নবম আলোচনাটিও ব্যর্থ হল। অবশ্য ব্যর্থ হওয়ারই কথা ছিল। কারণ কৃষকদের সাথে আলোচনায় সরকার কখনওই আন্তরিক ছিল না। একদিকে যখন মন্ত্রীরা কৃষক-নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, তখনই দেখা যাচ্ছে, যে বাস-মালিকরা কৃষকদের অবস্থানে যোগ দেওয়ার জন্য বাস দিয়েছিলেন, তাঁদের ভয় পাইয়ে দিতে গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ-কে দিয়ে সরকার সন্ত্রাসবাদ বিরোধী ধারায় মামলা করেছে। শহিদ কৃষক পরিবারগুলিকে যাঁরা সাহায্য করছেন, সরকার কোনও রকম গণতান্ত্রিক রীতিনীতির তোয়াক্কা না করে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছে। হরিয়ানায় মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর ‘অপরাধে’ ৯০০ জনের বিরুদ্ধে হত্যার চেষ্টার মামলা করেছে বিজেপি সরকারের পুলিশ। অন্য দিকে কৃষকরা বারবার কৃষি আইনের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চাওয়া সত্তে্বও সরকার সুপ্রিম কোর্টকে দিয়ে একটি কমিশন গঠন করে দিয়েছে। এই কমিটিতে রয়েছেন এমন সব ব্যক্তিরা যাঁরা ঘোষিত ভাবেই সরকারের কৃষি আইনের সমর্থক। এই রকম পরিস্থিতিতে এ দিনের আলোচনায় স্বাভাবিক ভাবেই সরকার পক্ষের কোনও নমনীয়তা কৃষক নেতারা দেখতে পাননি। তাঁরা ২৬ জানুয়ারিকে কৃষক প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে ঘোষণা করে সেদিন ট্রাক্টর নিয়ে দিল্লি অভিযানের ডাক দিয়েছেন। দিল্লি সহ পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে তারই জোর প্রস্তুতি চলছে।
অনন্য এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন
যে অসীম বীরত্বের সাথে দিল্লিতে কৃষকরা সংগ্রাম করছেন, ভারতের গণআন্দোলনের ইতিহাসে বোধকরি তার তুলনা নেই। শৌর্যে, বীর্যে, মহত্ত্বে, আত্মবলিদানের গৌরবে এই সংগ্রাম অনন্য। বিজেপি সরকার ভেবেছিল, বশংবদ মিডিয়ার প্রচারের জোরে তারা মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করতে পারবে, করোনার এই দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে তারা এই কথা কৃষকদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে পারবে যে, যা করা হচ্ছে তা কৃষকদের স্বার্থেই করা হচ্ছে। কিন্তু পরিকল্পনা ওদের সফল হয়নি। কৃষকরা ওদের চালাকি ধরে ফেলেছেন।
কৃষকরা এতটা মরিয়া, এতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠবে এ কথা বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার ভাবতে পারেনি। তারা মনে করেছিল প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কৃষকরা দুই এক দিনের বেশি থাকতে পারবে না। শীতের কামড় সহ্য করে খোলা আকাশের নিচে বসে থেকে থেকে হতাশ হয়ে ওরা ঘরে ফিরে যাবে। এই জন্য ওরা কালহরণের কৌশল নিয়েছিল। ওরা কৃষকদের আলোচনায় ডেকেছে, আইনের নানা সংশোধনীর প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু কৃষকরা বরাবরই পাল্টা বলেছেন– কোনও সংশোধনীতে কাজ হবে না। আইনের উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের আপত্তি। এই আইন আম্বানি, আদানি প্রমুখ করপোরেটদের স্বার্থে রচিত হয়েছে। এই আইনে কৃষকদের সর্বনাশ হবে। এই আইন সংশোধন করে কৃষকদের স্বার্থবাহী করা কখনওই সম্ভব নয়। তাই সংশোধন বা সংস্কার নয় একে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করতে হবে।
বিজেপি সরকারের নিত্যনতুন কৌশল
বিজেপি সরকারের এই কাল হরণের মতলব সফল হল না। অষ্টম রাউন্ডের বৈঠকে তারা তাই তূণীর থেকে বের করে অন্য অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। কৃষিমন্ত্রী তোমর বললেন, আসুন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আমরা মেনে নেব– এই প্রশ্নে আমরা একমত হই। সরকার সরাসরি ‘সুপ্রিম কোর্ট’ তাস খেলে আন্দোলনকারী কৃষকদের হতোদ্যম করতে চাইল। কৃষকদের জবাব ছিল– কোনও আইনি প্রশ্ন নিয়ে তারা এতদিন ধরে সংগ্রাম করছেন না। তাঁরা সংগ্রাম করছেন তাঁদের রুটি-রুজি জীবন-জীবিকার জন্য, তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং এই কারণেই তারা এই সব আইনের প্রত্যাহার চাইছেন। তাঁরা কোনও কোর্টে যাননি এবং যাওয়ার কোনও ইচ্ছাও তাঁদের নেই। মধ্যস্থতাকারী হিসাবে সুপ্রিম কোর্টকে গ্রহণ করার কোনও পরিকল্পনাও তাদের নেই। তারা সরকারের কাছে এসেছেন এবং তারা আশা করেন, জনমতের প্রতি উপযুক্ত সম্মান দেখিয়ে সরকার এই আইন প্রত্যাহার করে নেবে।
সত্য হল সাম্প্রতিক অতীতে নানা ভূমিকা দেখে জনমনে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। জনমনে এই বিশ্বাস ক্রমাগত গভীরতর হচ্ছে যে, দেশের কানুনি ব্যবস্থা শাসক দল ও কর্পোরেটদের স্বার্থরক্ষাকারী ছাড়া কিছু নয়। কর্পোরেটদের স্বার্থ রক্ষা করাই আদালতের কাজ। এই কারণে আন্দোলনের ময়দানে এই আওয়াজ ক্রমাগত জোরদার হয়েছে, কোর্ট যে রায় দিক না কেন, দাবি না মেটা পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। এর কোনও নড়চড় হবে না।
বহু দিক দিয়েই এই আন্দোলন অনন্য
কৃষকবিরোধী আইনগুলি প্রণয়নের উদ্দেশ্য যে কর্পোরেট প্রভুদের স্বার্থ রক্ষা করা, সেটা এই আন্দোলন যেমন পরিষ্কার করে দিয়েছে, তেমনই অতীতে এ দেশে কখনও যা দেখা যায়নি, বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্তে্রর অন্যতম স্তম্ভ আইনি ব্যবস্থা যে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে না, এই অনুভবও এই আন্দোলনের একটা বড় প্রাপ্তি।
অনেকের মনেই আশঙ্কা ছিল– সুপ্রিম কোর্ট যদি আন্দোলনের বিপক্ষে রায় দেয় তা হলে কী হবে? ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষক বিরোধী এই আইনগুলিকে তারা বাতিল করছেন না, স্থগিত রাখছেন। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি কমিটি ঠিক করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। পরিহাসের বিষয় হল, সেই কমিটির চারজন সদস্যের চারজনই হলেন আপাদমস্তক কর্পোরেটপন্থী। যারা শুধু এই তিনটি আইন সমর্থন করেন তাই নয়, আইনে কোনওরকম পরিবর্তন না করেই এগুলিকে কার্যকরী করার পক্ষপাতী। কৃষকরা আগেই বলে দিয়েছেন, কোনও কমিটির কাছে তাঁরা যাবেন না। সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার করে দিয়েছে যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও তার সরকারের সাথে সুপ্রিম কোর্টের গলাগলি সম্পর্ক। সরকারের সাথে জনগণের লড়াইয়ে কোর্টের কাছ থেকে জনস্বার্থে নিরপেক্ষ ন্যায় বিচার আজ আর আশা করা যায় না।
এ কারণেই কৃষকরা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ২৬ জানুয়ারি লক্ষ লক্ষ ট্রাক্টর নিয়ে কৃষকরা দিল্লির বুকে তাদের প্রজাতন্ত্র দিবস পালন করবেন। দেশের সমস্ত রাজ্যে সেদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নামবেন। সংগ্রামের এক নতুন অধ্যায় সেদিন রচিত হবে।
এই আন্দোলন এখন দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্রের সশস্ত্র দমন-যন্ত্রের মুখোমুখি। যে কোনও মুহূর্তে রাষ্ট্রশক্তি এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সব কিছু সত্ত্বেও সংগ্রামী কৃষকরা তাদের ক্ষমতার শেষ বিন্দু দিয়ে লড়ছেন এবং লড়বেন। এই লড়াইয়ে তাঁদের পাশে আছে দুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষের সমর্থন। আছে ছাত্র-যুব-কন্যা-জায়া-জননীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ।
