সম্প্রতি মেদিনীপুরে বিজেপির সভার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে একটাই চর্চা– কোন নেতা কোন দলে গেলেন, আর এলেন? ক্ষমতা দখলে ‘ঘোড়া কেনাবেচা’র রাজনীতির কথা বাংলার মানুষ এতদিন খবরের কাগজে কিংবা টিভিতে দেখেছেন। এবার বাংলার মাটিতেও সেই রাজনীতির উৎকট আয়োজন চলছে।
আপাতত এই কেনাবেচায় লাভবান বিজেপি। তৃণমূলের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, কংগ্রেসের কিছু নেতা, সিপিএম-সিপিআইয়ের একজন করে বিধায়ক গেছেন বিজেপিতে। সারা দেশে যখন বিজেপি বিরোধী আন্দোলনের জোয়ার, বিশেষ করে কৃষক আন্দোলনের সামনে এনডিএ-র শরিক দলগুলি এবং বিজেপি কর্মীরাও সে দলের হাত ছেড়ে জনগণের কাছে মুখরক্ষায় ব্যস্ত। ঠিক তখনই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পক্ষে এমন নেতার স্রোত কোন যাদুতে হল? কোনও আদর্শ-নৈতিকতার ভিত্তিতে? জনগণ জানে, একেবারেই না! পুরোটাই হল বেচাকেনা। সে দাম চোকানোর মাধ্যম পদের লোভ, টাকা, কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি মামলায় সিবিআই-ইডির আর না এগোনোর প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি যাই হোক না কেন! বিজেপির আর যা কিছুই থাক, ক্ষমতা দখলের জন্য সাদা-কালোর বাছবিচার আছে এমন অপবাদ তার অতিবড় শত্রুও দিতে পারবে না। তাই সারদা এবং নারদ মামলায় অভিযুক্ত প্রায় সব রাঘব বোয়ালই বিজেপির ঝাঁকে মিশে গেছেন। তাই শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যাওয়ার পরেই তাদের সর্বময় শক্তিশালী আইটি সেল দলের ইউটিউব চ্যানেল থেকে নারদ মামলা সংক্রান্ত ভিডিওটি মুছে দিয়েছে। অবশ্য উত্তরবঙ্গের যে নেতা তৃণমূলে থাকার সময় বিজেপির কাছ থেকে ‘অস্ত্র পাচারকারি’, ‘স্মাগলার’ আখ্যা লাভ করেছিলেন, তিনি এখন বিজেপির সাংসদ। দলবদলের হিড়িকে কয়লা মাফিয়া বলে পরিচিত এক নেতাও বিজেপির ‘সমাজসেবী’ তালিকায় জ্বলজ্বল করছেন। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতির সুরেই একদা তৃণমূলের অন্যতম কাণ্ডারি মুকুল রায়ও বলেছেন, দল আমাদের ভাঙাতেই হবে, এবং তাতে কারও পুরনো রেকর্ড দেখার দরকার নেই। কারণ? ভোটে জিততে গেলে এটাই দরকার। এদিকে তৃণমূল ছেড়ে আগেই বিজেপিতে যাওয়া এক সাংসদের স্ত্রীর পুরনো দলে প্রশ্নত্যাবর্তন নিয়েওরীতিমতো নাটকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাতে জনমনে আজ রাজনীতি সম্বন্ধে চরম অশ্রদ্ধা। এর ফল কিন্তু মারাত্মক। সাধারণ মানুষকে রাজনীতি বিমুখ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের সম্ভাবনাটুকু উত্তরঠে আসাকে এভাবে অঙ্কুরেই বিনাশ করার চক্রান্ত লাভবান হচ্ছে।
যারা যেদিকেই যান না কেন, মাইক ধরেই জনসেবার কথায় তাদের ঘাটতি নেই। কিন্তু এর কোনওটাই কি জনস্বার্থের কথা ভেবে করেছেন তাঁরা? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে দলবদলের সবচেয়ে আলোচিত মুখ শুভেন্দু অধিকারী বড়দাদা সম্বোধন করে বলেছেন, অমিত শাহ ‘কথা দিলে কথা রাখেন’। তাঁকে কোন কথাটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়েছিলেন, তা তিনিই জানেন, কিন্তু দেশের মানুষের জন্য কোন কথাটা অমিত শাহ রেখেছেন? দলে ভেড়া নেতাদের দুর্নীতির কালি মুছতে না পারি, ঢেকে দেব– স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে এই কথাই কি তিনি দিয়ে রেখেছেন? মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্রে নির্বাচিত সরকার ফেলতে টাকার বন্যা বইয়ে দিয়ে এমএলএ কিনেছে বিজেপি। কোথাও পুরো সফল, কোথাও আংশিক। যাদের কিনেছে তারা সকলেই নানা দুর্নীতিতে অভিযুক্ত, টাকা, পদ, মামলা চেপে দেওয়া সহ নানা সুবিধার টোপে দলবদলানোর মতো দুর্নীতিও তারা করেছেন। এই সব ম্যানেজ করার কথাই কি বিজেপি দিয়ে রেখেছে? তাই কি বিজেপিতে গেলেই সব অপরাধ মুছে যাচ্ছে? বিজেপি করপোরেট মালিকদের কথা দিয়েছিল তাদের জন্য সীমাহীন লুঠের বাজার খুলে দেবে, তা নিশ্চয়ই রেখেছে। সারা দেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরি করে খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য ভাঙার প্রশ্নতিশ্রুতি মালিক শ্রেণিকে দিয়েছে বিজেপি। তা রক্ষাও করছে। কিন্তু এর সাথে জনস্বার্থের সম্পর্ক কোথায়?
