দাক্ষিণ্যেই আদানি বিশ্বের চতুর্থ সম্পদশালী

এ কেমন স্বাধীনতা! ভারতের ৭১ শতাংশ নাগরিক, সংখ্যার হিসেবে ৯৭ কোটি সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত। রাষ্ট্রপুঞ্জের ‘ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন’-এর এক সমীক্ষায় সম্প্রতি এই বিস্ফারক তথ্য জানা গেছে। এই রিপোর্ট প্রকাশের পক্ষকাল পরেই ফোর্বস তালিকায় দেখা গেল, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসকে পিছনে ফেলে বিশ্বে চতুর্থ সম্পদশালী হিসাবে উঠে এসেছেন নরেন্দ্র মোদি সরকারের অতিঘনিষ্ঠ আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি। তার বর্তমান সম্পদের পরিমাণ ১১৬ বিলিয়ন ডলার। ফোর্বস তালিকায় প্রকাশিত এই খবর দেখে গর্বিত বিজেপি নেতারা বলতে পারেন, আর মাত্র তিনজন–টেসলার এলন মাস্ক, লুইস ভুইটোর বার্নার্ড আরনল্ট এবং আমাজনের জেফ বেজোসকে হারাতে পারলেই হল, ভারত–মানে ভারতের পুঁজিপতি একেবারে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনটি পাবে! সৌজন্যে মোদি-অমিত শাহের বিশ্বস্ত বন্ধু আদানি।

কাজের খোঁজে গুজরাট থেকে মুম্বইয়ে এসে হিরে ব্যবসা দিয়ে যার আয়ে হাতেখড়ি, সেই আদানির এই বিপুল সম্পদবৃদ্ধি কীভাবে? এর পেছনে রয়েছে শাসক বিজেপির আর্শীবাদ। দেশের সাধারণ মানুষকে সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বিজেপি সরকার একচেটিয়া পুঁজিপতি আদানিকে লুটপাট চালানোর অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে এসেছে লাগাতার। জমি, বন্দর, কয়লা, খনি, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, টেলিকম, চাল-ভোজ্য তেল সহ নানা খাদ্যদ্রব্যের একচেটিয়া ব্যবসার অধিকার দিয়েছে তাদের। অক্টোপাসের মতো সমস্ত দিক থেকে আস্টেপৃষ্ঠে মুনাফা-লালসা পূরণে ঝাঁপিয়ে পড়ে আদানি গোষ্ঠী। অনলাইন, ফ্র্যাঞ্চাইজি, এজেন্সির মাধ্যমে দেশের সর্বত্র খুচরো এবং পাইকারি ব্যবসায় এবং লক্ষ লক্ষ কাউন্টার খুলে এক বিশাল চেনের মাধ্যমে এই সব ব্যবসার একচেটিয়া দখল নেয় তারা। প্রায় সমস্ত বন্দর সহ বহু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সরকার জলের দরে তুলে দিয়েছে আদানির হাতে। এজন্য কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতারা কতটা কাটমানি পেয়েছেন তা নিয়ে তদন্ত না হলেও সরকারের ‘বদান্যতায়’ লাভের অঙ্ক বাড়তে থাকে আদানিদের, বিলিওনিয়ারের সাম্রাজ্যে সম্রাটের স্থান দখল করে অতি দ্রুত।

শুধু দেশের বাজারেই নয়, বিদেশেও– যেমন ইজরায়েলে বন্দর, অস্ট্রেলিয়ায় খনি, শ্রীলঙ্কায় বিদ্যুৎ ব্যবসার বরাতও মোদি সরকার পাইয়ে দেয় আদানিকে। অস্ট্রেলিয়ায় আদানির খনি কেনার জন্য সরকারি ঋণ পাইয়ে দিতে স্টেট ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যানকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল বিজেপি সরকার। অস্ট্রেলিয়া এবং শ্রীলঙ্কা দু’দেশের সাধারণ নাগরিক ভারতীয় পুঁজিপতি আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। স্লোগান উঠছে, ‘আদানি গো ব্যাক’, ‘খনি-বিদ্যুৎ থেকে হাত ওঠাও’। আদানিদের সেবা করার মাশুল দিতে হচ্ছে ভারতের জনগণকেও। দেশে বিপুল কয়লার ভাণ্ডার মজুত থাকা সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়া থেকে আদানির কয়লা ১০ গুণ বেশি দামে কিনে ভারতে আমদানি করছে মোদি সরকার। এই আমদানির কোনও প্রয়োজন ছিল না। আদানির মুনাফা বাড়াতে এইভাবে বেশি দাম দিয়ে কয়লা কিনে ভারতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে মোদি সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। পরিণামে সাধারণ মানুষকে বিপুল পরিমাণে বিদ্যুৎ বিল মেটাতে হচ্ছে। এইভাবে সরকারের সৌজন্যে জনগণের পকেট কেটে আদানিদের সম্পদ বৃদ্ধি চলছে।

বিজেপির ‘দাক্ষিণ্যে’ আদানির সম্পদবৃদ্ধি ঘটতে থাকে অতি মসৃণ গতিতে। গত দু’বছরে করোনা অতিমারিতে যখন জনজীবন বিপর্যস্ত, দেখা গেল তখনই আদানি গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি লাভ করেছে। ২০২১ সালেই শুধু তাদের সম্পদবৃদ্ধি হয়েছে ৪৯ বিলিয়ন ডলার, প্রতি সপ্তাহে ৬ হাজার কোটি টাকা হারে (তথ্য-হুরুন)। ২০২২-এ এখনও পর্যন্ত তাদের সম্পদ বেড়েছে ৪৫ শতাংশ অর্থাৎ ৩৪ বিলিয়ন ডলার। সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জনগণের সম্পত্তির অবাধ লুঠ ছাড়া এমন আর্থিক বৃদ্ধি সম্ভব নয়। শুধু জনগণের সম্পত্তি নয়, ড্রাগ ব্যবসাতেও নাম রয়েছে তাদের। আদানি পরিচালিত গুজরাটের মুন্দ্রা বন্দরে ৩০ হাজার কোটি টাকার ড্রাগ ধরা পড়েছিল, পরে আরও একবার ধরা পড়ে। কোনওটিরই তদন্ত হয়নি বিজেপি সরকারের বদান্যতায়!

যে কথাটা সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে, শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শ্রম শোষণ করে, দেশের সম্পদের লুটপাট চালিয়েই আদানির মতো পুঁজিপতিরা সম্পদের পাহাড় বানায়। এর অনিবার্য পরিণামে দেশের ৯৭ কোটি মানুষ সুষম খাদ্য থেকে বঞ্চিত। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১১৬টি দেশের মধ্যে ১০১তম স্থানে ভারত, প্রতি ৩৬টি শিশুর একজনের মৃত্যু হয় প্রথম জন্মদিনের আগেই। এগুলি স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষের পালকে এক একটা কৃষ্ণ বিন্দু। স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যে পুঁজিবাদী শাসন কায়েম হয়েছে আদানিরা তার সুফল লুটেছে। আর লক্ষ লক্ষ মানুষ থালা হাতে ভিক্ষা করে পথের ধারে।