(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আলোচনার নামে সময় কাটানোর খেলা
শেষ পর্যন্ত আন্দোলনকারী কৃষকদের দিল্লিতে পৌঁছনো যখন আটকানো গেল না তখন মোদি সরকার শুরু করল আলোচনার নামে দিনের পর দিন সময় কাটানোর নতুন খেলা। তাদের অঙ্ক ছিল প্রবল শীতে ক’দিন পরেই কৃষকরা রণে ভঙ্গ দেবে। এই চালাকি ধরতে কৃষকদের অসুবিধে হয়নি। কৃষকরা বলেছেন একই কথা আলোচনা করে আর সময় কাটানো নয়, কৃষি আইন বাতিল হবে কিনা সেই উত্তর দাও– ইয়েস অর নো। স্বাধীন ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসে এ-ও এক অভূতপূর্ব ঘটনা। যেখানে দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসকের চোখে চোখ রেখে কৃষকরা বলছেন, যথেষ্ট হয়েছে, এবার হ্যাঁ কিংবা না বলুন। বাঘা বাঘা মন্ত্রী-আমলারা কপালের ঘাম মুছে পরস্পরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করেছেন। কৃষকরা নিজেদের আপসবিরোধী চরিত্র বোঝাতে আলোচনার বৈঠকে সরকারের দেওয়া খাদ্য গ্রহণ না করে নিজেদের আনা খাবার খেয়েছেন।
২৬ এবং ২৭ নভেম্বরের মাত্র দুদিনের ঘোষিত ধরনা যে সারা দেশের মানুষের সক্রিয় সমর্থনে এমন শক্তি ও মর্যাদা অর্জন করবে, লাগাতার আন্দোলনের এমন তুফান তুলবে তা সরকার কল্পনা করতেও পারেননি।
কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও ছলে বলে কৌশলে আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও কম মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন না। তিনি অত্যন্ত বাকপটু। কথার মায়াজাল বুনে দেশের মানুষকে ঠকাতে, ঘায়েল করতে তাঁর তুলনা মেলা ভার। তিনি তাঁর নাটকীয় বাকপটুতাকে অক্লান্ত ভাবে ব্যবহার করছেন। দেশের মানুষকে তিনি বিশ্বাস করাতে চাইছেন যে গরিব কৃষকদের জন্যই নাকি তিনি এই আইন করেছেন। কিন্তু তাঁর পক্ষে সমস্যা হল এই নাটকীয়তা ও বাকচাতুর্য তাঁর মিথ্যাচারের স্বরূপকে ঢেকে রাখতে পারছে না।
প্রধানমন্ত্রী বলছেন এই কৃষিনীতি নাকি যুগান্তকারী, ঐতিহাসিক, তিনি নাকি এর দ্বারা সমস্ত কৃষকের লাভ দোগুণা করেই দিলেন। তাঁর রেডিও অনুষ্ঠান ‘মন কি বাত’-এ তিনি বলেছেন এই আইনের ফলে নাকি কৃষকদের দীর্ঘদিনের শৃঙ্খল মোচন ঘটেছে। সত্যিই কি তাই? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি বলবেন কৃষকদের শৃঙ্খলটি সত্যি কোথায়? সে তো পুঁজির শোষণের শৃঙ্খল।
যদিও প্রধানমন্ত্রী তা দেখতে পান না। নিচয়ই তাঁর অজানা নয় যে, কৃষককে চাষ করতে গিয়ে সার-বীজ-কীটনাশক-বিদ্যুৎ-ডিজেল ইত্যাদি কিনতে হয়। এ-সবের দাম কে নিয়ন্ত্রণ করে? বড় বড় কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এই সমস্ত কিছু। তারা যে দাম নির্ধারণ করে, কৃষক সেই দামে কিনতে বাধ্য হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কর্পোরেটরা চাষিদের ইচ্ছামত লুণ্ঠন করে। আবার ফসলের দাম নির্ধারণ করবার কোনও স্বাধীনতা কৃষকের নেই। সরকারি উদ্যোগে ফসল কেনার ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। ফলে চাষিরা বাধ্য হয় অভাবী বিক্রিতে। এখানেও বৃহৎ পুঁজির মালিক কর্পোরেট এবং তাদের দালাল ফড়েরা তাদের লুটবার সুযোগ পায়। সরকার যদি চাষির লাভ সত্যি সত্যি ‘দ্বিগুণ’ করতে চাইত তবে তো সার-কীটনাশক-বিদ্যুৎ-ডিজেল ইত্যাদি ন্যায্য মূল্যে পাওয়ার ব্যবস্থা করত। দ্বিগুণ লাভ যাতে হয় তার জন্য উপযুক্ত এবং লাভজনক দামে চাষির ফসল কিনবার যথার্থ কার্যকারী ব্যবস্থা করত। তা না করে যতটুকু সরকারি ক্রয় ব্যবস্থা আছে, তাকে, মান্ডিগুলোকে অকার্যকরী করে দেওয়ারই ব্যবস্থা হয়েছে। এতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য এমএসপি উঠে যাবে। বাস্তবে কর্পোরেটদের পায়ের তলায় চাষিদের পাকাপাকিভাবে শৃঙ্খলিত করছে এ আইন।
