Breaking News

দিল্লিতে বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে স্পষ্টপাশ-ফেল প্রথা বিলোপ সরকারি শিক্ষাকে দুর্বল করেছে

১৫ বছর আগে ‘শিক্ষার অধিকার আইন– ২০০৯’ গালভরা নাম দিয়ে দেশ জুড়ে একটি সর্বনাশা নীতি চালু করা হয়েছিল। সেই আইন অনুসারে, যে কোনও শিশু বা বালক-বালিকা তার বয়স অনুসারে নির্দিষ্ট শ্রেণিতে ভর্তি হবে এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কোনও পাশফেল থাকবে না। কোনও বিদ্যালয় কোনও ছাত্র বা ছাত্রীকে অটোমেটিক প্রোমোশন না দিলে, উক্ত আইন অনুসারে সেই বিদ্যালয় বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-শিক্ষিকা উক্ত ছাত্র বা ছাত্রীটির শিক্ষার অধিকারে ‘বাধা’ দিয়েছে ধরে নিয় তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।

পাশফেল বিলোপের পক্ষে উক্ত মতের প্রবক্তাদের একটি প্রিয় যুক্তি হল, পাশফেল থাকলে ড্রপ-আউট বৃদ্ধি পায়, বাবা-মায়েরা আর তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে না পাঠিয়ে ছেলেদের কাজ করতে পাঠিয়ে দেয়, মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয় ইত্যাদি। দেশে সরকার বদলেছে, রাজ্যে রাজ্যে সরকার বদলেছে, কিন্তু এই আইন বলবৎ রেখে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ‘বামফ্রন্ট সরকার’ বিগত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুতেই প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার পাশাপাশি পাশফেল প্রথাও বিসর্জন দিয়েছিল। এর ফলে বাংলা সহ অন্যান্য বিষয়েও ছাত্রছাত্রীরা দুর্বল হতে থাকে। দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে ইংরেজি ফিরিয়ে আনা হলেও, পাশফেল প্রথা চালু করা হয়নি। ফলে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্জলি যাত্রা অব্যাহত থাকে। ২০০৯ সাল থেকে সেই পাশফেল প্রথা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তুলে দেওয়া হল। এর ফল কী দাঁড়িয়েছে? ২০১৩-১৪ সাল নাগাদ সরকার নিযুক্ত বিভিন্ন কমিটি তাদের রিপোর্টে ‘অটোমেটিক প্রোমোশনের’ কুফলের কথা তুলে ধরে। দেখা যায়, সরকারি বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণির ৬০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই প্রথম শ্রেণির বই পড়তে পারছে না (হরিয়ানার শিক্ষামন্ত্রী গীতা ভুক্কলের নেতৃত্বাধীন সিএবিই কমিটির রিপোর্ট, ২০১৪)। কিন্তু ‘ড্রপ-আউটের’ কথা বলে পাশফেল প্রথাকে সরিয়েই রাখা হয়েছে।

অন্যান্য রাজ্যের মতো দিল্লিতেও সরকার পাশফেল প্রথা তুলে দিয়েছিল। শীলা দীক্ষিতের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকারের পর ২০১৩ সাল থেকে দিল্লিতে আম আদমি পার্টির সরকার রয়েছে। তারাও দিল্লিতে ‘নো-ডিটেনশন’ নীতি বলবৎ রাখে, যেমন এই রাজ্যেও তৃণমূল কংগ্রেস ২০১১ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকলেও পাশফেল ফিরিয়ে আনেনি। দিল্লি বা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন আম আদমি পার্টি বা তৃণমূল কংগ্রেস, কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে নানা সময়ে হুঙ্কার ছাড়লেও তারা এই ‘সর্বনাশা নীতি’কে বলবৎ রেখেছে।

২০২২ সালে তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়নের জন্য একটি নির্দেশিকা জারি করে দিল্লির আপ সরকার। সেই নির্দেশিকা অনুসারে, ছাত্রছাত্রীদের প্রতিটি বিষয়ে ৩৩ শতাংশ নম্বর পেতে হবে এবং ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষায় সামগ্রিকভাবে অন্ততঃ ২৫ শতাংশ নম্বর পেতে হবে। প্রতিটি বিষয়ে ১০০ পূর্ণমানকে ভাগ করা হয়– উপস্থিতির জন্য ৫ নম্বর, বিষয় উৎকর্ষের জন্য ৫ নম্বর, প্রজেক্টের জন্য ৫ নম্বর, সহ-শিক্ষামূলক কার্যক্রমের জন্য ৫ নম্বর, মাল্টিপল অ্যাসেসমেন্টের জন্য ৫ নম্বর, ইউনিট টেস্টের জন্য ৫ নম্বর, অর্ধবার্ষিক মূল্যায়নের জন্য ২০ নম্বর এবং বার্ষিক মূল্যায়নের জন্য ৫০ নম্বর।

দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মনীশ শিশোদিয়ার মতে, ‘নো-ডিটেনশন নীতি’ খুবই প্রগতিশীল ছিল, কিন্তু উপযুক্ত প্রস্তুতির অভাবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেনি।

কিন্তু এর ফল কী দাঁড়াল? এই বছরে (২০২৩-২৪) অষ্টম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে ২০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী অর্থাৎ মোট ২ লক্ষ ৩৪ হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৪৬,৬৬২ জন যোগ্যতামান পেরোতে পারেনি। গত বছরেই দিল্লি সরকার ঘোষণা করেছিল ৫ম এবং ৮ম শ্রেণিতে পরীক্ষার পাশাপাশি পাশফেলও থাকবে। এর পরেই এই বছরের এই চিত্রটি সামনে এল। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? এই অনুত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীরা এতদিন অটোমেটিক প্রোমোশন পেয়ে এসেছে। পাশফেল না থাকায় পড়াশোনার সেই তাগিদটাই ছিল না। ফলে তাদের শিক্ষার বুনিয়াদটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে। আজ তারা নো-ডিটেনশন নীতির কুফল ভোগ করছে।

সুতরাং, দিল্লির সরকার যতই ঝাঁ-চকচকে স্কুল তৈরি করুক না কেন, শিক্ষাদানের পদ্ধতিটাই যদি ত্রুটিপূর্ণ হয় তার ফলাফল খারাপই হবে। আজ দিল্লির মতো একটা ছোট রাজ্যে একটি শ্রেণি থেকে পরের শ্রেণিতে উঠতে গিয়ে যদি ৪৬ হাজার ছাত্রছাত্রী অনুত্তীর্ণ হয়, তবে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার বেহাল দশা কতটা সেটা বোঝাই যাচ্ছে। আর সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা যতই ডুববে, ততই বেসরকারি স্কুল রমরমিয়ে উঠবে। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার অপমৃত্যুর জন্য ভাগাড়ের শকুনের মতো কর্পোরেট পুঁজি অপেক্ষা করছে।