![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2022/08/1-Delhi_Red-Selute-of-Com-PG-150x84.jpg)
এ বারের ৫ আগস্ট ছিল ভারতের একমাত্র যথার্থ বিপ্লবী দল এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-এর প্রতিষ্ঠাতা, এ যুগের অন্যতম মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষের শততম জন্মদিন। তাই দেশ জুড়ে দিনটি ভাস্বর হয়ে উঠল মহান নেতার বর্ষব্যাপী জন্মশতবর্ষ উদযাপনে সূচনার আবেগময় নানা অনুষ্ঠানে। হাজার হাজার বছর ধরে মানবসমাজে গেড়ে বসে থাকা অসাম্যের শিকড় উপড়ে নিপীড়িত জনতাকে শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্ত করার তাগিদ থেকে তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বোচ্চ উপলব্ধির ভিত্তিতে আমাদের সামনে ভারতের এবং একই সাথে বিশ্ববিপ্লবের যুগোপযোগী দিকনির্দেশিকা রেখে গিয়েছেন। দিয়ে গিয়েছেন সত্যিকারের উন্নত জীবনবোধের সন্ধান। এ দেশের মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ভারতের একমাত্র যথার্থ বিপ্লবী দল এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)-কে।
![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2022/08/4-Delhi-exi-open-scaled-e1660318341112-106x150.jpg)
জন্মশতবর্ষের মূল অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল দিল্লিতে পার্লামেন্ট ভবন থেকে সামান্য দূরে ঐতিহাসিক সভাগৃহ পেয়ারিলাল ভবনে। এই উপলক্ষে সেজে উঠেছিল সমগ্র ভবন ও লাগোয়া এলাকা। মূল ফটকে সুদৃশ্য তোরণ, ভেতরের বিস্তীর্ণ জায়গার একদিকে কমরেড শিবদাস ঘোষের উদ্ধৃতি প্রদর্শনী, আর একদিক জুড়ে তাঁর জীবনের নানা মুহূর্তের আলোকচিত্রের কোলাজ। মাঝখানে দীর্ঘ লনের শেষ প্রান্তে স্থাপিত মঞ্চে উদ্বোধনের আয়োজন। হলের মূল মঞ্চে সভার প্রস্তুতি।
সকাল থেকেই দিল্লি ও আসপাশের রাজ্য থেকে আসা মানুষে মানুষে জনাকীর্ণ ভবন চত্বর। প্রদর্শনীর সামনে কথা হচ্ছিল উত্তরাখণ্ড থেকে আসা দুই বন্ধু বিএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সন্তোষ ও ভীমের সাথে। পরীক্ষার মাঝেই তাঁরা এসেছেন। কেন? ‘এক দাদার কাছ থেকে শিবদাস ঘোষের দুটো বই পড়েছি। কথাগুলো নাড়িয়ে দেয়। অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিতে দু’দিন এসে পরীক্ষার জন্য ফিরে গিয়েছিলাম। মন টিকল না। এমন মানুষের শতবর্ষের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার চেয়ে আমার কাছে আর মূল্যবান কী হতে পারে?’
রাজস্থানের পিলানী থেকে বৃদ্ধ বয়সে অশক্ত শরীরে ছেলের সাথে এসেছেন এক সমর্থক। বাড়িতে অসুস্থ বৃদ্ধা স্ত্রী একা। কিসের টানে? ‘কর্মসূত্রে আমি বন্দর-কর্মী ছিলাম। সেই সূত্রে ওখানে মানুষের জীবন দেখে কমরেড শিবদাস ঘোষের বিশ্লেষণ কতটা সঠিক আমি বুঝেছি। উনি যেন ভবিষ্যৎ বুঝতে পারতেন! এমন একটা দিনে আর একটু সুস্থ থাকলে তো স্ত্রীকেও সঙ্গে আনতাম।’
পূর্ব কর্মসূচির ঘোষণা অনুযায়ী বেলা ১১টায় উদ্বোধন। প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ। উপস্থিত হলেন দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ, বর্ষীয়ান পলিটবুরো সদস্য ও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, সভাপতি কমরেড সত্যবান সহ কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটবুরোর অন্যান্য সদস্যরা। কমরেড প্রভাস ঘোষ রক্তপতাকা উত্তোলন, কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতিকৃতিতে মাল্যদান এবং প্রদর্শনী উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বর্ষব্যাপী কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন। মাল্যদান করলেন দলের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন রাজ্য নেতৃবৃন্দ। শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুব, মহিলা ফ্রন্টের সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দও মাল্যদান করেন। কিশোর কমিউনিস্ট বাহিনী ‘কমসোমল’ কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতিকৃতিতে গার্ড অফ অনার প্রদর্শন করে।
ইতিমধ্যে সেজে উঠেছে হলের ভিতরের মঞ্চ। একে একে আসন গ্রহণ করেছেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ, পলিটবুরোর সদস্য কমরেড অসিত ভট্টাচার্য, কমরেড সত্যবান, কমরেড সৌমেন বসু, কমরেড স্বপন ঘোষ, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড কে শ্রীধর, কমরেড শঙ্কর ঘোষ, কমরেড অশোক সামন্ত, কমরেড দেবাশীষ রায়, কমরেড স্বপন চ্যাটার্জী ও কমরেড প্রতাপ সামল। কমরেড শিবদাস ঘোষ স্মরণে রচিত সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সভা। বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির প্রেরিত বার্তা পাঠ করেন কমরেড কে শ্রীধর।