কেন তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষকরা এতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
তিনটি আইনের একটি হল ‘অত্যাবশ্যক পণ্য আইন’-এর সংশোধনী। চাল, ডাল, গম, ভোজ্য তেল, আলু, পেঁয়াজ আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে আবশ্যিক হলেও তা আর মোদি সরকারের চোখে ‘অত্যাবশ্যক’ থাকছে না। এই আইনের সংশোধনীতে সরকার তা বলেছে। অর্থাৎ এইসব পণ্যের দাম ও মজুত সংক্রান্ত বিষয়ে এই নতুন আইন সমস্ত নিয়ন্ত্রণ তুলে নিচ্ছে। যে যত খুশি যেমন খুশি দামে কিনতে পারে বেচতে পারে, সরকার কোনও নিয়ন্ত্রণ করবে না। শুধুমাত্র যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অস্বাভাবিক রকমের মূল্যবৃদ্ধি এবং ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা অফিশিয়াল গেজেটে নোটিফিকেশন হলে তবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। খাদ্যশস্যের দাম এক বছরে অন্তত দেড় গুণ এবং উদ্যান ফসলের দাম দ্বিগুণ না বাড়লে তাকে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হিসেবে গণ্য করা হবে না। অর্থাৎ চালের গড় দাম এ বছর ৩০ টাকা কেজি হলে আগামি বছর তা বেড়ে ৪৪ টাকা কেজি হলেও সরকারের কাছে অস্বাভাবিক বলে গণ্য হবে না। যেহেতু এই খাদ্য দ্রব্যগুলি আর অত্যাবশ্যক হিসাবে গণ্য হচ্ছে না, তাই যত খুশি মজুত করতে মজুতদারদের আর কোনও বাধা থাকছে না। মজুতদারির অবাধ সুযোগ গরিবের উপকারের জন্য করা হচ্ছে– এ উদ্ভট দাবি আমাদের বাকপটু প্রধানমন্ত্রী ছাড়া বোধ করি আর কেউ করতে পারেন না।
দ্বিতীয় আইনটি হল ‘কৃষি উৎপাদনের ব্যবসা ও বাণিজ্য (সহায়তা ও সম্প্রসারণ) আইন ২০২০’। এই আইনবলে এপিএমসি মার্কেটের বাইরে যে কোনও জায়গা থেকে ক্রেতারা চাষির উৎপাদিত পণ্য কিনতে পারবে। চাষির উৎপাদিত পণ্য বলতে চাল, গম সহ সব ধরনের দানাশস্য, সব রকম ডাল, ভোজ্য তেল ও তৈলবীজ, সবজি, ফল, মাছ, মাংস, দুধ ইত্যাদি। অর্থাৎ চাষিদের উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের প্রায় পুরোটারই বেচাকেনায় এখন থেকে আর কোনও রকম সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। ক্রেতারা সরকার নিয়ন্ত্রিত কৃষিমান্ডির বাইরে, রাজ্যের বা রাজ্যের বাইরে থেকে যত খুশি, যেখান থেকে খুশি কৃষিপণ্য কিনতে পারবে। এমনকি অনলাইনেও চলবে সেই বেচাকেনা।
অত্যাবশ্যক পণ্য আইনের সংশোধনী এবং কৃষিপণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত আইন দুটি আলাদা। তাই আলাদাভাবে পড়লে বোঝা যাবে না যে, এই দুই আইনের মধ্যে রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। প্রথম আইনের সংশোধনী এনে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের অর্থাৎ চাল, ডাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, ভোজ্য তেলের যত খুশি মজুত করার অধিকার দেওয়া হয়েছে এবং নতুন আইনটিতে যত খুশি কেনার অধিকার দেওয়া হচ্ছে। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যত খুশি কিনতে এবং যত খুশি মজুত করতে পারবে কারা। নিচয়ই কোনও ছোট বা মাঝারি ব্যবসায়ী তা পারবে না। এখন দেশি-বিদেশি কর্পোরেট হাউস এইসব কৃষিজাত পণ্য খুচরো বিক্রির ব্যবসায়ে বিপুল পুঁজি নিয়ে নেমেছে। এর মধ্যে আদানি এবং আম্বানিরা আবার নরেন্দ্র মোদি সরকারের পরিপূর্ণ মদতে দানবের আকার নিয়েছে। এটাও সংবাদে প্রকাশ যে, আদানিরা সম্প্রতি বিজেপি শাসিত হরিয়ানার পানিপথে এবং অন্যান্য রাজ্যে বিপুল পরিমাণ জমি কিনে বিশাল বিশাল গুদাম, সাইলো, হিমঘর নির্মাণ করেছে। বিশাল এবং বিপুল সংখ্যক এই গুদাম, সাইলো ও হিমঘরগুলিতে বিপুল পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য মজুত করতে এমন দুটি আইনের খুবই প্রয়োজন ছিল। আর ঠিক তখনই মোদি সরকার এই আইন দুটি এনেছে। ফলে আজ যে আওয়াজ উঠছে আদানি ও আম্বানিদের বিরুদ্ধে, তার যথার্থ যৌক্তিকতা রয়েছে। নরেন্দ্র মোদিকে সরকারি ক্ষমতায় আনতে এই দুই পুঁজিপতি গোষ্ঠী যে প্রচার, অর্থ ও সাহায্য দিয়েছে, তাদের প্রতি মোদি দায়বদ্ধ। তাই তিনি আর জনগণের ‘চৌকিদার’ না হয়ে লুঠেরা কর্পোরেট গোষ্ঠীর চৌকিদারে পরিণত হয়েছেন।
মোদিজি দেশের জনগণকে এবং কৃষকদের বিভ্রান্ত করতে বলছেন, কৃষিমান্ডি তো তুলে দেওয়া হচ্ছে না, কৃষিপণ্যের বাজারকে সম্প্রসারিত করতে মান্ডির বাইরেও কেনাবেচা করার জন্য চাষিদের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। আজ সরকারি কৃষি মান্ডি রেখে মান্ডির বাইরে যথেচ্ছ পরিমাণে ফসল কিনতে দেওয়ার মানে হল, আদানি-আম্বানিদের এজেন্টরা সরাসরি কৃষকদের কাছে গিয়ে প্রথম প্রথম একটু বেশি দাম দিয়ে পুরো ফসলই কিনে নেবে। দাম বেশি পাওয়ায় চাষিরা এদের কাছেই ফসল বেচবে। প্রথম এক-দু বছরের তথ্য বলবে, নতুন আইনের ফলে চাষি লাভবান হচ্ছে। প্রথম ছয় মাসে ‘জিও’র গ্রাহকরা এমন লাভবানই হয়েছিল। ফলে দু’বছর যদি চাষিদের কাছ থেকে একটু বেশি দাম দিয়ে সব ফসল তারা কিনে নিতে পারে তাহলে ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের যেমন ব্যবসা থেকে হটিয়ে দেওয়া যাবে তেমনি সরকারি মান্ডিগুলি শুকিয়ে বন্ধ হয়ে যাবে। বেসরকারি মান্ডি খোলার অধিকার দেওয়ায় তখন এই কর্পোরেটরাই সেই মান্ডিগুলি কিনে নেবে। ছোট ব্যবসায়ীরা হটে যাওয়ায় এবং সরকারি মান্ডি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কৃষকের তখন কর্পোরেট সংস্থাগুলির বাইরে অন্য কোথাও ফসল বিক্রির কোনও সুযোগই থাকবে না। তখন এই কর্পোরেটদের কাছেই চাষিকে হত্যে দিতে হবে। কর্পোরেট প্রভুরা দয়া করে যে দাম দেবে সেই দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হবে।
এর ভয়াবহ বিপদ শুধু কৃষকদের উপর নেমে আসবে তা নয়। সর্বস্তরের জনগণের ওপরও নেমে আসবে। বিপদ দু’দিক থেকে। প্রথমত, সর্বোচ্চ মুনাফা কামানোর জন্য প্রভাব খাটিয়ে কর্পোরেটরা কৃষকদের কম দাম দেবে। দ্বিতীয়ত, তারা খাদ্যপণ্যের উপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ইচ্ছামতো দাম বাড়াবে। এতে কৃষক, অ-কৃষক নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জীবন তীব্র মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার হয়ে যাবে। সরকারি ক্রয় ব্যবস্থার মাধ্যমে বিশেষ করে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করার সাথে দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, রেশনিং ব্যবস্থা, দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য অন্ত্যোদয়-এর মতো প্রকল্পগুলি, হাসপাতালের রোগীদের খাদ্য সরবরাহ, এমনকি পুলিশ-মিলিটারির রেশনের সরবরাহ ইত্যাদি সবকিছু সম্পর্কিত। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না থাকা এবং সরকারি মান্ডির মাধ্যমে ক্রয় ও সংগ্রহের ব্যবস্থা কর্পোরেটদের হাতে চলে গেলে দেশের রেশন ব্যবস্থাও ভেঙে পড়তে বাধ্য। দরিদ্র প্রান্তিক মানুষদের ন্যূনতম খাদ্য নিরাপত্তার প্রকল্পগুলি পরিণতিও সহজেই অনুমান করা যায়। এমনকি পুলিশ-মিলিটারির রেশন জোগানোর জন্য সরকারকে কর্পোরেটদের কাছ থেকেই কিনতে হবে। বলা বাহুল্য এর জন্য মিলিটারি বাজেট বাড়বে এবং পাল্লা দিয়ে বাড়বে জনগণের উপর ট্যাক্সের বোঝা।
চুক্তি চাষ : কৃষক মারা কল
একদিকে কৃষকদের চাষের সার-বীজ-কীটনাশক-বিদ্যুৎ ইত্যাদির জন্য কর্পোরেটদের সীমাহীন শোষণ, অন্য দিকে উৎপাদিত ফসল বিক্রির জন্য কর্পোরেট মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে চাষির আরও বেশি ঋণগ্রস্ত হওয়া ছাড়া পথ থাকবে না। আর ফসলের দাম না পাওয়া ঋণগ্রস্ত এই চাষিদের বোঝানো যাবে, ‘তোমার পছন্দের ফসল চাষ করে তো দাম পাচ্ছো না, কোম্পানির পছন্দের ফসল চুক্তিতে চাষ করো, ফসল ওঠার পর সুনিশ্চিত দাম পাবে’। তার জন্য আনা হয়েছে তৃতীয় একটি আইন-ফাঁদ– ‘ফসলের দাম নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি পরিবারের ক্ষেত্রে চাষির (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) আইন’। নাম তার যা-ই হোক না কেন সহজ কথায় এটা হল চুক্তি চাষের আইন। ‘নিশ্চিতকরণ’, ‘ক্ষমতায়ন’ বা ‘সুরক্ষা’– যে শব্দই ব্যবহার হোক, এটা ‘কৃষক মারা কল’ ছাড়া কিছু নয়।
চুক্তি চাষের আইনে বলা হয়েছে, চুক্তি হবে এক থেকে পাঁচ বছরের জন্য। চুক্তির বিষয় থাকবে উৎপাদিত পণ্য সরবরাহের সময়, পণ্যের গুণাগুণ, শ্রেণি, মান, দাম এবং এই ধরনের অন্যান্য বিষয়। এই গুণাগুণের সঙ্গে যুক্ত থাকবে ফসলে প্রয়োগ করা কীটনাশক ছত্রাকনাশকের অবশিষ্টাংশের পরিমাণ, খাদ্য সুরক্ষার মান সহ আরও বেশ কিছু বিষয়।
চুক্তি চাষের আইনেও চুক্তিকারী ক্রেতা চুক্তি করা কৃষিপণ্য যত খুশি মজুত করতে পারবে এবং সেক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক পণ্য আইনে উল্লেখিত কোনও ধারা বা সরকারি কোনও অর্ডার বা অন্য কোনও আইন সেই সব পণ্য মজুতের ঊর্ধ্বসীমার ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। এরপরও কি বলা যাবে যে এই আইন কর্পোরেটের স্বার্থে নয়?
চুক্তি এক বছর বা পাঁচ বছরের হোক, চুক্তিপত্রে ফসলের দাম ঠিক করা হবে প্রথম বছরেই। যদি পঞ্চম বর্ষে বাজারে ফসলের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়, তা হলে চাষিকে চুক্তিকারী ক্রেতা দ্বিগুণ দাম নিচয়ই দেবে না। কিন্তু বাজারে দাম কমে গেলে চুক্তি ভঙ্গ করতে তাদের এতটুকু সময় লাগবে না। চুক্তি ভঙ্গ করলে অবশ্য বিচারের জন্য সাব-ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অভিযোগ করা যাবে। কিন্তু চাষি কি ফসল ঘরে রেখে পেটে গামছা বেঁধে মহকুমা অফিস এবং জেলাশাসকের অফিসে মাসের পর মাস দৌড়াদৌড়ি করতে পারবে? অন্য দিকে চাষি চুক্তি ভঙ্গ করলে কর্পোরেট হাউস চাষিকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে বিন্দুমাত্র ছাড়বে না। আমাদের দেশের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক’জন আমলা চাষির পক্ষে দাঁড়াবে?