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অপশাসন, বিদ্যুৎ, কৃষি সহ সমস্ত ক্ষেত্রে একচেটিয়া মালিকদের লাভের পথ করে দিতে জনবিরোধী পদক্ষেপ নেওয়া, মূল্যবৃদ্ধি রোধে অনীহা, শাসক দলের নেতা-কর্মীদের তোলাবাজি, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি, বিগত পঞ্চায়েত ভোটে বিরোধীদের লড়তেই না দেওয়া, রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করার হুঙ্কার ইত্যাদি কারণে তাদের উত্তরপর মানুষের ক্ষোভ জমেছে। তার বিরুদ্ধে আন্দোলনও চাইছেন সাধারণ মানুষ। নানা স্তরে সেই আন্দোলন গড়েও উত্তরঠছে। কিন্তু বিজেপি সেই আন্দোলনগুলির কোনওটাতেই নেই। থাকবে কী করে! যেখানে তারা ক্ষমতায় আছে অপশাসনের নিরিখে তারা অনেক বেশি বই কম কিছু নয়। দুর্নীতি, গণতন্ত্র হত্যা, কোনওটাতেই আর বিজেপির সমকক্ষ ভারতে কেউ নেই। বিজেপিকে দিয়ে এগুলি দূর করার চেষ্টা করার কথা যারা বলেন, তাদের কোনও সততা আছে? বস্তুত, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে ১৮টি আসনে জেতার আগে তারা এ রাজ্যে এতটা আলোচিতও ছিল না। তৃণমূলকে টাইট দিতে গিয়ে সিপিএম তাদের সাহায্য করে আসনও পাইয়ে দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে শক্ত করে পা রাখতেও সাহায্য করেছে। প্রচার যত, বিজেপির বাস্তব সংগঠন কিছুদিন আগেও তা ছিল না। এখন না হয় রাশি রাশি টাকার বস্তা নিয়ে তারা লোক জোগাড়ে নেমেছে। তাদের লক্ষ্য এই তৃণমূল বিরোধী ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ভোটে ফয়দা লুটে নেওয়া। তার জন্য নেতা কিনতে নেমেছে তারা। করপোরেট মালিকদের আশীর্বাদের সিংহভাগ এখন তাদেরই দিকে। ফলে তাদের টাকার থলিটাও যেমন মোটা, তেমনই করপোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত প্রচারমাধ্যমের আনুকুল্য কেনার জোরও বেশি। সেই জোরেই যারা তৃণমূলের অপশাসন, দুর্নীতি, গায়ের জোর ফলানোর প্রধান কারিগর তাদের এক এক করে বিজেপি দলে ভেড়াচ্ছে। এরাই নাকি তাদের ‘সোনার বাংলা’-র কারিগর?
