কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী সম্প্রতি সরকারি কোষাগারথেকে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানিগুলিকে ২২ হাজার কোটি টাকা দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। এই টাকা দিয়ে তারা আগামী দিনে সম্ভাব্য লোকসান সামাল দেবে। কিন্তু কেন লোকসান?
একটানা বাড়তি দামের পর গত দুই মাসে বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম নামছে। ব্যারেল প্রতি ১২০-১৩০ ডলার থেকে এখন ৮২-৮৪ ডলারে দাম নেমে এসেছে। তা আরও কমছে। দামের পতন ঠেকাতে তেল উৎপাদক দেশগুলোর সংগঠন ওপেক উৎপাদন ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ ভারতে এখনও তার কমার কোনও লক্ষণ নেই। সরকারের মতলব যা বোঝা যাচ্ছে, তারা দাম বাড়ানোর জন্যই আছে। দাম কমানোর ব্যাপারে নেই। তা হলে লোকসানের বদলে বিপুল লাভই তো করেছে তেল কোম্পানিগুলি! সরকার এখন অজুহাত করছে ওপেকের উৎপাদন কমানোর ঘোষণাকে। কিন্তু তা শুরু হতেও দেরি আছে। আদৌ উৎপাদন কমবে কতটা তা নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে।
গত এপ্রিল থেকে ভারত সরকার এবং তেল কোম্পানিগুলি ক্রমাগত তেলের দাম বাড়িয়ে চলছিল। বাড়তে বাড়তে তা পেট্রলে ১৩০ টাকা লিটার এবং ডিজেলে ১১০ টাকার বেশি দাঁড়িয়ে যায়। এলপিজি বা রান্নার গ্যাসের দামও ১২০০ টাকার কাছাকাছি, এমনকি গরিব মানুষের জ্বালানি কেরোসিন ১০০ টাকা লিটার। অজুহাত ছিল বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম বাড়ছে, তাই তেল আমদানি করতে খরচ বেশি পড়ছে। অথচ ২০২০-২১ দুই বছর ধরে বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম একেবারে তলানিতে ঠেকেছিল তখন কি তেলের দাম ভারতে কমেছিল? উত্তরটা জানা, কমা দূরে থাক সেই সময় ভারত সরকার ক্রমাগত উৎপাদন শুল্ক এবং সেস ও অন্যান্য কর বাড়িয়ে তেলের দাম কমতে দেয়নি। অথচ বিশ্ববাজারে তা একটু বাড়তেই দেশে তা বেড়েছে চড়চড় করে। আবার যখন তেলের দাম কমতে শুরু করেছে তখনও সরকার ভারতে তা কমতে দিচ্ছে না। সাধারণ মানুষের ঘাড়ে এমনিতেই সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিপুল বোঝা চেপে আছে। তার ওপর তেলের এই বাড়তি দাম সে বোঝাকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক যুক্তি দিচ্ছে ওপেক তেল উৎপাদন কমালে অশোধিত তেলের পড়তি দাম আবার বাড়বে। তখন তেল কোম্পানির ক্ষতি হবে, অথচ গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন থাকায় এখনই দাম বাড়ানো সমস্যার। অতএব জনগণের পয়সায় তেল কোম্পানিকে ভর্তুকি দেওয়া হবে।
সরকার যে সত্যটা চেপে যাচ্ছে, প্রথমত, বাড়তি দাম থাকাকালীন অতি সস্তায় রাশিয়া থেকে অশোধিত তেল আমদানি করেছে রিলায়েন্স কিংবা আদানি গোষ্ঠীর তেল কোম্পানিগুলি। এই তেল তারা নিজেদের শোধনাগার থেকে সরাসরি বিদেশে চড়াদামে বেচেছে। দেশের মানুষ এই সস্তা তেলের নাগাল পায়নি। দ্বিতীয়ত, কোনও তেল কোম্পানি একদিনের জন্য হলেও লোকসান করেছে এ তথ্য ডাহা মিথ্যে। লোকসানের যে গল্প তারাশোনায়, তা হল তেল ব্যবসার পরিভাষায় ‘আন্ডার রিকভারি’। অর্থাৎ তাদের হিসাবে যতটা দাম তারা পেতে চায় তার থেকে যতটা আদায় কম হবে সেটাকেই বলা হচ্ছে ক্ষতি। এর সাথে বাস্তবের ক্ষতির কোনও সম্পর্ক নেই। এই হিসাবের ফলেই কোম্পানিগুলো খুশিমতো তেলের দাম বাড়ায়। এর সাথে যুক্ত করা হয় ইম্পোর্ট এবং এক্সপোর্ট প্রাইস প্যারিটি। এর মানে হল দেশে উৎপাদিত তেল এবং গ্যাসকেও আমদানিকৃত হিসেবে দেখিয়ে আমদানির খরচ, কাস্টমস, বন্দরের খরচ, এক্সাইজ ইত্যাদি সব কর দিতে হয়েছে বলে কোম্পানি দেখায়।
ফলে বাস্তবের থেকে অনেক বেশি উৎপাদন খরচ দেখিয়ে কোম্পানিগুলি তেল গ্যাসের দাম ঠিক করে। আবার দেশের অভ্যন্তরে তেল বেচার সময় কাজে লাগে এক্সপোর্ট প্রাইস প্যারিটি। সব তেলটাই রপ্তানি হচ্ছে দেখিয়ে নানা খরচ হয়েছে, কর দিতে হয়েছে দেখানো হয়। অথচ সবটাই মনগড়া। এভাবে কার্যত জনগণকে প্রতারণা করে তেল কোম্পানিগুলি লুটের কারবার চালায়। সরকার তার সহযোগী। কারণ সরকার যেমন যথেচ্ছ কর বসিয়ে তেল গ্যাস থেকে ৩ লক্ষ কোটি টাকা আদায় করে। সেই টাকা সরকার জনকল্যাণের নাম করে কর্পোরেট করে ছাড় দেয়, পুঁজিপতিদের নানা ছাড় ও উপহার দেয়। এখন আবার ২২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হবে কোম্পানিদেরই। অথচ জনগণের জন্য গ্যাস তেলের সব ভর্তুকি বন্ধ।
সরকার টাকার অভাবের অজুহাত দেখিয়ে ১০০ দিনের কাজ, শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কমাচ্ছে। অথচ যে সব তেল কোম্পানি বছরে ২৪ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেছে তাদের মিথ্যে লোকসানের গল্প শুনিয়ে জনগণের ঘাড়ে নতুন কোপ বসানোর ষড়যন্ত্র চলছে। লোকসান পোষাতে আবার বাড়বে তেল গ্যাসের দাম। এখনই এই লুটের কারবারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার।