয় ঘটল কী করে? আসলে সিপিএমের ঔদ্ধত্য, দুনীর্তি দলবাজি তোলাবাজি ইত্যাদির বিরুদ্ধে সিপিএমের মধ্যেই প্রবল অসন্তোষ দানা বেঁধেছিল৷ তার থেকেই একটা বড় অংশ চেয়েছিলেন ভোটে নেতৃত্বকে কিছুটা শিক্ষা দিতে৷ কিন্তু মুশকিল হল, নেতৃত্ব যে এই শিক্ষা নিলেন না, আত্মসমীক্ষা দলে হল না– এই দিকটা বিক্ষুব্ধ কর্মীরা বিচার করে দেখলেন না৷ পরাজয়ের পর প্রথম দিকে খানিকটা নিজেদের ত্রুটি–গলদের কথা বললেও নেতৃত্ব তৃণমূল সরকার বিরোধী হুঙ্কার দিয়ে আত্মসমীক্ষার জরুরি বিষয়কে চাপা দিলেন এবং বলতে লাগলেন ২০১৬–র বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবে৷ এই আশায় ও মোহে সিপিএমের কর্মী বাহিনী বুঁদ হয়ে গেলেন আবার৷ কিন্তু কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেও সেই আশা ফলপ্রসূ হল না৷ বরং তৃণমূল কংগ্রেস আগের থেকেও বেশি আসনে জয়ী হয়ে গেল৷ কেন এটা ঘটল সেটাও অসন্তুষ্ট কর্মীরা বিচার–বিবেচনা করলেন না৷ তাঁরা বুঝতেই চাইলেন না, তাঁদের চৌত্রিশ বছরের শাসনকে মানুষ ভুলতে পারছে না৷ এখনও মানুষ সিপিএমকে চাইছে না৷ এই অবস্থায় অসন্তুষ্ট নেতা–কর্মীদের উচিত ছিল আত্মসমীক্ষা করার জন্য নেতৃত্বের উপর চাপ সৃষ্টি করা৷ জনগণের কাছে ভুল স্বীকার করতে নেতৃত্বকে বাধ্য করা৷ কিন্তু সে পথে না গিয়ে তাঁরা আওয়াজ তুললেন, সিঙ্গুরে টাটাকে না আসতে দিয়েই পশ্চিমবঙ্গের শিল্পবিকাশের সম্ভাবনাকে ধ্বংস করা হয়েছে৷ অর্থাৎ সিপিএম সরকার সর্ববিষয়ে ঠিক ছিল,  সেই সিপিএমকে সরকার থেকে সরিয়ে জনগণ ভুল করেছে৷ ক্রমে ক্রমে এই ভ্রান্ত চিন্তা ছড়িয়েছে, দৃঢ়মূল হয়ে বসেছে৷ অন্য দিকে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার বা উঠে দাঁড়ানোর নৈতিক শক্তি চৌত্রিশ বছর সরকারি ক্ষমতা ভোগ করার সুবাদে সমগ্র পার্টিটাই হারিয়ে বসেছে৷ এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারি ক্ষমতা ও টাকার জোর নিয়ে বিজেপি যখন এ রাজ্যে নামল, সিপিএম কর্মীরা অদ্ভুত রসায়নে ধরে নিলেন, তাঁদের দল নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের জোরে বিজেপিই পারবে তৃণমূলকে উৎখাত করতে৷ এই সময় সিপিএম নেতৃত্বের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ একটি বামপন্থী দলের কর্মীদের এ ধরনের চিন্তা যে ভুল ও বিধ্বংসী সে কথাটা নানা ভাবে দলের মধ্যে প্রচার ও শিক্ষার দ্বারা নিয়ে যাওয়াই ছিল নেতৃত্বের দায়িত্ব ও কর্তব্য৷ বিজেপির পুঁজিবাদ তোষণকারী, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব যে দেশে বাড়ছে, পশ্চিমবঙ্গেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চোরা স্রোত তারা বইয়ে দিচ্ছে, এটা পরিষ্কার বোঝা গেলেও সিপিএম নেতৃত্ব ভয়ঙ্কর শক্তি বিজেপিকে টার্গেট করলেন না৷ টার্গেট হিসেবে রাখলেন রাজ্যের সরকারকেই৷ সঙ্গে, বলতে হয় তাই বলার মতো বিজেপির বিরুদ্ধেও কিছু কথা বলতে থাকলেন৷ ফলে নেতা–কর্মীরা দিশাহীন হয়ে পড়লেন৷

