ভারতীয় রাজনীতিতে দলবদল একটি দুষ্ট ক্ষতের মতো অবস্থান করছে। পশ্চিমবঙ্গও আজ এর ব্যতিক্রম নয়। ভারতের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতে নবজাগরণের প্রভাব ও ভারতকে স্বাধীন করতে তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে আত্মত্যাগ, সংগ্রাম, ঐতিহ্যের সাক্ষী রেখেছিলেন তা ক্রমেই হারিয়ে যেতে বসেছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো মুখে মতাদর্শ, নীতি, নৈতিকতা, সততা, মূল্যবোধের কথা বললেও তাদের রাজনৈতিক চর্চার মধ্যে সেগুলি খুঁজে পাওয়া যায় না। দল পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দক্ষিণপন্থী দল কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূলের নেতা-কর্মী হোক বা তথাকথিত বামপন্থী নামধারী সিপিএম-এর নেতা-কর্মী, বাস্তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর। আজ রাজনৈতিক সদস্যদের দলত্যাগের ঘটনা দেশ ও রাজ্যের রাজনীতিকে কলুষিত করছে। ক্লাব-ফুটবলে জার্সি বদল এর মতো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা দলবদল করছেন, সকালে ইস্টবেঙ্গল তো বিকেলে মোহনবাগান।
রাজনীতি শব্দের অর্থ নীতির রাজা বা শ্রেষ্ঠ নীতি, যার দ্বারা রাজ্য বা রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। আর আধুনিক রাজনীতির সহজ সংজ্ঞা হচ্ছে নিজেদের আখের গুছানো।
বর্তমানে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা রাজনীতিকে ব্যক্তিগত পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। তাদের কাছে রাজনীতি হল মোটা অর্থের আকর্ষণ, ব্যক্তিগত শ্রীবৃদ্ধি, মন্ত্রিত্ব, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব কায়েমের উচ্চাকাঙক্ষা। ডানপন্থী ও বামপন্থী বেশিরভাগ দলেরই নীতি নৈতিকতা, মতাদর্শ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ভোগসর্বস্ব সমাজে বিলুপ্তপ্রায়। আজ তাই নীতিহীন রাজনীতিরই রমরমা। এই সব নেতা-কর্মীরা হিসেব কষে কোন দলে গেলে লাভ কত? কার পালে হাওয়া বেশি? কোন দল ক্ষমতায়? কোথায় গেলে পলিটিকাল কেরিয়ার সুরক্ষিত হবে? ব্যক্তিগত লাভ, সুবিধাবাদী রাজনীতির চর্চা, দুর্নীতির পর শাস্তির ভয়, দলীয় টিকিট না পাওয়া, এগুলিই দলত্যাগের কারণ। কোনও আদর্শের টানে তারা দলবদল করেন না। এই সব দলগুলি ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করে। কাকে বা কাদের নিলে তারা ক্ষমতা দখল করতে পারবে এই হিসাব নিকাশ করেই দলত্যাগকে মদত দেয় তারা।
এই সব নেতারা নীতিহীন রাজনীতির মধ্যে দিয়ে, ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির হিসাবের মধ্য দিয়ে জনগণের আস্থা-বিশ্বাসকে যেমন আঘাত করছেন তেমনই রাজনীতি সম্পর্কে জনগণের মনে অশ্রদ্ধা গড়ে তুলছেন। এর ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর জনগণ আস্থা হারাচ্ছে। এর দায় নেবে কে? এর দায় কি বর্তায় না সংশিষ্ট দল ও নেতাদের উপর। ভোট রাজনীতি কার্যত একটা প্রহসনে পরিণত হচ্ছে। সংবিধানে দলত্যাগ বিরোধী আইন আছে, কিন্তু সেই আইনের নানা ফাঁক গলে দলত্যাগ চলছেই।
আজ শুধু আইনের দ্বারা এর প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এই হীন রাজনীতিতে জনস্বার্থেরই সবচেয়ে ক্ষতি। তাই দল নির্বিশেষে জনগণকে এমন রাজনীতিকে ঘৃণা করতে হবে। কারণ উন্নত রুচি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, ব্যক্তিস্বার্থ বিবর্জিত রাজনীতিই একমাত্র জনস্বার্থকে রক্ষা করতে পারে। তার জন্য জনগণকেও বলিষ্ঠ ভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই নীতিহীন, সুবিধাবাদী রাজনীতি পরাস্ত হতে পারে।
শ্যামল দত্ত, উত্তর দিনাজপুর