করোনা মহামারির বিপদ মাথায় নিয়েই পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দুর্গাপূজার দিনগুলিতে এবং তার আগের কয়েকদিনের কেনাকাটায় যে লাগামছাড়া ভিড় কলকাতা সহ সারা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দেখা গিয়েছিল তার ফল ফলতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই করোনা সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসকরা উদ্বিগ্ন।
প্রশ্ন হল, এমনটা যে হতে পারে তা কি জানা ছিল না? এ কথা ঠিক শারদোৎসবকে ঘিরে বাংলা জুড়ে মানুষের মধ্যে আবেগ কাজ করে। কিন্তু এই হুজুগের ভিড়ের সাথে শারদোৎসবের প্রকৃত আবেগ কি মানানসই? নাকি এই হিড়িক তোলা চলছে নির্দিষ্ট ব্যবসায়িক মুনাফার হিসাব কষেই! বেশ কয়েক বছর ধরেই কাজটা চলছে। কিন্তু এবারের অতিমারি পরিস্থিতিতে বিষয়টা যে জায়গায় পৌঁছেছে তাতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মাত্রেই উদ্বিগ্ন হতে বাধ্য। সবচেয়ে বেশি চিন্তার বিষয় সরকারি নেতা-মন্ত্রী ও কর্তাব্যক্তিদের ভূমিকা। তাঁরা অতিমারির বিপদের কথা জেনেও জাঁকালোমণ্ডপ, আলোর কারসাজি ইত্যাদি হরেক রকম চমক দিয়ে দর্শক আকর্ষণের প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন। একই সাথে করপোরেট টিভি চ্যানেলের সঞ্চালকরা গম্ভীর মুখে করোনা সচেতনতা প্রচারের সাথে এক নিঃশ্বাসেই ‘পুজো প্রতিযোগিতা’র হিড়িক তুলতে কম সচেষ্ট হননি। রাজ্য প্রশাসন মুখে কিছু সতর্কতার বাণী শুনিয়েছে, হাইকোর্ট মণ্ডপে ঢোকা নিয়ে কিছু নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সেই বাণী কিংবা নির্দেশ কার্যকরি করার দায় বা দায়িত্ব কার সরকারি কর্তাদের আচরণ দেখে তা বোঝার সাধ্য কারও ছিল না।
রাজ্যের দমকলমন্ত্রী নিজেই দমকলের সমস্ত নিয়ম কানুন আঁস্তাকুড়ে ফেলে দিয়ে তাঁর পুজোর মণ্ডপকে আকাশছোঁয়া বানিয়েছেন। তাঁর আলোর চমকে বিমান পরিষেবা পর্যন্ত থমকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। এই মণ্ডপের প্রচার যা ছিল, তাতে ভিড় না হওয়াটাই আশ্চর্যের। ভিড়ের চাপে অনেকে আহতও হয়েছেন, ভিআইপি রোডের মতো ব্যস্ত রাস্তা পুরোপরি স্তব্ধ হয়ে গেছে। রাজ্যের প্রশাসনিক ও পুলিশকর্তারা তাতে বিচলিত হওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পাননি বোধহয়! কলকাতা সহ নানা জেলায় যে ক’টি পুজো প্যান্ডেলে এমন চমক এবং ভিড়ের জোয়ার দেখা গেছে তার বেশিরভাগের সাথে জড়িয়ে আছে শাসকদলের কোনও না কোনও নেতা-মন্ত্রীর নাম। মুখ্যমন্ত্রী সহ রাজ্য প্রশাসনের প্রধান কর্তারা বিধি ভাঙার জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভেবেছেন বলেও শোনা যায়নি। অথচ রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে বারবার কোভিড বিধি মেনে চলার কথা প্রচার করা হয়েছে।
লোকাল ট্রেন বন্ধ, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যাবে না বলে সরকার একাধিকবার জানিয়েছে। তা হলে এমন ভিড়ের হিড়িকে মানুষকে মাতানোর পরিকল্পনা যে ক্ষমতাশালীরা করলেন তাঁদের বিরুদ্ধে কেন সরকার মহামারি আইনে আজও অভিযোগ দায়ের করল না? কোভিড সংক্রমণ ভয়ঙ্কর আকার নিতে পারে– বিশেষজ্ঞরা বারবার এই হুঁশিয়ারি দিলেও সরকার ও পুলিশ প্রশাসন এ জিনিস করতে দিল কী করে? আসন্ন কালীপুজোর জন্যও বিশাল সমারোহ এবং রাস্তা জোড়া মণ্ডপের জন্য শাসকদলের নেতাদের মদতে মাসাধিককাল কলকাতার বেশ কয়েকটি রাস্তা প্রায় বন্ধই থাকবে, এটাই মানুষকে মেনে নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। তা হলে এটাই কি বোঝায় না যে, রাজ্যের মানুষের নিরাপত্তা-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে নেতা-মন্ত্রীদের কোনও রকম মাথাব্যথা নেই?
