জনগণের দাবি নিয়ে আন্দোলন করার ‘অপরাধে’ কারারুদ্ধ এস ইউ সি আই (সি)-র পুরুলিয়া জেলার নেতা-কর্মীদের মধ্যে ৭ জন জামিনে মুক্তি পেলেন, এখনও জামিনের অপেক্ষায় রয়েছেন শিশুসন্তান-কোলে মা ও বর্ষীয়ান সংগঠক সহ অন্যান্য কমরেডরা।
এ এমন এক ব্যবস্থা, এমন এক দেশ– যেখানে সমাজবিরোধীরা অবাধে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর যারা সমাজের স্বার্থে কাজ করে, মানুষের মঙ্গলের জন্য ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে লড়াই আন্দোলন করে তাদের যেতে হয় জেলে। যারা জোঁকের মতো জনগণের রক্ত শোষণ করে তারা হয় দেশের উন্নয়নের কান্ডারি, দেশপ্রেমিক। আর যাঁরা শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেন তাঁরা হন উন্নয়নবিরোধী, দেশদ্রোহী। দেশের সব জায়গার মতোই এই রাজ্যের পুরুলিয়া জেলাও আবার এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকল।
ঘটনার সূত্রপাত ২০১০-এর ডিসেম্বর। রাজ্যের ক্ষমতায় তখন সিপিএম-ফ্রন্ট সরকার। খরায় পোড়া পুরুলিয়া জেলার রুখাশুখা মানুষগুলোর তৃষা মেটানোর জন্য সারা বছর পানীয় জলের ব্যবস্থা, খরায় যাতে ফসল পুড়ে না যায় সেজন্য স্থায়ী সেচের ব্যবস্থা, জেলার গরিব মানুষগুলোকে একটু স্বস্তি দেওয়ার জন্য কর-দর বৃদ্ধি রোধ, বেহাল শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল ফেরানো এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং সমস্ত রাজনৈতিক কর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তি– এক কথায় ভদ্রভাবে খেয়েপরে পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার দাবিতে এস ইউ সি আই (সি) সেদিন জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে অবস্থান বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিল। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে জেলার বিভিন্ন প্রান্তের বহু মানুষ বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন। শান্তিপূর্ণ অবস্থান থেকে ধ্বনিত হচ্ছিল বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ সহ্য করতে পারে না শাসক শ্রেণির স্বার্থবাহী শাসক দল। ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা পাবার জন্য তারা মাঝে মাঝে গরিব মানুষের দুঃখে চোখের জল ফেলে, কিন্তু তাদের প্রতিবাদী হতে শেখানো, তাদের হাতে যথার্থ রাজনৈতিক ক্ষমতা কখনওই দেওয়া হয় না। তাই প্রতিবাদ যত জোরালো হয়, শোষকের বুকে কাঁপন তত বাড়ে। তারা সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় বাহিনী নামিয়ে প্রতিবাদের ভাষাকে স্তব্ধ করে দিতে চায়। এ ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হল না। সরকারি মসনদে বসে পুঁজিবাদের তল্পিবাহক সিপিএম-এর নির্দেশে পুলিশবাহিনী নির্মমভাবে লাঠিপেটা করতে শুরু করে নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ অবস্থানকারীদের উপর। তাদের লাঠির হাত থেকে এমনকি বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাও রেহাই পাননি। ঘটনাস্থল ও আশপাশ থেকে পুলিশ নির্বিচারে ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে। যাঁদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট ছাত্র নেতা কমরেড সৌরভ ঘোষ, মহিলা নেত্রী কমরেড শোভা মাহাতো, কমরেড সুস্মিতা মাহাতো, বিশিষ্ট সংগঠক কমরেড জিতেন মাজী ও সত্তরোর্ধ্ব কমরেড শৈলেন বাউরি। এছাড়াও ছিলেন আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী খরাপীড়িত এলাকার কিছু তরুণ। তাঁদের বিরুদ্ধে আনা হল খুনের চেষ্টা সহ বিভিন্ন জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা। এই মিথ্যা মামলায় বেছে বেছে আরও ১২ জনকে জড়ানো হল– যাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রয়াত জেলা সম্পাদক কমরেড প্রণতি ভট্টাচার্য, জেলা কমিটির বিশিষ্ট সদস্য প্রয়াত কমরেড ভাস্কর ভদ্র, জেলার বিশিষ্ট সংগঠক কমরেড রঙ্গলাল কুমার এবং আরও অনেকে।
ইতিমধ্যে রাজ্য সরকারের বদল হয়েছে। বদল হয়নি বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, বদল হয়নি রাজনৈতিক কর্মীদের উপর মিথ্যা মামলা চাপিয়ে হয়রানি করার ধারাবাহিকতা। তাই রাজনৈতিক কর্মসূচি বা শারীরিক অসুস্থতার কথা আগে জানিয়ে গেলেও, এমনকি কেসের দিন হাজিরা দিতে আধঘণ্টা দেরি হওয়ার কারণ দেখিয়ে ১৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়ে যায়।
এই পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হওয়া অভিযুক্তরা দু’দলে কোর্টে আত্মসমপর্ণ করেন। উকিলদের সক্রিয় সহযোগিতায় প্রথম দল গত ১৮ জানুয়ারি জামিনে মুক্ত হন, কিন্তু দ্বিতীয় দল এখনও মুক্তি পাননি। তাঁদের মধ্যে যেমন আছেন শিশুকোলে মা, তেমনই আছেন আশি ছুঁতে চলা বর্ষীয়ান সংগঠক। জামিনে মুক্ত নেতা-কর্মীদের বিপ্লবী সংবর্ধনা জানিয়ে মিছিল করে নিয়ে আসা হয়। মিছিল থেকে আওয়াজ ওঠে– যে আন্দোলনের জন্য তাঁদের কারাবরণ করতে হয়েছে, জনগণের সেইসব ন্যায্য দাবি নিয়ে আন্দোলন আরও দৃঢ়তর হবে।