গাড়ি কোম্পানির রকমারি বিজ্ঞাপন দেখতে দেখতে ছোটু আকাশপাতাল ভাবে– আমি যদি ওই গাড়িতে চড়তে পারতাম ছোটুর চোখে স্বপ্ন৷ নিত্যসঙ্গী অনাহার৷ ছোটুর বাবা বিজ্ঞাপনের নির্দিষ্ট ঠিকানায় ছেলেকে নিয়ে পৌঁছলেন কাজের আশায়৷ দেখলেন, কোনও কোম্পানি নয়, একটা মোটর গ্যারেজ৷ কমবয়সী ছেলেরা কালিঝুলি মেখে, কেউ গাড়ির তলায় ঢুকে সারাইয়ের কাজ করছে৷ পরে সেটাই ছোটুর স্থায়ী ঠিকানা হয়ে উঠল৷
মোটরগাড়ি যত আধুনিক কারখানাতেই তৈরি হোক, তার পরবর্তী সময় জুড়ে তা সারাতে নির্ভর করতে হয় রাস্তার ধারে, বিশেষত কোনও হাইওয়ের দু’পাশে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট গ্যারাজ, যন্ত্রাংশের কারখানা ইত্যাদিতে কাজ করা শিশু শ্রমিকদের উপর৷ এগুলিই বহুজাতিক গাড়ি কোম্পানিগুলির সাপ্লাই লাইন হিসাবে কাজ করে৷ বড় বড় গাড়ি শিল্পের মালিকরা ভারতের বাজারকে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য মনে করে৷ তাঁদের তৈরি গাড়িকে যারা শেষ দিন পর্যন্ত সচল রাখে, সেই হতভাগ্য শিশু শ্রমিকদের কথা কি তাদের কখনও মনে পড়ে? তারা কারখানার স্থায়ী শ্রমিকদেরই শুষে ছিবড়ে করে নেয়, আর এই শিশু শ্রমিকরা তো তুচ্ছ বিষয়৷
গ্যারেজ বা গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরির ছোট ছোট কারখানায় কাজ করা শিশু শ্রমিকদের বয়স ১০ থেকে ১৫–র মধ্যে৷ পরিবারের অভাব, চূড়ান্ত দারিদ্র তাদের বাধ্য করে শিশু বয়সেই এই মেহনতের কাজে ঢুকতে৷ গুয়াহাটি, ইন্দোর, মিরাট, চেন্নাই, পাটনাতে এরকম অসংখ্য শিশু শ্রমিক কাজ করে৷ সারা মাস অমানুষিক খেটে মাত্র ২০০০–২৫০০ টাকা মজুরি পায় এরা৷ দরিদ্র সংসারের ধূ ধূ ‘মরুভূমি’তে ওটুকুই ‘মরুদ্যান’৷
২০১১–র জনগণনা অনুযায়ী দেশে ১০ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি শিশুশ্রমিক রয়েছে৷ এই সংখ্যা যে বেড়েই চলেছে তা জানতে গুগল সার্চ করার দরকার নেই৷ আশেপাশের দরিদ্র পরিবারগুলোর দিকে তাকালেই চোখে পড়বে৷ এমনিতেই করোনা অতিমারিতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা অনেকখানি বেড়েছে৷ স্কুলছুট ছাত্রদের একটা বড় অংশই নানা জায়গায় কাজে ঢুকতে বাধ্য হয়েছে অভাবের কারণে৷ তার উপর ক্রমাগত বেড়ে চলা বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে দিতে অনুঘটকের কাজ করেছে৷ শিশু শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় জাতীয় কমিশন রয়েছে, রয়েছে শিশু শ্রমিক (নিষিদ্ধকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ) আইন–২০১৬৷ তবুও অন্যান্য শিল্পের মতো গাড়ি শিল্পে শিশুশ্রমিকদের অবৈধ ভাবে নিয়োগ নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও৷ প্রশাসনও নিশ্চুপ৷ কখনও কোনও জায়গায় দুর্ঘটনায় কোনও শিশুশ্রমিকের মৃত্যু হলে দু–চারদিন হইচই হয়৷ তারপর যে কে সেই৷ শিশু শ্রমিকদের শ্রম নিংড়ে মালিকের পুঁজি বাড়তে বাড়তে আকাশছোঁয়া হয়৷
‘দেশ এগোচ্ছে’ বলে ভাষণ দেওয়া কিংবা শিশুদিবসে কোনও হৃষ্টপুষ্ট শিশুকে কোলে নেওয়া নেতারা একবারও এই নিপীড়িত শিশু শ্রমিকদের কথা ভাবেন কি? ভাবলে কি সাড়ে সাত দশক ধরে তা চলতে পারত? আসলে তাঁরা তো শিল্পপতিদের সেবক হিসাবেই কাজ করেন৷ গাড়ি কারখানার মালিক আর শিশু শ্রমিক একসঙ্গে উভয়ের সেবা তো করা যায় না৷ তাহলে তারা কোন দেশের এগোনোর কথাই বা বলেন? শ্রমিকদের বাদ দিলে দেশটা আর কার! ফলে দেশটা যদি এগোয়, তা হলে কোন দিকে এগোচ্ছে?