দিল্লি ও মহারাষ্ট্র, দুই ক্ষেত্রেই বিজেপির ভূমিকা ছিল বেআইনি

একই দিনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। প্রথম রায়টি দিল্লির আপ সরকার এবং উপরাজ্যপালের ক্ষমতার এক্তিয়ার নিয়ে। মামলাটি চলেছে আট বছর ধরে। অথচ সংবিধানে একটি নির্বাচিত সরকারের এক্তিয়ার কী, রাজ্যপালের এক্তিয়ারই বা কী, তা নির্দিষ্ট। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ সর্বসম্মত ভাবে জানিয়েছে, যাবতীয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার দিল্লির নির্বাচিত সরকারের। পুলিশ, আইনশৃঙ্খলা ও ভূমি দফতর সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার কেন্দ্রের। প্রশ্ন ওঠে, ক্ষমতার এই বিভাজনের জন্য আট বছর অপেক্ষা করার কিংবা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন হল কেন?

গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ থাকলে শুরুতেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার নির্বাচিত সরকারের অধিকারগুলিকে মান্যতা দিতে দ্বিধা করত না। পরিবর্তে দিল্লির উপরাজ্যপাল এতদিন সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে একের পর এক সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারের উপর চাপিয়ে এসেছেন গায়ের জোরে, যা আসলে পিছনে থাকা কেন্দ্রীয় সরকারেরই জোর। ভোটে নির্বাচিত একটি সরকারকে যে ভাবে এমনকি প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগুলির জন্যও পদে পদে উপরাজ্যপালের দ্বারস্থ হতে হচ্ছিল তা যে পুরোপুরি বেআইনি, তা বুঝতে সংবিধান বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না। সুপ্রিম কোর্ট উপরাজ্যপালের এই সব আচরণকেই অগণতান্ত্রিক এবং বেআইনি বলেছে। বলেছে, উপরাজ্যপাল কখনওই দিল্লি সরকারের সাংবিধানিক সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। অথচ তিনি এতদিন ধরে পাইকারি হারে তা করে গিয়েছেন। উপরাজ্যপালের ভাবটি হল, যা কিছু বিজেপির স্বার্থ রক্ষা করবে তিনি তা-ই করবেন, আইন বা গণতন্ত্রের ধার ধারবেন না। দেরিতে হলেও শীর্ষ আদালত উপরাজ্যপালের এক্তিয়ারের সীমাটি স্পষ্ট করে দিয়েছে। যদিও এই সীমা বাস্তবে বিজেপি নেতাদের অজানা ছিল না। সব কিছু জেনেই তাঁরা এই অগণতান্ত্রিক আচরণ চালিয়ে গেছেন।

দ্বিতীয় রায়টি মহারাষ্টে্রর রাজ্যপালের এক্তিয়ার সংক্রান্ত। সুপ্রিম কোর্ট দেখিয়েছে, মহারাষ্টে্রর প্রাক্তন রাজ্যপালও পদে পদে তাঁর এক্তিয়ার লঙ্ঘন করেছেন– আইন ভেঙেছেন, সরকার ভেঙেছেন, গণতন্ত্রকে পদদলিত করেছেন। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, একনাথ শিন্ডের নেতৃত্বে বেশ কিছু শিবসেনা বিধায়কের ‘বিদ্রোহে’র পরেই বিজেপি বিধায়ক দেবেন্দ্র ফড়নবীসের অভিযোগের ভিত্তিতে মহারাষ্ট্রের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরেকে বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের নির্দেশ দিয়ে প্রাক্তন রাজ্যপাল ভগত সিংহ কোশিয়ারি আইনমাফিক কাজ করেননি। কারণ, শিন্ডে গোষ্ঠী সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করেনি, তাই উদ্ধব সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে বলে মনে করার কোনও কারণ রাজ্যপালের সামনে ছিল না। শীর্ষ আদালত এই ঘটনাকে রাজ্যপালের রাজনীতিতে নাক গলানো বলে সতর্ক করে দিয়েছে যে, সংবিধান বা আইন কোনওটাই রাজ্যপালকে সরাসরি রাজনীতির ময়দানে নেমে পড়ার অনুমোদন দেয় না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বা অন্তর্দলীয় বিবাদে নাক গলানোর অধিকারও যে রাজ্যপালের নেই, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। অথচ মহারাষ্ট্রের তৎকালীন রাজ্যপাল কোশিয়ারি বিজেপির শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে বেআইনি এবং এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজগুলিই একের পর এক করে গিয়েছেন।

