২১ জুন নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে দলীয় সভায় মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন– গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, তোলাবাজি বরদাস্ত করা হবে না৷ এর দ্বারা দলে তোলাবাজি রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন৷ যদিও তা ০.১ শতাংশ লোকের বেশি নয় বলে তিনি ক’দিন আগেই দাবি করেছিলেন৷
অথচ সেই তোলাবাজি বন্ধ করার কথা দেড় হাজার নেতা–কর্মীর সামনে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে হচ্ছে৷ তিনিই আবার বলেছেন, শ্রমিক সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে৷ টিএমসিপি–কে স্মরণ করাতে হচ্ছে, ছাত্র রাজনীতি করা মানে ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করা, টাকা তোলা নয়৷
তাঁর দল কি এখনই দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে, না মুখ্যমন্ত্রীর হঠাৎ উপলব্ধি হয়েছে যে পচা শামুকে তাদের নেতাদের পা কাটছে? এটা তো হঠাৎ গজানো সমস্যা নয়৷ তিনি জানেন, দলের নেতাদের স্তরে স্তরে তোলাবাজি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব৷ জেনেও তিনি তাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন৷ না হলে ভোটে জেতা যাবে না৷ তোলাবাজি করা, তোলার ভাগ নিয়ে কাড়াকাড়ি করা, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কাজে লাগিয়েই তিনি কিছুদিন আগের পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন৷ বিরোধী দলের প্রার্থীদের শাসানি দেওয়া থেকে শুরু করে তাদের প্রার্থীপদ প্রত্যাহারে বাধ্য করার জন্য তাঁদের সমস্ত অসৎ উপায় তিনি ‘ক্ষমার চোখে’ দেখেছেন৷ তখন তোলাবাজি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বরদাস্ত করব না বলা সহজ হত না, কিন্তু এখন বললে অসুবিধা নেই, বরং সুবিধা ঢের৷ সাধারণ মানুষকে বোঝানো সহজ হবে, তিনি কত সৎ রাজনীতি করেন তাঁর দলে সততা কতটা গুরুত্ব পায়!
যে টিএমসিপি–কে মুখ্যমন্ত্রী তোলাবাজি না করার পরামর্শ দিয়েছেন, তাদের ছাত্রনেতারা বারাসাত রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত দুটি কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ কম টাকায় করিয়ে দেওয়ার নাম করে প্রচুর অর্থ ইতিমধ্যেই আত্মসাৎ করেছেন৷ এর ফলে দেড়শো ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় বসতে পারেনি৷ টিএমসিপি নেতাদের প্রতারণার বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসন কিন্তু চোখ বুঁজে থেকেছে৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য ছাত্রছাত্রীদের চাপে একজন গ্রেপ্তারও হয়েছে৷ প্রতারিত ছাত্রদের চোখের জল মুখ্যমন্ত্রী কি দেখেননি?
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা–নেত্রীরা এখন বারাসাতের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে ঝেড়ে ফেলতে বলছেন সে তাদের কেউ নয়৷ কিন্তু কলেজে কলেজে ভর্তি হতে গেলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ টাকা টিএমসিপি পরিচালিত ছাত্রসংসদের নেতা–নেত্রীরা চাইছেন, তাঁরাও কি দলের কেউ নয়? শ্রমিক সংগঠন থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে, পুরসভার প্রতিটি স্তরে তোলাবাজি, দুর্নীতি চলছে, এসব কি মুখ্যমন্ত্রীর অজানা? কারও বাড়ি তুলতে গেলে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের মোটা টাকা না দিলে কাজই করতে দেওয়া হয় না৷
রাজ্যের সর্বত্র ইমারতি দ্রব্য সরবরাহের সিন্ডিকেট গড়ে জুলুম চালিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা তোলা তুলছেন তৃণমূল নেতারা৷ রাজ্যের নদীগুলি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার বালি তুলে বিক্রি করছেন নেতারা৷ উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গের প্রতিটি জেলায় তৃণমূলের টাকার ভাগ নিয়ে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ৷ তাহলে একটা মিটিং ডেকে কিছুজনকে ধমক দিয়ে, দুর্নীতি করতে বারণ করে এই ধরনের বিপজ্জনক প্রবণতা বন্ধ করা যায় কি, বিশেষত যেখানে টাকার ভাগ–বাঁটোয়ারাই দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ?
তিনি কি তোলাবাজি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, দুর্নীতি বন্ধে সত্যিই আন্তরিক? এর আগেও বেসরকারি হাসপাতালে–সুস্কুলে বিপুল চার্জবৃদ্ধি নিয়ে যখন মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন, তখনও সেগুলির কর্তাব্যক্তিদের ডেকে টিভি ক্যামেরার সামনে ধমক–ধামক দিয়ে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন, তিনি এগুলিতে বিশাল অঙ্কের চার্জ নিয়ে সত্যিই চিন্তিত কিন্তু বর্তমান অবস্থা কী? হাসপাতালগুলির দশা যা ছিল, তাই রয়েছে৷ কর্তৃপক্ষের মর্জিমতো বিপুল অঙ্কের বিল মেটাতে বাধ্য হচ্ছে রোগীর পরিবার৷ স্কুলগুলিও অবাধে ফি বাড়াচ্ছে৷ সেরকমই তোলাবাজি, গোষ্ঠীবাজি করা যাবে না বলে মুখ্যমন্ত্রীর হুঙ্কারে কী আদৌ কাজ হবে?
(৭০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা ৬ জুলাই, ২০১৮)