প্রধান বক্তা কমরেড অসিত ভট্টাচার্য তাঁর আবেগমথিত আলোচনায় কমরেড শিবদাস ঘোষের স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীন ধারার সাধারণ এক সৈনিক থেকে সর্বহারা শ্রেণির মহান নেতায় রূপান্তরিত হওয়ার অনন্যসাধারণ সংগ্রামের ইতিহাস, এসইউসিআই(সি) দল গঠনের ইতিহাস তুলে ধরেন। কমরেড শিবদাস ঘোষের জন্মশতবর্ষ পালনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সর্বহারা বিপ্লবের কর্মী হিসাবে আমাদের কাজ, এ যুগের এই মহান মার্ক্সবাদী চিন্তানায়কের চিন্তাধারা জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া এবং বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার উপযোগিতা তুলে ধরা। তিনি বলেন, কমরেড শিবদাস ঘোষ তাঁরা সারা জীবনের অসাধারণ কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশে একটি যথার্থ সাম্যবাদী দল হিসাবে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-কে গড়ে দিয়ে গিয়েছেন। মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারার ভিত্তিতে এই দলের কর্মী হিসাবে আমাদের দায়িত্ব এ দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করে তোলা। সেই লক্ষ্যে জনগণকে এমন সচেতন করে তুলতে হবে, যাতে সচেতন জনগণ এলাকায় এলাকায় গড়ে তুলবেন তাঁদের নিজস্ব রাজনৈতিক হাতিয়ার অসংখ্য গণকমিটি গড়ে তুলতে সক্ষম হন। কমরেড শিবদাস ঘোষের শিক্ষা উল্লেখ করে কমরেড ভট্টাচার্য দেখান, যে বুর্জোয়া মানবতাবাদ একদিন মহান মনীষীদের জন্ম দিয়েছিল, আজ মুমূর্ষু পুঁজিবাদের যুগে তা চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল ব্যক্তিবাদের জন্ম দিচ্ছে। তিনি বলেন, বুর্জোয়া ব্যবস্থা যে আজ মানবসমাজের বিকাশের পথে প্রধান বাধা, জনগণের সামনে তা তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবী কর্মীদের সর্বশক্তি দিয়ে ব্যক্তিবাদের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম জারি রাখতে হবে। প্রতি মুহূর্তের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দলের কর্মী ও প্রতিটি নেতাকে প্রতিনিয়ত নিজেদের চরিত্র উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে যাতে জনসাধারণের সামনে তাঁরা উদাহরণ হিসাবে নিজেদের দাঁড় করাতে পারেন। কমরেড ভট্টাচার্য বলেন, সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ আজ জীবিত নেই, কিন্তু তাঁর চিন্তাধারা ও শিক্ষা প্রতি মুহূর্তে আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছে। তাঁর সংগ্রাম, তাঁর ব্যক্তিবাদমুক্ত ব্যক্তিত্ব সমস্ত রকমের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের প্রেরণা। উপস্থিত দর্শকদের কাছে কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা ও শিক্ষা জীবনের সর্বদিক ব্যাপ্ত করে প্রয়োগ করার মাধ্যমে প্রকৃত কমিউনিস্ট হওয়ার সংগ্রামে প্রতিনিয়ত আত্মনিয়োগ করার শপথ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে কমরেড অসিত ভট্টাচার্য বলেন, আগামী এক বছর ধরে আমরা এই মহান নেতার জীবন সংগ্রাম ও তাঁর অমূল্য শিক্ষাগুলি দেশ জুড়ে শোষিত মুক্তিকামী মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। তাঁরা যাতে এ দেশে বিপ্লবের যথার্থ নেতা হিসাবে তাঁকে চিনতে পারেন, তার জন্য অজস্র সভা, সেমিনার, দেওয়াল লিখন, প্রদর্শনীর আয়োজনও হবে। বছরের শেষে আগামী ৫ আগস্ট কলকাতায় সমাপ্তি কর্মসূচিতে বক্তব্য রাখবেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ।
![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2022/08/2-Dehil-Addressing-Com-AB-150x67.jpg)
সভাপতির ভাষণে দলের পলিটবুরো সদস্য কমরেড সত্যবান বিপ্লবী কর্মী হিসাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কমরেড শিবদাস ঘোষের অমূল্য শিক্ষাগুলি তুলে ধরেন। সম্প্রতি দিল্লি সীমান্তে এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের অন্যায় আইনের বিরুদ্ধে দেশের কৃষকরা প্রাণ বাজি রেখে দৃঢ়পণ সংগ্রামে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। লাগাতার আন্দোলনের চাপে তখনকার মতো নতি স্বীকারে বাধ্য হলেও কেন্দে্রর প্রতারক বিজেপি সরকার কৃষকদের দাবি পূরণের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এই অবস্থায় মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারার বিজ্ঞানসম্মত ভিত্তিতে দেশ জুড়ে দীর্ঘস্থায়ী, সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলাই কৃষকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের একমাত্র পথ। শুধু কৃষি সমস্যাই নয়, দেশের সর্বত্র জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আজ যে সর্বাত্মক সংকট, তা থেকে মুক্তি পেতে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষ চিন্তাধারার অনুশীলনই একমাত্র পথ। সেই পথে হেঁটে নতুন মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে কমরেড সত্যবান তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। হলে উপস্থিত দর্শকবৃন্দ গভীর মনোযোগে নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শোনেন। আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় কমরেড শিবদাস ঘোষ জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বর্ষব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।