মোদিজি বুক ফুলিয়ে বলছেন, ‘‘বিরোধীরা চাষিদের ভুল বোঝাচ্ছে। চুক্তি হবে ফসলের বেচাকেনা নিয়ে, তা হলে ফসলের ক্রেতা কী করে জমি ছিনিয়ে নেবে?” নরেন্দ্র মোদি কি জানেন না, কী করে চাষিরা ভূমিহীন হয়ে যায়? তারা কি কারও সাথে ভূমিহীন হওয়ার জন্য চুক্তি করে ভূমিহীন হয়েছে? তবুও ভূমিহীন হয় কেন তা জানতে তো বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না!
ফলে চুক্তি চাষে চাষি লাভবান হবে বলে যে জোর প্রচার প্রধানমন্ত্রী করে চলেছেন তা উপরোক্ত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক কথাগুলিকে বাদ দিয়েই। নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য, ‘‘কর্পোরেটকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করো।” এই কর্পোরেটরাই ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে বছরের পর বছর শোধ না করে ফেলে রাখে। মুনাফার পাহাড় জমিয়ে বিশ্বের সেরা ধনীদের তালিকায় তাদের নাম ওঠা সত্ত্বেও ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া ঋণ শোধ করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ তারা দেখায় না। তাদের বন্ধু সরকার সেই সব ঋণ মকুব করে দেয়। দেশের দরিদ্র জনসাধারণকে তার বোঝা বইতে হয়। কেউ কেউ সেসব শোধ না করে দেশ ছেড়ে চলেও যায়। মুনাফালোভী সেইসব কর্পোরেট হাঙররা কি চাষিকে ঠকাবে না? হাত-পা বেঁধে দেশের কৃষকদের সেই মুনাফা-শিকারি হাঙরদের মুখে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির মতো তাকতদার প্রধানমন্ত্রীও যাদের দেশে ফেরাতে পারছেন না, সেই কর্পোরেটের সঙ্গে লড়বে হাত-পা বাঁধা হতদরিদ্র চাষি!
চুক্তি চাষের আইনে রয়েছে আরও একটি কালা বিধান। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এই কৃষি-আইনে বাস্তবে রাজ্য সরকারের হাতে কোনও ক্ষমতাই থাকবে না। আইনের চতুর্থ অধ্যায়ে ১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার যেমন প্রয়োজন মনে করবে, বিভিন্ন সময়ে রাজ্য সরকারকে নীতি-নির্ধারণের তেমন নির্দেশ দেবে এবং রাজ্য সরকারগুলি সেই নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য থাকবে ।
শুধু তাই নয়, এই আইন বা নির্দেশ সংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার, চুক্তিচাষের রেজিস্ট্রেশন অথরিটি, চুক্তি চাষে বিবাদ মেটানোর জন্য গঠিত মহকুমা কর্তৃপক্ষ বা তার দ্বারা গঠিত কোনও কর্তৃপক্ষ বা কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনও রকম মামলা বা আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। এখানেই শেষ নয়। কোনও দেওয়ানি আদালতের ক্ষমতা থাকবে না এই সংক্রান্ত বিবাদে কোনও মামলা গ্রহণ করার বা ইনজাংকশন জারি করার। চাষি এবং ক্রেতার মধ্যে বিবাদ মেটানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের মর্জি এবং আমলাদের হাতে সব কিছু ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এই আইনে।
এই তিনটি কালা কৃষি-আইনের সাথে সরকারের বর্তমান গণবণ্টন ব্যবস্থার নীতিকে একসঙ্গে নিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, নতুন এই কৃষি আইনগুলির উদ্দেশ্য হল, খাদ্য সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যকে পুরোপুরি বহুজাতিক পুঁজির হাতে তুলে দেওয়া। তার ফলে রেশন ব্যবস্থা, যা কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় তুলে দিতেই বসেছে, তা আরও ভেঙে পড়বে। সেই সুযোগে কর্পোরেটরা একদিকে জলের দরে কৃষকের ফসল কিনবে এবং অন্য দিকে অগ্নিমূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে যথেচ্ছ মুনাফা লুটবে। আজ এর জ্বালা বুঝতে পারছেন কৃষকরা, বুঝছেন সাধারণ মানুষও। তাই কোনও মিষ্টি কথায় কৃষকদের অন্য কিছু বোঝানো সম্ভব হচ্ছে না, সাধারণ মানুষকেও বিভ্রান্ত করা যাচ্ছে না। (চলবে)