তিনটি কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলন যে এই ধরনের গতি ও মাত্রা পেতে পারে তা বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকার ভাবতে পারেনি। তারা জানত, কংগ্রেস সহ সংসদীয় জাতীয় এবং আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলো যেহেতু পুঁজিপতিদের স্বার্থেরই রক্ষক, তারা বড়জোর কৃষকদের হয়ে কিছুদিন চিৎকার করে কৃষক স্বার্থের চ্যাম্পিয়ন সাজবে এবং ভোটের পুঁজি সঞ্চয় করা হয়ে গেলে আন্দোলনে ক্ষান্তি দেবে। বাস্তবে তাদের হিসেবে কোনও ভুল ছিল না। দেখা গেল, এই দলগুলি সংসদে কৃষি আইন পাস করানোর সময় দু-চার দিন একটু হইচই করে চুপ করে গেল। আন্দোলনের আর কোনও কর্মসূচি তারা নিল না। কিন্তু শাসকদের কাছে খবর ছিল না যে শ্রমজীবী মানুষের জীবন সংগ্রাম এবং তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাকে অনেক কিছু শিখতে সাহায্য করে। জীবনের সেই যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কৃষকরা ভালোমতোই উপলব্ধি করতে পেরেছেন বেসরকারিকরণের উপকারিতা সরকারগুলো কেন এত বেশি প্রচার করে। তাঁরা অভিজ্ঞতা থেকেই দেখতে পেয়েছেন সরকারি সম্পত্তির বেসরকারিকরণের নামে পুঁজিপতিদের মধ্যে বিলিবন্টন করে দিয়ে গদিতে আসীন নেতা-মন্ত্রীরা আসলে তাদের প্রভুদের সুযোগ করে দেন জনগণকে অবাধে লুঠবার। বেসরকারিকরণ মানে জনগণের সর্বনাশ আর কর্পোরেট পুঁজির পৌষমাস। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই এই হল জনগণের বাস্তব অভিজ্ঞতা। কৃষিক্ষেত্রেও কৃষকরা দেখছেন সার-বীজ বেসরকারি হাতে চলে যাবার পর এগুলির দাম কেমন লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। কেমন ভাবে এক ধাক্কায় চাষের খরচ বেড়েছে বহু গুণ। আর এই বাড়তি খরচ মেটাতে তাদের কেমনভাবে সুদখোর মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার করতে হয়েছে। এই দেনার দায় মেটাতে হচ্ছে কৃষককে তার জীবন দিয়ে। প্রতি ১২ মিনিটে আমাদের দেশে একজন কৃষককে ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করতে হয়। এই হল পুঁজির নিগড়ে বাঁধা আমাদের দেশের কৃষি অর্থনীতির বাস্তব চিত্র।
কৃষকরা যখন দেখলেন যতটুকু সরকারি ব্যবস্থা ফসল ক্রয়ে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে এখনও এদেশে বেঁচে-বর্তে আছে, বিজেপি সরকারের এই নতুন কৃষি আইন তাকে সমূলে উৎখাত করবে। অবাধে লুণ্ঠন চালানোর জন্য পুরো কৃষিক্ষেত্র এবং কৃষক সমাজকে কর্পোরেটদের হাতে পুরোপুরি সঁপে দেওয়া হচ্ছে, সরকার জেনে-বুঝেই ইতিমধ্যেই বিপর্যস্ত কৃষকদের চরম সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে– তখন তাদের পক্ষে আর স্থির থাকা সম্ভব হল না। লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া তাদের কোনও বিকল্প থাকল না। কৃষকদের এই সংগ্রামী মেজাজের জন্যই ছোট-বড় সমস্ত কৃষক সংগঠনগুলিরও বিকল্প ছিল না এই আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে সামিল হওয়া ছাড়া। সারা দেশে ছোট-বড় নানা মত ও পথের প্রায় ৫০০-র কাছাকাছি কৃষক সংগঠন আজ তাই এই আন্দোলনে সামিল। এই আন্দোলন দেখিয়ে দিয়েছে ঐক্যবদ্ধ জনসাধারণ কতখানি শক্তি ধারণ করে। তারা অজ্ঞ থাকলে, পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে শাসকরা তাদের নিয়ে যেমন খুশি খেলতে পারে, আর ঐক্যবদ্ধ হলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে তারা উদ্ধত শাসকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতেও পারে। তখন জাতপাত সাম্প্রদায়িকতার বিভেদের রাজনীতি যা শাসকের হাতের অস্ত্র, সেগুলি সব ভোঁতা এবং অকার্যকরী