দেশের পরিস্থিতি, সমস্যা, সংকট এক রকম থাকে না৷ আজ, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার ঝড় চলছে৷ দেশে দেশে দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট শক্তিরা আবার মাথা তুলছে৷ শুধুমাত্র লিবারেল ডেমোক্রেসির স্লোগান তুলে একে রোখা যাচ্ছে না৷ মার্কসবাদের কথা বাদই দিলাম, বামপন্থার আদর্শকে শক্তিশালী করতে না পারলে বামপন্থী কর্মীদের আদর্শগত চেতনা জীবন্ত রাখতে না পারলে, সমস্ত রকম প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রাম গড়ে তুলতে না পারলে, এবং সর্বোপরি  মানুষের জীবনের সমস্যাগুলি নিয়ে বামগণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে দক্ষিণপন্থার আক্রমণকে প্রতিহত করা যাবে না, এমনকী বামপন্থী কর্মীদেরও রক্ষা করা যাবে না, এই গুরুতর ও গভীর চিন্তার কোনও লক্ষণ সিপিএম নেতৃত্বের মধ্যে দেখা যায়নি৷ তাঁরা বরাবরই মনে করেছেন, যেখানে যার সঙ্গে সম্ভব জোট করে নির্বাচনে জয়ী হতে পারলেই তাঁদের দল বাঁচবে ও তাঁদের বামপন্থা রক্ষা পাবে৷ ত্রিপুরায় সিপিএমের পরাজয় ও তারপর বিজেপির তাণ্ডব দেখেও পশ্চিমবঙ্গে তাঁরা কার্যত নিষ্ক্রিয় রইলেন৷ সমগ্র দলের নেতা–কর্মীদের জড়িত করে বিজেপি–আরএসএসের বিরুদ্ধে যে আদর্শগত সংগ্রামের স্রোত দলের মধ্যে বইয়ে দেওয়া দরকার ছিল, তা তাঁরা করলেন না৷ তাঁদের সমস্ত আদর্শ–হিসেবনিকেশে কেন্দ্রে একটিই কথা– ভোট৷ ফলে সিপিএমের যে বিরাট কর্মী–সমর্থক বাহিনী আজও আছে, নেতৃত্ব তাঁদের কোনও বামপন্থী দিশা দেখাতে পারলেন না৷ তৃণমূল হঠাও বাংলা বাঁচাও– এই ধরনের একটা সস্তা স্লোগান কর্মীদের মুখে মুখে ঘুরতে লাগল৷ কিন্তু ‘বিজেপি হঠাও দেশ বাঁচাও’, এই বিষয়টা চলে গেল পিছনে৷  নেতা–কর্মীরা এতটাই দিশাহীন হয়ে পড়লেন যে মিডিয়ায় যখন প্রকাশিত হল, জেলায় জেলায় দলে দলে কর্মীরা বিজেপির পক্ষপুটে আশ্রয় নিচ্ছে, তখন সেই ঝোঁক আটকানোর পরিবর্তে নেতারা বলতে থাকলেন, বাঁচার আশায় কর্মীরা বিজেপিতে শেল্টার নিচ্ছে৷ ফলে বিজেপিতে যাওয়ার যে ভ্রান্ত এবং বিধ্বংসী প্রবণতা, সেটাই মদত পেয়ে গেল৷ যার বিকট ফলাফল দেখা গেল এবারের নির্বাচনে৷

কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা থেকে আমরা জানি, দল মানে একটা চিন্তাপ্রক্রিয়া৷ দল মানেই কোনও না কোনও শ্রেণির দল একথা ঠিক, তেমনই আলাদা আলাদা দল মানেই আলাদা আলাদা চিন্তাপ্রক্রিয়া৷ একই কমিউনিস্ট আন্দোলনের শরিক হয়েও লেনিন–স্ট্যালিনের চিন্তাপ্রক্রিয়া আর ট্রটস্কি–বুখারিনদের চিন্তাপ্রক্রিয়া এক ছিল না৷ তাই লেনিন–স্ট্যালিনরা সমাজতন্ত্র গড়লেন আর ট্রটস্কি সাম্যবাদের জয়ধ্বনি করতে করতে সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করার যজ্ঞে নামলেন৷ চীনে মাও সে তুঙের চিন্তাপ্রক্রিয়া আর লিউ সাউ চি–তেং শিয়াও পিং দের চিন্তাপ্রক্রিয়া এক ছিল না৷ তাই মাও সে তুঙ সমাজতন্ত্র গড়েছেন, লিউ সাউ চি তেং শিয়াও পিংরা তাকে পুঁজিবাদের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন৷ আজ যে চীন কমিউনিস্ট পার্টির সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেশটাকে একটা ফ্যাসিস্ট পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করল, সেটাও কি সবাই ধরতে পারছে৷ অর্থনৈতিক সাময়িক অগ্রগতির ঝলক দেখিয়ে বিশ্বের কত কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্নদের চীন ঘোল খাইয়ে দিয়েছে৷ আজও কত জন মনে করেন, লেনিন–স্ট্যালিনরা নয়, ট্রটস্কি–বুখারিনরাই ঠিক ছিলেন৷ সিপিএমের কর্মী–সমর্থকদেরও তাই বলব, বামপন্থার নামে ভ্রান্ত চিন্তাই আপনাদের এই বিধ্বংসী পথে নিয়ে গেল এবং এটা ঘটল মার্কসবাদী বলে নিজেদের দাবি করেও বামপন্থী চিন্তাপ্রক্রিয়া নেতৃত্বের নেই বলে৷ কেউ সিপিএম নেতৃত্বকে বলেনি, সুপরামর্শ দেয়নি এটাও সত্য নয়৷ বিশাখাপত্তনমে সিপিএমের বাইশতম কংগ্রেসে আমন্ত্রিত হয়ে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ এক দুই তিন চার করে বামপন্থীদের কর্তব্য–কর্মের কথা বলে এসেছিলেন৷ শোনার মন থাকলে তাঁরা সেগুলি বিচার করে দেখতেন৷ কিন্তু যে ভ্রান্ত চিন্তাপ্রক্রিয়ার ফাঁদে তাঁরা নিজেদের জড়িয়েছেন সেখান থেকে বেরোনো বড় মুশকিল৷

সিপিএমের নেতা–কর্মীদের মধ্যে যাঁরা আজও বামপন্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাঁদের বলব, সিপিএমের ভ্রান্ত চিন্তাপ্রক্রিয়া থেকে নিজেদের বের করতে না পারলে নিজেদের জীবনেও বামপন্থী আদর্শকে রক্ষা করতে পারবেন না, সমাজজীবনেও তাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না৷

(গণদাবী : ৭১ বর্ষ ৪২ সংখ্যা)