দাঙ্গায় ৬০ জনের মৃত্যু হল, মহিলাদের ইজ্জতহানি হল, ঘরছাড়া হল ৫০ হাজার মানুষ৷ কিন্তু ৪ বছরের বেশি হয়ে গেলেও অভিযুক্তদের আজও সাজা হল না৷ শুধু তাই নয়, রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার তাদের বাঁচাতে মামলা প্রত্যাহার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে জেলা প্রশাসনের উপর৷
২০১৩ সালে উত্তরপ্রদেশে সরকারি ক্ষমতায় ছিল সমাজবাদী পার্টি৷ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মুলায়ম সিং যাদবের পুত্র অখিলেশ যাদব৷ ওই বছর আগস্ট–সেপ্টেম্বর মাসে মুজফফরনগর ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়েছিল বিজেপি৷
ভোটে জেতার হীন উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের লক্ষ্যে সংখ্যালঘু মানুষকে ঘরছাড়া করেছিল, পুড়িয়ে দিয়েছিল তাদের ঘরবাড়ি, মহিলাদের ইজ্জত লুট করেছিল, হত্যা করেছিল৷ ঘর ছেড়ে ভয়ঙ্কর দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় আশ্রয় শিবিরে দীর্ঘসময় কাটাতে হয়েছে শিশু–বৃদ্ধ–অসুস্থ সহ হাজার হাজার মানুষকে৷ তৎকালীন ক্ষমতাসীন সমাজবাদী পার্টিও এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি থেকে ফায়দা তোলার মতলবে ছিল৷
মুজফফরনগর দাঙ্গা ছিল অত্যন্ত পরিকল্পিত৷ দাঙ্গার আগে ‘মহাপঞ্চায়েত’ আয়োজন করে এবং নানা সভায় বিজেপি নেতারা তাঁদের ভাষণের মাধ্যমে উগ্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছিল৷ তার প্রত্যক্ষ প্রমাণও রয়েছে৷ বিজেপি বিধায়ক সঙ্গীত সোম সরাসরি এই দাঙ্গায় ইন্ধন জুগিয়েছেন৷ তা সত্ত্বেও ‘নিজেদের গায়েই কালি লাগবে বলে’ তিন বছর ধরে সমাজবাদী পার্টি তদন্তের নামে প্রহসন চালিয়ে গেছে৷ দাঙ্গায় অভিযুক্তরা সাজা পায়নি, শুধু কিছু ক্ষতিপূরণ ধরিয়ে মুখ বন্ধ করা হয়েছে ক্ষতিগ্রস্তদের৷ বিজেপির বাঘা বাঘা নেতার নাম অভিযুক্তদের তালিকায় থাকায় ২০১৭ সালে বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথের সরকার ক্ষমতায় এসে তদন্তকে ধামাচাপা দিতে তৎপর হয়ে ওঠে৷ তালিকায় নাম ছিল উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মন্ত্রী সুরেশ রানা, পূর্বতন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সঞ্জীব বালিয়ান, সাংসদ ভার্তেন্দু সিং, বিধায়ক উমেশ মালিক এবং বিজেপি নেত্রী সাধ্বী প্রাচী প্রমুখের৷ মোট ১৪৭৮ জন গ্রেপ্তার হয় এতে, বেশিরভাগই ছাড়া পেয়ে যায়৷ এতেই শেষ নয়৷ গোটা মামলাটাকেই যাতে ধামাচাপা দেওয়া যায়, তার জন্য বিচারবিভাগের স্পেশাল সচিব জেলাশাসককে একাধিক চিঠি দেন ‘জনস্বার্থে’–র তকমা দিয়ে এই মামলা প্রত্যাহার করার জন্য৷ বিচারবিভাগের চিঠির প্রত্যুত্তরে জেলা প্রশাসন এ ধরনের ১০টি দাঙ্গার মামলা প্রত্যাহার না করার পক্ষে মত দিয়েছে এবং প্রশ্ন তুলেছে পুলিশ ও স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট) ‘দাঙ্গা’র মামলায় চার্জশিট দেওয়া সত্ত্বেও মামলা কীভাবে প্রত্যাহূত হতে পারে৷
ফলে যোগী সরকার এখন সাম্প্রদায়িক ‘দাঙ্গা’–র মামলাকে রাজনৈতিক সংঘর্ষ বা রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট মামলা হিসাবে দেখাতে চাইছে, যাতে ওই ভয়ঙ্কর অপরাধমূলক মামলাগুলিকে প্রত্যাহার করা সহজ হয়৷ কারণ, মামলাগুলি বিজেপি নেতা–মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে৷ সেই উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনে এমন ২০ হাজার মামলা প্রত্যাহার করা সংক্রান্ত যে বিল এনেছিলেন তা পাশও হয়েছে৷বিজেপি নেতা সঞ্জীব বালিয়ান রাখঢাক না রেখে বলেই দিয়েছেন, যদি আইনি জটিলতার কারণে মুজফফরনগর মামলা প্রত্যাহার সম্ভব না হয়, তাহলে আমরা নতুন করে তদন্তের ব্যবস্থা করব৷ প্রয়োজনে আইনি প্রক্রিয়ার রদবদল ঘটাতে সরকারি হস্তক্ষেপ করতে কতক্ষণ!
বহু দাঙ্গার রক্তস্রোত পেরিয়েই যোগী মসনদে আসীন হয়েছেন তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই৷ তার জন্য বিজেপির যে নেতারা তাঁকে উপযুক্ত সঙ্গত দিয়েছিলেন, তাঁদের প্রমোশন দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু এই জয়ের গোলাপের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে মামলার কাঁটা৷ সেগুলিকে তুলে ফেলতে পারলেই হাতে আসবে দাঙ্গা বাধাবার ‘আইনসম্মত’ অধিকার আবারও কোনও দাঙ্গার ছক কষে পুনরায় ক্ষমতা ধরে রাখার কৌশল নিতে থাকবে না কোনও বাধা৷ তাই খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চাকরি, দাঙ্গাপীড়িতদের যথার্থ পুনর্বাসন– এগুলির কোনওটা সম্পর্কেই যোগী সরকার উচ্চবাচ্য না করলেও দাঙ্গায় অভিযুক্ত নেতাদের মুক্ত করতে বিধানসভায় বিল নিয়ে এসেছেন৷ গণতন্ত্রের সামনে, ধর্মনিরপেক্ষতার সামনে এ এক মারাত্মক বিপদ৷