হয়ে যায়। যেভাবে দিল্লির রাজপথে হিন্দু-মুসলমান জৈন খ্রিস্টান উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ মানুষ এক সংগ্রামী চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে আজ প্রায় দু’মাস ধরে দৃঢ়তার সাথে লড়াই করে যাচ্ছেন, তাতে এই সহজ সত্য তাদের কাছে সহজভাবেই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে যে ধর্ম বা জাতপাত তাদের জীবনের কোনও সমস্যাই নয়। জাত ধর্ম যাই হোক তাদের সকলের জীবনের মূল সমস্যা শোষণ-শাসন ও প্রতারণা এবং অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কাজ না পাওয়া।
সর্বনাশা কৃষি আইন নিয়ে আলোচনা চাননি নরেন্দ্র মোদিরা
জুন মাসে করোনা জনিত আর্থিক সংকট মোকাবিলার জন্য ২০ লক্ষ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কিন্তু দেশের শিল্পপতি পুঁজিপতিদের সুরাহার জন্য। করোনা পরিস্থিতিতে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়া কৃষকদের কোনও কিছুই সুবিধা না দিয়ে মোদি সরকার হঠাৎ অর্ডিন্যান্স জারি করে তিনটি ব্যবস্থা চালু করে দেয়। তারপর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সংসদের স্বল্পকালীন অধিবেশনে জনবিরোধী পরিকল্পনাগুলিকে আইনে রূপান্তরিত করতে যখন তারা অতি তৎপর তখন কোনও আলোচনা ছাড়াই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে লোকসভায় তিনটি বিলই পাস করিয়ে আইন করে দিয়েছে। রাজ্যসভায় বাস্তবে কারচুপি করেই আইনগুলি ধ্বনি ভোটে পাস বলে তারা ঘোষণা করেছে। এর বিরুদ্ধে তখনই সারা দেশে প্রবল প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু সরকার তাতে কান দেয়নি। ২৫ সেপ্টেম্বর গ্রামীণ ভারত বনধ হয়েছে। ১৪ অক্টোবর সারা ভারত প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়েছে। পাঞ্জাবে দু’মাস লাগাতার ট্রেন অবরোধ হয়েছে। সারা দেশে সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য সভা, মিছিল, ধরনা। সেপ্টেম্বর মাসেই কৃষক সংগঠনগুলির ২৬-২৭ নভেম্বর দিল্লি অভিযানের কর্মসূচি পালন করেছে। কিন্তু এত প্রতিবাদ সত্ত্বেও সরকার কারও সাথে কোনও রকম আলোচনার উদ্যোগ না নিয়ে তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করার কৌশল নিয়েছে।
আন্দোলনে যুক্ত সারা দেশের চাষিরা
যখন পাঞ্জাব হরিয়ানাতে আন্দোলনের তীব্রতা বেশি দেখা দিতে লাগল, তখন মন্ত্রীরা বলতে শুরু করলেন যে সারা দেশের কৃষকদের এই আইন নিয়ে কোনো অসুবিধে নেই শুধু পাঞ্জাবের কিছু বৃহৎ কৃষক এই আন্দোলন করছে। অত্যন্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তোলা এই প্রচারটা যে সম্পূর্ণ মিথ্যা এ কথা সরকারপক্ষই সবচেয়ে ভালো করে জানে। বাস্তবে অবস্থাপন্ন কৃষক, মাঝারি ও প্রান্তিক কৃষক, ভূমিহীন খেতমজুর– সকলেই এই কৃষিনীতিতে উদ্বিগ্ন। সকলেই কর্পোরেটদের আগ্রাসনের মুখে। ফলে অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই তারা এই আন্দোলনে সামিল। এ কথা ঠিক, শুরুর দিকে পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকরাই ব্যাপক সংখ্যায় আন্দোলনে ছিলেন। কিন্তু সরকারের অনড় মনোভাবের কারণে এই আন্দোলনের তীব্রতা সারা দেশে বাড়ছে। শুধু দিল্লির রাজপথে নয়, সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকশো কৃষক সংগঠনের যুক্ত মঞ্চ সংযুক্ত কিসান মোর্চা (এস কে এম)-এর শরিক সংগঠনগুলি, বিশেষ করে এ আই কে কে এম এস সারা দেশে প্রায় সমস্ত রাজ্যে প্রচার বিক্ষোভ অনশন অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছে। এখন রাজস্থান থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, বিহার, পিচমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, কেরালা, কর্ণাটক