এস ইউ সি আই ব্রিগেডে সমাবেশের ডাক দিয়েছে? একদম একা? জনৈক প্রবীণ ব্যক্তির এমন প্রশ্নের উত্তরে দলের এক কর্মী জানালেন, হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমরা একাই ডাক দিয়েছি এই সমাবেশের। এ কথা জেনে গভীর সন্তোষ প্রকাশ করলেন তিনি। বললেন, তোমাদের বড় হওয়াটা খুবই জরুরি ছিল। তোমরাই সরকারগুলোর অন্যায় নীতির প্রতিবাদ করো। বাকি সব তো একই মুদ্রার এ-পিঠ আর ও-পিঠ। বললেন, আমি যাব ব্রিগেড দেখতে।
৫ আগস্ট ব্রিগেড সমাবেশ নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহের এমন প্রকাশই দেখা যাচ্ছে সর্বত্র। এই ভাবেই প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে উঠে তাঁরা গভীর সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, যেন তাঁদের মনের কোণে দীর্ঘদিন লালন করা একটা আকাঙ্খাই বাস্তবে রূপ পেতে চলেছে ৫ আগস্ট।
উত্তর কলকাতার প্রাক্তন-শাসক দলের এক পদাধিকারী ব্রিগেড সমাবেশের খবর পেয়ে বললেন, জীবনের শুরুতে যে বামপন্থার স্বপ্ন দেখেছিলাম সে রাজনীতির চর্চা আপনাদের দলই করছে। আমাদের দল ব্যর্থ হয়েছে। কর্মীরা ব্রিগেডের জন্য বিরাট খরচের কথা বলতে তিনি যথাসাধ্য দিয়ে বললেন, আপনাদের কাগজটা নিয়মিত দিয়ে যাবেন।
ছোট মুদির দোকান। ব্রিগেডের প্রচারপত্রটি পেয়ে বললেন, কত টাকার কুপন আছে? কর্মীটি উত্তর দিতে তিনি একটি পঞ্চাশ টাকার নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এত বড় আয়োজনে তোমাদের তো অনেক টাকার দরকার।
এক কর্মী গিয়েছিলেন দক্ষিণ কলকাতায় এক পরিচিত বামপন্থী মানুষের কাছে। ব্রিগেডের খবর শুনে বিস্ময়ের সুরে বললেন, ব্রিগেডে মিটিং করতে তো কমপক্ষে তিন-চার লাখ লোক লাগবে! কর্মীটি বললেন, তিন-চার লাখ লোকই হবে। বললেন, কোথায় তোমাদের এত লোক? কর্মীটি বললেন, সেই জন্যেই তো আপনার কাছে এসেছি। আপনারা তো বামপন্থী পরিবার। সবাইকে যেতে হবে ব্রিগেডে। বললেন, দেখো, এক সময় গোটা পরিবারই আমরা সক্রিয় রাজনীতিতে ছিলাম। তারপর প্রায় ১৫-২০ বছর হয়ে গেল রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই। কত বার গিয়েছি ব্রিগেডে! কোথায় সে সব দিন! কর্মীটি বললেন, সে-দিন আবার আসছে। তা ছাড়া বামপন্থীদের মনে তো হতাশার কোনও জায়গা নেই। আপনাকে যেতেই হবে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমাদেরই তো এখন ব্রিগেড করা উচিত। তারপরে বললেন, আচ্ছা, যাব আমি।
প্রচার চলছিল বেহালার একটি এলাকায়। মাইকে ব্রিগেডে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন এক কর্মী। অন্যরা রাস্তায়, দোকানে প্রচারপত্র দিয়ে কথা বলছেন। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, অন্য দলের এক কর্মী। তাঁকে লক্ষ্য করে এক দোকনদার চিৎকার করে বললেন, এদের কাছ থেকে আন্দোলন করা শেখ। তোরা তো একটা কমিটির নির্বাচন করলেও দুর্নীতি করিস, আর এরা দেখ কেমন লড়তে লড়তে ব্রিগেডে পৌঁছে গেল।
গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের প্রখ্যাত এক প্রবীণ নেতা। বিজেপি সরকার দীর্ঘদিন তাঁকে জেলে আটকে রেখেছিল। ব্রিগেডের খবর দিতেই বললেন, অবশ্যই যাব প্রভাসবাবুর বক্তব্য শুনতে।
খ্যাতনামা এক অ্যানাসথেসিস্ট খবর পেয়ে বললেন, আচ্ছা, আমি কি গাড়ি নিয়ে যেতে পারব। দলের কর্মী অপেক্ষাকৃত জুনিয়র চিকিৎসকটি তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে, গাড়ি রাখার ব্যবস্থা থাকবে। বললেন, তবে আপনি ১২টার মধ্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করবেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না না ১২টা নয়, আমি ১১টার মধ্যেই পৌঁছে যাব। মিটিংয়ে আমি প্রথম থেকেই থাকতে চাই।
জাতীয় খ্যাতিসম্পন্ন এক প্রবীণ চিত্রশিল্পীকে দলের কর্মীরা আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলেন ব্রিগেডে যাওয়ার জন্য। দলের রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে যে আবেদনপত্রটি তৈরি হয়েছে, সেটি মন দিয়ে শুনে বললেন, ছোটবেলায় আমি কমিউনিস্টদের দেখেছি। তাদের প্রতি আমার খুব শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু যারা কথায় কমিউনিস্ট, অথচ রুচি উন্নত নয়, হৃদয় বড় নয়, তাদের প্রতি আমার কোনও শ্রদ্ধা নেই। প্রবীণ শিল্পীর কথায় যেন কমরেড শিবদাস ঘোষের কথারই প্রতিধ্বনি– বিপ্লবী রাজনীতি উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি। কমরেড শিবদাস ঘোষের প্রতি তাঁর অন্তরের গভীর শ্রদ্ধার প্রকাশ দেখা গেল তাঁর চোখেমুখে।