শারদোৎসবঘিরে বাংলার মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে বাড়তি মুনাফার জন্য একচেটিয়া পুঁজির মালিকানায় চলা কর্পোরেট হাউসগুলি বেশ কিছু বছর ধরেই ঝাঁপিয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয় ভোট রাজনীতির হিসাব। টাকা, মদ, ফূর্তির উপকরণ জুগিয়ে কত বেশি যুবককে নিজেদের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধরে রাখা যায় তার চেষ্টা। কিন্তু সেটা বাড়তে বাড়তে যে উৎকট চেহারা নিয়েছে তা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যে কোনও মানুষ এমনকি প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মানুষকেও পীড়া না দিয়ে পারে না। এই ব্যবসা ও ভোট রাজনীতির জন্য টাকা জোগাড়ের উদ্দেশ্যে কর্পোরেট কর্তা, বৃহৎ ব্যবসায়ী, প্রমোটারদের খুশি করে তাদের টাকায় পকেট ভরাতে ক্ষমতাশালীদের প্রতিযোগিতা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। যত বেশি চমক, তত স্পনশরশিপ, তত বেশি টাকা। জমকালো মণ্ডপ, আলোর কারসাজি, ইত্যাদি নানা চমকে যত বেশি উগ্রতা– তত চোখে পড়ার সম্ভাবনা। এই কৃত্রিম উগ্র প্রসাধনে উৎসবকে সাজাতে গিয়ে গ্রামগঞ্জে পর্যন্ত শারাদোৎসবের নির্মল আনন্দটাই প্রায় শেষ করে দিয়েছে নানা স্তরের ক্ষমতাশালী মাতব্বরেরা। সামান্য কিছু এলাকার পুজো ছাড়া সার্বজনীন পুজোগুলিতে সর্বজনের অংশগ্রহণের বিষয়টাই চলে গেছে পিছনে। এর মধ্যে কোথাও কোনও ব্যতিক্রম নেই তা নয়, কিন্তু এটাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাকে উৎসাহ দিতে রাজ্য সরকার পর্যন্ত মাঠে নেমেছে।
সমস্ত পুজো কমিটিকে ৫০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগার থেকে অনুদান পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ উৎসাহে বিসর্জনের কার্নিভাল হয়েছে একাধিকবার। সেটার লক্ষ্য একদিকে যেমন বড় পুজো কমিটিগুলিকে পরের বছরের স্পনশর ধরার ব্যবস্থা করে দেওয়া, তার সাথে আছে বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদের প্রচারের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে একটু নরম হিন্দুত্বের মুখ হয়ে ভোটের বাজারে ফয়দা কুড়ানোর চেষ্টা। এখন তৃণমূল-বিজেপির মধ্যে গণেশ পুজো নিয়েও দ্বৈরথ চলছে, কে বেশি ভক্ত প্রমাণ করতে। বাংলায় যে সব পুজোর চল কোনও দিন ছিল না তার পিছনেও দুই দলের নেতারা লক্ষ লক্ষ টাকার থলি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে এ জন্যই। কংগ্রেস তো বটেই সিপিএম-এর মতো বামপন্থী দলও যখন ক্ষমতায় থেকেছে বা আজও যেখানে তাদের যতটুকু ক্ষমতা আছে তা ধরে রাখতে মানুষকে মাতানোর জন্য এই পথই নিয়েছে। এর ফলে যে হিন্দু মুসলিম সব ধরনের সাম্প্রদায়িক শক্তির বেড়ে ওঠার জমি পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হচ্ছে তার দিকে ভোটবাজ নেতাদের লক্ষ নেই। সব মিলিয়ে উৎসব তার আনন্দের প্রকৃত রূপ হারিয়ে শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের কাছে একপ্রকার যন্ত্রণা বয়ে আনছে।
এই পরিস্থিতিতে অন্তত প্রশাসক হিসাবে কর্তব্য পালনের জন্য রাজ্য সরকার তার নিজের আইনভাঙা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে উদাহরণ তৈরি করুক। উৎসব প্রকৃত আনন্দের মিলনক্ষেত্র হবে, এটুকু চাওয়াও কি নাগরিকের পক্ষে আজ অনেক বেশি? উত্তরটা সরকারকেই দিতে হবে।