পশ্চিমবাংলায় সিপিএম সরকারের আমলে প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি ও পাশ–ফেল তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর উদ্যোগ ও বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, শিল্পী–সাহিত্যিকদের নেতৃত্বে ভাষাশিক্ষা আন্দোলন গৌরবময় ইতিহাস হয়ে আছে৷ বহু বাধা, উদ্ভট যুক্তি ইত্যাদির বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই চালাতে হয়েছে দীর্ঘকাল৷ ‘মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ’ বলে প্রচার চালিয়ে সিপিএম নেতারা দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজি শেখার গুরুত্বকে লঘু করে দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়েছিল৷ আর এক দল বামপন্থার ধ্বজা উড়িয়ে প্রচার করেছে ইংরেজি সাম্রাজ্যবাদী ভাষা৷ এ ভাষা ভারতবাসী শিখবে কেন? আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ইংরেজি ভাষাকে আর বিদেশি ভাষা বলা যায় না৷ বিদেশের সাথে শুধু নয়, নিজেদের দেশের নানা ভাষাভাষী জনগণের মধ্যে সংযোগের ভাষা হিসাবে ইংরেজি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে৷ সর্বোপরি উচ্চশিক্ষার জন্য আজও ইংরেজি অপরিহার্য৷ তাহলে সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়েদের কাছে এই ভাষা শেখার সুযোগ কেন থাকবে না?
২৯ জুলাই ’১৮ তারিখের সংবাদ প্রতিদিন সংবাদপত্রের ‘রোববার’ ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত অধ্যাপিকা নবনীতা দেবসেনের একটি লেখা থেকে জানা গেল, দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদেরও একই রকম লড়াই করতে হয়েছে৷ তিনি লিখেছেন,
‘… গোপাল গান্ধীর কাছে শুনেছিলুম, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আদর্শগত সূত্রপাত সোয়েটোয়৷ সোয়েটো ছিল সোনার খনির শ্রমিকদের বসতি৷ শুনতে আফ্রিকান শব্দের মতো, কিন্তু সোয়েটো আসলে আফ্রিকান শব্দ নয়, এসওডব্লিউইটিও, সাউথ ওয়েস্টার্ন টাউনশিপ থেকে প্রথম দুটো করে অক্ষর নিয়ে বানানো৷ এ দেশে সব শহরের বাইরেই এরকম অচ্ছুৎপল্লি আছে কালো শ্রমিকদের, তাদের নাম টাউনশিপ, মানে কুলি বস্তি৷ ….. ১৯৭৫ সালে ওই সোয়েটোতে গুলি চলেছিল, রক্তপাত হয়েছিল ছাত্রদের বিপ্লব রুখতে৷ সরকার থেকে একটি শিক্ষানীতি তৈরি হয়েছিল যে, শুধু সাদারাই ইংরেজিতে শিক্ষা পাবে, কালোদের পড়ানো হবে আফ্রিকান ভাষাতে৷ এদিকে ইংরেজি শিক্ষা যারা পাচ্ছে, তাদের ভাষা সর্বত্রগামী, আর বহির্বিশ্বের সঙ্গে আফ্রিকান ভাষার সাংস্কৃতিক দূরত্ব অপরিসীম৷ দু’টিতে তুলনা করা চলে না৷ সাদা ছাত্ররা উন্নততর শিক্ষা পাবে, পৃথিবী তাদের সামনে খুলে যাবে, আর কালো ছাত্ররা বন্দি থাকবে আফ্রিকান ভাষার শেকলে, দক্ষিণ আফ্রিকায়৷ এ চলতে পারে না৷ ঠিক করা হল এক মৌন মিছিল বেরবে সব স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে, হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে, তাতে লেখা থাকবে– ‘অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চাই’, ‘আমরাও ইংরেজি পড়তে চাই’ ইত্যাদি৷
আমাদের সারথি জানেন, তিনি বললেন, স্কুল থেকে ছাত্ররা বেরল, সেদিন সবচেয়ে ভাল পোশাক পরে এসেছিল তারা, যাতে দেখে সম্ভ্রান্ত বলে মনে হয় তাদের৷
শোভাযাত্রা রওনা হয়েছে, পুলিশ এসে বলল, ‘থামো’৷ ছেলেমেয়েরা এগিয়ে চলল, নিঃশব্দে৷ পুলিশ বলল, ‘থামো’৷ ছাত্ররা নির্ভয়ে এগিয়ে চলল৷ পুলিশ গুলি চালাল৷ প্রথমেই লুটিয়ে পড়ল হেক্টর পিটারসন, ১১ বছরের কিশোর৷ তাদের অপরাধ, তারা উচ্চশিক্ষার সুযোগ চেয়েছিল৷ শোভাযাত্রা ছারখার হলেও অন্তর্লোকের যাত্রা থামেনি, শুরু হয়ে গেল ভাষা বিপ্লব, আর স্বাধীনতার প্রবল আকাঙক্ষা৷ আরও প্রায় ২০ বছর, ১৯৯৪ পর্যন্ত চলেছিল সেই ছাত্রদের রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ, তার রূপ পাল্টে যেতে লাগল, যতদিন না অ্যাপারথেইড (বর্ণবিদ্বেষী শাসনব্যবস্থা) সম্পূর্ণ উঠে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে, আর নেলসন ম্যান্ডেলা প্রেসিডেন্ট হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার৷ অসম শিক্ষাপ্রণালীর বিরুদ্ধে আন্দোলন নেমেছিলেন নানা অঞ্চলের শ্রমিক পল্লির কালো মানুষ, নারী–পুরুষ–শিশু–কিশোর নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছিলেন অন্ততপক্ষে ৫৭৫ জন৷ আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির কথা জানি, ৬ জন, ১৯–মে–র কথাও জানি ১১ জন– কিন্তু জানি না দক্ষিণ আফ্রিকার হিসেবটা৷ ৫৭৫ জন৷ দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তির মূলে কিন্তু এই দীর্ঘস্থায়ী ভাষা আন্দোলন৷ ওরা চেয়েছিল বহির্বিশ্বের চাবি৷’
(৭১ বর্ষ ৫ সংখ্যা ৩১ আগস্ট, ২০১৮)