সর্বত্রই যেমন দলের কর্মীরা ব্রিগেডের খরচ তোলার জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন, তেমনই একটি কলেজে, অধ্যাপকদের মধ্যে অর্থ সংগ্রহ করার সময়ে এক অধ্যাপক, আর্থিক সাহায্য দিয়ে বললেন, তোমরা যে সকলের থেকে সাহায্য চাইছো, এটা কি ঠিক? তা হলে তো অন্য কোনও দল এলে তাদেরও সাহায্য করতে হবে। উপস্থিত কর্মীরা কিছু বলার আগেই পাশে বসা এক অধ্যাপক বললেন, আপনি যে ভাবে যুক্তি করলেন, আমার মনে হয় এটা ঠিক নয়। প্রথমত কোনও দলকে সাহায্য করা মানে সেই দলের সমর্থক হওয়া, কর্মী হওয়া নয়। আমার যদি সেই দলের কাজকর্ম ভাল লাগে তবে তাদের আমার আর্থিক সাহায্য করা উচিত। দ্বিতীয়ত, অন্য দলগুলির এ ভাবে অর্থ সংগ্রহ করার প্রয়োজন হয় না। শাসক দলগুলি যে ভাবে টাকা তোলে তা আমার আপনার সকলেরই জানা। এস ইউ সি আই-ই একমাত্র দল যারা এ ভাবে সাধারণ মানুষের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালায়।
কোচবিহারে দলের তরুণ কর্মীরা ব্রিগেডে যাওয়ার জন্য চাঁদা তুলতে বেরিয়ে একজনকে বললেন, কাকু, আমরা একটা ট্রেন নিয়ে ব্রিগেডে যাচ্ছি। ভদ্রলোক একশো টাকা দিয়ে বললেন, একটা ট্রেন নিয়ে যাচ্ছি বলবে না। বলবে, ট্রেনে যাচ্ছি। কর্মীরা যখন তাঁকে জানালেন, কোচবিহার জেলা থেকে সত্যিই একটা আস্ত ট্রেন ভাড়া করা হয়েছে তখন তাঁর বিস্ময় যেন শেষ হতে চায় না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে আরও কিছু টাকা বের করে কর্মীদের দিয়ে বললেন, তোমরা পরে আবার এসো। ওই শহরেরই একটি বাম দলের বর্তমান এক কাউন্সিলার চাঁদা দিয়ে বললেন, আমরা যা করতে পারিনি, তোমরা তা করে দেখাচ্ছ। সেই জন্য তোমাদের লাল সেলাম। বললেন, আমরা চাই বামপন্থী দলগুলির ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। কিন্তু আমাদের নেতারা তো তাতে রাজি নয়।
হুগলির একটি এলাকায় পূর্বতন শাসক বাম দলের এক কর্মীকে ব্রিগেডের আমন্ত্রণ জানানোয় বললেন, পুঁজিপতিদের দল কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়াটা একেবারে মেনে নিতে পারিনি। তা ছাড়া ক্ষমতায় থাকার সময়ে দেখেছি, গরিব মানুষকে বঞ্চিত করে নেতারা কী ভাবে চাকরি এবং অন্য সুযোগ-সুবিধা আত্মীয়-ঘনিষ্ঠদের দিয়েছে। বললেন, দল ছাড়লেও আমি বামপন্থীই আছি। আমি ব্রিগেডে যাব।
পূর্ব বর্ধমানের একটি বামপন্থী দলের জেলা কমিটির এক সদস্য আর্থিক সাহায্য দিয়ে বললেন, আপনারাই যথার্থ বামপন্থী দল। আপনাদের বৃদ্ধি এবং শক্তির উপরই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। বললনে, আমি আপনাদের সঙ্গে আছি।
জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ এলাকায় ৮৫ বছর বয়সী কমরেড লস্কর রায়। দু’জন কর্মী তাঁর বাড়িতে গিয়ে ব্রিগেড কর্মসূচির কথা বললে তিনি তার চার ছেলেকে ডেকে বলেন, আমি তো জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পৌঁছেছি। তোমাদের মধ্যে দলের ঝাণ্ডাকে কে বহন করবে? বড় ছেলে অতুল এগিয়ে এসে বললেন, আমিই এই ঝান্ডা বহন করব। কমরেড অতুল এলাকার বেশ কিছু মানুষকে নিয়ে ব্রিগেডে আসার পরিকল্পনা করেছেন।
পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে গ্রামে গ্রামে প্রচার চলছে। সদ্য নির্বাচনে এক নির্দল জয়ী ব্যক্তি ২০০ টাকা চাঁদা দিয়ে বলেন, আমরা সবাই এবার ব্রিগেডে যাব। আপনাদেরকেই একমাত্র ভরসা করা যায়।
শিলিগুড়ির টিকিয়া পাড়ায় কর্মীদের আলোচনা শুনে এক মহিলা উদ্যোগ নিয়ে বেশ কিছু সভার আয়োজন করেন। জেলার এক পরিচারিকা সংগঠক তাঁর জমানো টাকার পুরোটাই ব্রিগেডের খরচের জন্য দিয়ে দিয়েছেন।
সাধারণ মানুষের এই ভরসার উপর গভীর আস্থা থেকেই দল ব্রিগেড সমাবেশের ডাক দিয়েছে। সেই সমাবেশকে সফল করতে সাধারণ মানুষও তাই সর্বত্রই দলের কর্মীদের সহযোগীর ভূমিকা নিচ্ছেন।