উপরোক্ত দুটি রায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এবং তার নিয়ন্ত্রিত রাজ্যপালদের চরম অগণতান্ত্রিক চরিত্রটিকেই আরও একবার প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনেও বিরোধী সরকারগুলিকে নাস্তানাবুদ করতে রাজ্যপালদের এমন করেই নির্বিচারে ব্যবহার করা হয়েছে। আজ যখন শাসকের বিরুদ্ধে রায় দিতে অনেক বিচারকেরই হাত কাঁপে, তখন এই দুই রায় নিশ্চয় উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বাস্তবিকই, বাদী কে, বিবাদী কে, এগুলি যে বিচার্য বিষয় হওয়া উচিত নয়, অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণই যে বিচারের একমাত্র মাপকাঠি হওয়া উচিত– এটা বিচারব্যবস্থার গোড়ার কথা। নিরপেক্ষ বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বহু যুগ ধরে এই ধারণা চালু রয়েছে যে, হাকিম নড়তে পারে, কিন্তু হুকুম নড়তে পারে না। বাস্তবে হাকিম আর হুকুম দুই-ই ইদানিং যে হারে নড়ে চলেছে তা বিচারব্যবস্থার উপর শাসক দলের প্রভাব এবং চাপকেই প্রকট করে তুলেছে এবং বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। একের পর এক মামলায় দেখা যাচ্ছে, হাকিম নড়লেই হুকুম শুধু নড়ছেই না, রীতিমতো উল্টোপথে হাঁটতে শুরু করছে। ফলে এমনকি ধর্ষক, খুনিরাও হাসতে হাসতে জেল থেকে বেরিয়ে আসছে। অন্য দিকে নির্দোষরা কখনও দেশদ্রোহের অভিযোগে, কখনও অন্য কোনও কল্পিত অভিযোগে জেলে পচছে। মনে পড়ে যায় এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর ন’বারের বিধায়ক, জননেতা প্রবোধ পুরকায়েতের বিরুদ্ধে খুনের মামলার কথা। নিম্ন আদালত তাঁকে বেকসুর ঘোষণা করে। রাজ্যে তখন সিপিএম শাসন। ঘটনার ২০ বছর পর হঠাৎই হাইকোর্টে মামলাটি ওঠে। তিনি কোনও রকম আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগই পাননি। তাঁর যাবজ্জীবন সাজা হয়ে যায়। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে গেলে বিচারক কোনও কাগজপত্র না দেখে মামলার নাম শুনেই বলেন, বিধায়ক হলে কি খুন করার অধিকার পাওয়া যায় নাকি? ফলে রায় অপরিবর্তিতই থেকে যায়। বিনা দোষে তিনি ১৭ বছর জেলে কাটাতে বাধ্য হন।

স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে যে, তা হলে আইনের নিরপেক্ষতার যে কথা বলা হয় তা কি ব্যক্তি-বিচারকের ভূমিকার উপরই কেবল নির্ভরশীল? এক একজন বিচারক কি তাঁদের নিজেদের মতো করে আইনের ব্যাখ্যা করবেন? অনেকেরই প্রশ্ন, এই দুটি মামলায় যদি অন্য বিচারপতি থাকতেন, তা হলেও কি একই রায় হত? আইন যদি সত্যকে প্রতিফলিত করে, তবে তা বিশেষ বিচারকের শাসকের প্রতি ভয় থাকা, না-থাকার দ্বারা প্রভাবিত হবে কেন? ‘আইন আইনের পথে চলবে’ এটা কি তা হলে কথার কথা?

পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ ‘বিচারবিভাগ’ এই একচেটিয়া পুঁজির কর্তৃত্বের যুগে কতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থাকতে পারে, তার সামনে রয়েছে বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। কিন্তু বিজেপি সরকার যখন আজ নানা অছিলায় গোটা বিচারব্যবস্থাকেই মুঠোয় পুরতে চাইছে, বিচার ব্যবস্থার মধ্যে কোনও বিরোধী স্বর বরদাস্ত করতে রাজি হচ্ছে না, সেই পরিস্থিতিতে এই দুই রায় অবশ্যই দৃষ্টান্তস্বরূপ।