তৃণমূল কংগ্রেসের এক শ্রেণির নেতা–কর্মী যে তোলাবাজির সঙ্গে যুক্ত তা সাধারণ মানুষের জানাই ছিল৷ ভুক্তভোগী মানুষ এই তোলাবাজিতে অতিষ্ঠ, বিরক্ত, কোথাও কোথাও আতঙ্কিত৷ এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের সামনে পড়ে তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছেন রাজ্যের বিরাট সংখ্যক মানুষের তৃণমূল সরকার সম্পর্কে ক্ষোভের অন্যতম কারণ নেতা–কর্মীদের তোলাবাজি এবং দুর্নীতি৷ এই অবস্থাতেই তিনি দলীয় এক কর্মীসভায় বলেছেন, ‘দুর্নীতি বরদাস্ত করব না’, ‘চোরদের দলে রাখব না’৷
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীকে জবাব দিতে হবে, দলে চোরেরা ঢুকলো কী করে? নাকি ভাল লোকেরা ঢুকে চোর হয়ে গেছে? পরিবর্তনের আকাঙক্ষায় তৃণমূলকে সমর্থন করা রাজ্যের জনগণ যখন অবাক বিস্ময়ে দেখছিল বানের জলের মতো সিপিএমের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা–কর্মীরা তৃণমূলে ঢুকছে, সেদিন কিন্তু তৃণমূল নেত্রী চুপ করেই ছিলেন৷ এ কি শুধু তৃণমূল শাসনেরই বৈশিষ্ট্য? সাম্প্রতিক অতীত যাঁরা ভোলেননি, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে দুর্নীতি–তোলাবাজি–স্বজনপোষণ-কমিশন খাওয়া–প্রোমোটিং–সিন্ডিকেট রাজ ইত্যাদি যে সব সামাজিক ব্যাধি তৃণমূলের হাত ধরে আজ মহীরুহ, সবই ৩৪ বছরের সিপিএম শাসনে ছিল অতিমাত্রায় সক্রিয়৷ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, মাঝেমধ্যে শুদ্ধকরণের মন্ত্র আওড়াতেন৷ এখন যেমন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী শুদ্ধকরণের ঢঙে বলছেন, চোরেদের দলে রাখবেন না৷ কিন্তু এই হুঙ্কারে কি দুর্নীতি বন্ধ হবে?
বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ তৃণমূলের এই দুর্নীতি নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই কটাক্ষ করতে ছাড়েননি৷ কিন্তু এ রাজ্যে ক্ষমতায় না আসতেই তারাও দুর্নীতিতে হাত পাকিয়ে ফেলেছেন৷ গ্যাসের ডিলারশিপ পাইয়ে দেওয়ার ভুয়ো প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা নেওয়া, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ঘর পাইয়ে দেওয়ার নাম করে বিজেপি নেতা–কর্মীদের টাকা তোলার বিষয়টি কিছুদিন আগে প্রকাশ্যে এসেছিল৷ অন্য দল থেকে দুর্নীতি এবং নানা অপরাধে যারা বহিষ্কৃত হচ্ছে, তাদের তো তারা আদর করে দলে নিচ্ছেন৷ ক্ষমতায় আসার আগেই যারা এমন বাঁধনহারা, ক্ষমতায় এলে তাদের দুর্নীতি যে কত মাত্রাছাড়া হবে, ভাবলে গা শিউরে ওঠে৷
দুর্নীতি কেন এইসব দলের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে? একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, এইসব দল দুর্নীতিকে আশ্রয় করেই প্রভাব বিস্তার করছে বা করেছে৷ আমার দল করলে এই এই সুবিধা পাবে, ওই দল ছেড়ে এলে বাড়তি এই এই সুবিধা মিলবে– এই মন্ত্রেই এইসব দল কর্মী–সমর্থক সংগ্রহ করে৷ এরা কখনওই বলে না, আমার দলের আদর্শ অন্য দলের থেকে ভাল, সামাজিক সমস্যাগুলি দূর করার উপযোগী আদর্শ, সমাজের অগ্রগতির স্বার্থে এই আদর্শ গ্রহণ কর৷ এই দলগুলির লক্ষ্যে সামাজিক স্বার্থ নেই, ব্যক্তিস্বার্থই মূল৷ ফলে এদের জীবনে সামাজিক স্বার্থের জন্য ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করার আবেদন নেই৷ এরা রাজনীতিতে এসে সুবিধালাভের পাঠ নেয়৷ ব্যক্তিগত লাভ, ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের জন্য সহজেই নানা অন্যায়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়৷ ঊর্ধ্বতন নেতারা ভোটের স্বার্থে এসব জেনেও প্রশ্রয় দেন এবং নেহাত না ঠেকলে এর বিরুদ্ধে ভুলেও মুখ খোলেন না৷
সকলেই জানেন, দল হিসাবে তৃণমূল, বিজেপি, শোষণমূলক এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থারই রক্ষক৷ পুঁজিপতিদের স্বার্থে, পুঁজিপতিদের টাকায় এই সব দলের উদ্ভব, বিকাশ–বিস্তার৷ বামপন্থী বুলি আওড়ালেও সিপিএম–ও যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থারই উপাসক, তিন রাজ্যে তাদের দীর্ঘ শাসনে তার প্রমাণ দিয়েছে তারা৷ যে পুঁজিবাদ নিজেই একটা দুর্নীতিমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, শোষণ–লুন্ঠন–প্রতারণা-বঞ্চনা-ঠগবাজি-জালিয়াতি ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ মুনাফা লোটাই যে পুঁজিবাদের মূল উদ্দেশ্য, সেই পুঁজিবাদের পক্ষে যারা কাজ করবে, তারা দুর্নীতিগ্রস্ত না হয়ে পারে না৷ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এখন বলছেন, চোরেদের তিনি দলে রাখবেন না৷ তাঁর পূর্বসূরী এক মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, চোরেদের মন্ত্রীসভায় তিনি থাকবেন না৷ কিন্তু রাজ্যের মানুষ দেখেছেন গর্জনই সার৷
তৃণমূল থেকে বিতাড়িত নানা দুর্নীতিগ্রস্ত লোককে এ বারের নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী করেছে, নেতা বানাচ্ছে৷ এসব নিয়ে সমালোচনা উঠতেই বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় বলেন, ‘তৃণমূল দলটা কয়লা খাদান৷ সেখান থেকে হিরেগুলো আমরা নিচ্ছি৷’ এসব থেকেই প্রমাণিত বিজেপি কেমন ধরনের দল৷ রাজনীতি এখন এইসব দলের চক্রে পড়ে দুর্নীতির রাহুগ্রাসে৷ তা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে হবে৷
রাজনীতিকে বাদ দিয়ে সমাজ চলবে না৷ সমাজ কীভাবে চলবে, দেশ কী নীতি গ্রহণ করবে, সবই ঠিক করে রাজনীতি৷ তাই রাজনীতির সঙ্গে দুর্নীতির এই মাখামাখি দেখে রাজনীতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিরূপ মনোভাব নেওয়া চলে না৷ প্রয়োজন হল দুর্নীতির চক্র থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করা৷ আর এটা করতে পারে দুর্নীতির উৎস এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা উন্নততর আদর্শ নিয়ে লড়াই করছে যে দল একমাত্র তারা৷ শোষিত নিপীড়িত সাধারণ মানুষকে নিজেদের স্বার্থেই এই রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে৷