ইত্যাদি প্রায় সমস্ত রাজ্য থেকে কৃষকরা যেমন আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন তেমনই এই আন্দোলনের সমর্থনে প্রতিটি রাজ্যের কৃষক ও জনসাধারণ সর্বত্র অসংখ্য ধরনা মঞ্চ , সভা, অবস্থান, মিছিল, প্রচার, অনশন ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছেন এবং তা দিন দিন বাড়ছে। কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষক সংগঠনগুলির ডাকে গ্রামীণ ভারত বনধ হয়েছিল। দু’বার সাধারণ ধর্মঘট হয়েছে। কয়েক কোটি মানুষ ধর্মঘট সফল করতে সক্রিয় ভাবে সামিল হয়েছে। দেশের শ্রমিক-কর্মচারীরা শুধু নয়, আন্দোলনের পাশে দাঁড়িয়েছেন ছাত্র-যুব-মহিলারাও। অভিনেতা থেকে গায়ক ক্রিকেটার শিল্পী সাহিত্যিক ক্রীড়াবিদ সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন প্রকাশ্যে। বহু বিশিষ্ট মানুষ তাদের পদক খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। কৃষক অন্নদাতা, সে আজ বিপন্ন– এ কথা উপলব্ধি করে সমাজের সমস্ত অংশের মানুষ আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা আন্দোলনকারীদের অর্থ এবং বেঁচে থাকার রসদ জোগাচ্ছেন। চিকিৎসকরা দিচ্ছেন স্বেচ্ছায় চিকিৎসা পরিষেবা। সকল স্তরের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে এই আন্দোলন এখন যথার্থ অর্থে সর্বভারতীয় রূপ ধারণ করেছে ।
বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এ জিনিস ছিল অপ্রত্যাশিত। গোড়া থেকেই তারা কৃষকদের আন্দোলনের শক্তিকে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখেছে। অনায়াসে তাকে দমন করা যাবে এমনই ভেবেছে। সে মতোই ২৬-২৭ নভেম্বরের দিল্লি অভিযান বানচাল করার জন্য তারা পরিকল্পনা করেছিল যে, বিজেপি শাসিত হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশের প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে দিল্লি অভিমুখে আসা আন্দোলনকারী কৃষকদের রাস্তাতেই আটকে দেওয়া হবে, দিল্লি অবধি পৌঁছতেই পারবে না তারা। সেই পরিকল্পনা মতো হরিয়ানার বিজেপি সরকার রাস্তার উপর বড় বড় বোল্ডার ফেলেছে, রাস্তা কেটে দিয়েছে, কংক্রিটের ব্যারিকেড তৈরি করেছে, লাঠিপেটা করে কৃষকদের রক্তাক্ত করেছে, টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে, জলকামান ব্যবহার করেছে। কিন্তু কৃষকদের সাথে আলোচনা করার, তাদের কথা শোনার ইচ্ছা তাদের কখনওই জাগেনি। কৃষকরা ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেছেন, বোল্ডারের প্রাচীর সরিয়ে দিয়েছেন, সরকারের ভেঙে দেওয়া রাস্তাকে চলাচলের যোগ্য করে নিয়েছেন, লাঠি টিয়ার গ্যাস, জলকামান অগ্রাহ্য করে অপ্রতিরোধ্য তারা এগিয়ে এসেছেন দিল্লি অভিমুখে। শেষপর্যন্ত হাজির হয়েছেন দিল্লির উপকণ্ঠে।
এতে প্রবল আক্রোশে বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের আইটি সেল পাঞ্জাব থেকে আসা আন্দোলনকারী কৃষকদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ‘দেশদ্রোহী’, ‘পাকিস্তানি’, ‘সন্ত্রাসবাদী’ ইত্যাদি হিংসা ও শত্রুতামূলক শব্দগুলি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে। তাদের উদ্দেশ্যসাধনে বাজিমাত করবার এই বিষাক্ত অস্ত্রগুলি যে ভোঁতা হয়ে গিয়েছে বিজেপি নেতারা আগে তা টেরও পাননি। কৃষক আন্দোলন তা টের পাইয়ে দিল।
বিজেপির এই অপপ্রয়াসকে পরাস্ত করে আজ সিংঘু, টিকরি, গাজিপুর, শাহজাহানপুর বর্ডারগুলি হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-আস্তিক-নাস্তিক সকলের মহামিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সৌজন্যে। (চলবে)