একটা সরকারের বিরুদ্ধে যখন জনগণের ক্ষোভ ফেটে পড়ে, পুঁজিপতি শ্রেণি চায় সেই ক্ষোভকে আন্দোলনের ময়দান থেকে দূরে রেখে ভোটের বাক্সে বন্দি করে ফেলতে। ভোটে ক্ষোভ উগরে দিয়ে সরকারের রঙ বদলে দিলেই সমাধান হয়ে যাবে– এই মিথ্যাকেই তারা মানুষের কানে সত্য বলে জপতে থাকে। ঠিক সেই সুযোগে নিজের আখের গোছানোর জন্য রাজনৈতিক ধুরন্ধররা জামা পাল্টায়। তাতে সাধারণ মানুষের কোন উপকারটি হয়? সিপিএম যখন ক্ষমতায় এসেছিল পশ্চিমবঙ্গের পাড়ায় পাড়ায় কংগ্রেসী মস্তান বাহিনী রাতারাতি কংগ্রেস ছেড়ে ভিড়েছিল সিপিএমে। আবার সিপিএম ক্ষমতা হারাতেই তাদের দলের ‘সম্পদ’দের অনেকেই ঝাঁক বেঁধে ভিড়েছে তৃণমূলে। এখন তৃণমূল ভাঙাতে উঠেপড়ে লেগেছে বিজেপি। যদিও তৃণমূল নেতৃত্বকে স্বীকার করতেই হবে এভাবে লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে বিধায়ক সাংসদ ভাঙানোর খেলাতে তারাও কম যায়নি। বুর্জোয়া রাজনীতির মধ্যেও নেই নেই করেও যেটুকু চক্ষুলজ্জা বস্তুটি অবশিষ্ট ছিল তার রেশটুকুকেও শেষ করার কাজটি তাঁরা এগিয়ে রেখেছেন। তাতে বিজেপির সুবিধা হয়েছে। আজ তাই বড় বড় তৃণমূল নেতারা বিজেপিতে ভিড়েই নন্দীগ্রাম আন্দোলনের কৃতিত্ব বিজেপিকে দিচ্ছেন! যে বিজেপিকে সারা নন্দীগ্রামে কোথাও খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর ছিল। বিজেপিই সারা ভারতে এসইজেড প্রকল্পের হোতা। সেই দল নন্দীগ্রাম আন্দোলনে থাকতে পারে? তাদের নেতা আদবানি সাহেব তো সব হইচই থিতিয়ে যাওয়ার পর নন্দীগ্রামের মানুষের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে নিজের নাম কুড়োতে এসেছিলেন। তিনি এই জমি দখল কিংবা এসইজেডের সর্বনাশা দিকের বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেননি কেন? বিজেপি নন্দীগ্রামের মানুষের উত্তরপর অত্যাচারের প্রধান হোতা লক্ষ্মণ শেঠকেও কোল দিতে চেয়েছিল।
বিজেপি দলটার মুশকিল হল তাদের থলিতে টাকা-ধর্ম বিদ্বেষ-চালাকি-অভিনয় দক্ষতা-করপোরেট পুঁজির আশীর্বাদ ইত্যাদি অনেক কিছুই আছে। শুধু নেই মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য কোনও মুখ। দেশপ্রেমিক সাজার চেষ্টা করতে গিয়ে তাঁদের কংগ্রেস থেকে নেতা ধার করে আকাশছোঁয়া মূর্তি বানাতে হয়েছে। এখন পশ্চিমবঙ্গে ভোট করতে গিয়ে দেখছে বাংলার মানুষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে যতই ক্ষোভ উগরে দিক, বিজেপির সংস্কৃতিকে গ্রহণ করছে না। নানা প্রাপ্তি যোগের কল্যাণে কিছু লোক জোগাড় করলেও বিজেপির শিকড় যে বাংলার মাটির উপযুক্ত নয়, তা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই তাদের এখন দরকার হয়ে পড়েছে কিছু নেতা ভাঙানোর, যারা ভোট মেশিনারি দখল করতে পারে, টাকা ছড়াতে পারে।
এই হল ভোট সর্বস্ব রাজনীতির প্রকৃত রূপ। তৃণমূলের বদলে বিজেপিকে ভোটে জেতালে বাংলার মানুষ কী পাবে? তৃণমূলের অপশাসনের অন্যতম কাণ্ডারিরা জামা বদলে পুরনো দলের বিরুদ্ধে কিছু গরম গরম কথা বলবেন। আর মানুষের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? বাংলার মানুষকে এতটাই মুর্খ ভেবেছে বিজেপি? প্রশ্ন একটাই, ভোটে যদি সরকার বদলও হয়, জনবিরোধী রাজনীতির বদল হবে কী করে? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা আজ সবচেয় জরুরি।