তেল কোম্পানিগুলির বিপুল মুনাফাই গ্যাসের অগ্নিমূল্যের কারণ

 

 

রান্নার গ্যাসের দাম এক-দু টাকা করে নয়, ৫০ টাকা করে বাড়ানো এখন রেওয়াজে পরিণত করেছে বিজেপি সরকার। গত মার্চ থেকে চার দফায় সরকার দাম বাড়াল ১৫০ টাকা। ফলে বর্তমানে দাম দাঁড়িয়েছে ১০৭৯ টাকা। এত দামে গ্যাস কেনা সমাজের বড় অংশের মানুষের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। গ্যাস কিনতে না পারার জন্য উনুনে ফিরে যাওয়া বা গ্যাসের খরচ কমাতে গিয়ে দিনে দু’বেলা গরম ভাত খাওয়ার কথা ভুলে যাচ্ছে অনেকেই উজ্জ্বলা যোজনার গ্রাহকদের বেশিরভাগেরই একসঙ্গে ১১০০ টাকা জোগাড় করার ক্ষমতা নেই। তাদের বেশির ভাগই গ্যাস কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন। উত্তরবঙ্গের কালচিনি চা বাগানের শ্রমিকরা উজ্জ্বলা গ্যাসের সিলিন্ডার, ওভেনে ‘ফর সেল’ স্টিকার লাগিয়ে প্রতিবাদে পথে নেমেছেন।

মানুষ ক্ষুব্ধ হবে না কেন? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার সময়ে এক সিলিন্ডার গ্যাসের জন্য খরচ করতে হত ৪১০ টাকা। ১২৭০ টাকা নগদে কিনে ভরতুকি পাওয়া যেত ৮৬০ টাকা। এখন খরচ করতে হচ্ছে ১০৬০ টাকা (১৯.৫৭ টাকা ভরতুকি ধরে)। ডাইরেক্ট ক্যাশ ট্রান্সফারের স্বপ্ন দেখিয়ে জনগণকে বোকা বানিয়ে ভর্তুকির ক্যাশটাই প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা হল। সবার মনে আছে গ্যাস সংযোগের সাথে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট যোগ করার সময়ে বলা হয়েছিল, নগদে দাম বাড়লেও গ্রাহকদের অসুবিধা হবে না। কারণ বাড়তি দামটা ভরতুকি হিসাবে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। এটা কি দেশের মানুষের সঙ্গে নির্লজ্জ প্রতারণা নয়?

সরকার এমন একটি সময়ে অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানি হিসাবে গ্যাসের দাম বাড়াল যখন লকডাউনে কাজ হারিয়ে বিরাট অংশের মানুষের রোজগার তলানিতে চলে গেছে। মানুষ দু’বেলা কী খাবে, তা-ই ভেবে পাচ্ছে না। তার উপর গ্যাসের লাগাতার দামবৃদ্ধি মানুষের উপর ভারী বোঝা হিসাবে নেমে এসেছে। তেলমন্ত্রী বলেছেন, গ্যাসে ভরতুকির আশা আর না করাই ভাল। অথচ সরকার দেশের শিল্পপতি-পুঁজিপতিদের দেদার ভরতুকি দিয়ে চলেছে। মন্ত্রীর এই ‘জ্ঞানবাণী’ শুধুমাত্র দরিদ্র-সাধারণ মানুষের বেলায়। তাই তেল কোম্পানিগুলি রাশিয়া থেকে জলের দামে অশোধিত তেল কিনে সীমাহীন মুনাফা করলেও তার কোনও সুবিধা দেশের মানুষ পায় না। লকডাউনে মানুষ কাজ হারিয়ে যখন অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটিয়েছে তখনও তেল কোম্পানিগুলি আস্বাভাবিক পরিমাণে লাভ করেছে। অন্য দিকে তেলমন্ত্রী তাদের লোকসানের মিথ্যে গল্প দেশের মানুষকে শুনিয়ে যাচ্ছেন। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এই সরকার তা হলে কাদের স্বার্থ রক্ষা করছে? জনগণকে চরম দুরবস্থার দিকে ঠেলে দিয়ে শুধুমাত্র পুঁজিপতিদের স্বার্থ দেখে যে সরকার, আর যা-ই হোক তাকে জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার বলা যায় না। প্রশ্ন হল, ভর্তুকি কেন দেওয়া হয়? দেওয়া হয় এই কারণে যে, দেশের বিরাট অংশের মানুষ দরিদ্র, আর্থিক ভাবে দুর্বল। খাদ্য, জ্বালানি প্রভৃতি প্রয়োজনে যদি সরকার তাদের পাশে না দাঁড়ায় তবে তাদের পক্ষে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। সেই অবস্থায় মানুষকে খানিক সুরাহা দিয়ে জনবিক্ষোভ স্তিমিত করার লক্ষ্যেই ভর্তুকির প্রচলন হয়েছিল। তা ছাড়া আর একটি বিষয়ও ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি জনস্বার্থে যে ভূমিকা নিত, তার ছিটেফোঁটাও যদি পুঁজিবাদী দেশগুলি না নেয়–তা হলে এই সব দেশের মানুষের সমাজতন্ত্রের দিকে ঝোঁকার সম্ভাবনা ছিল। এটা আটকানোও ছিল ভর্তুকি প্রচলনের আর একটি কারণ। তা হলে সেই ভর্তুকি আজ উঠে যাচ্ছে কেন?

প্রথম কারণ, পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট। বাজার সঙ্কট। এই সঙ্কট থেকে সাময়িকভাবে হলেও মুক্তি পেতে যে বিশ্বায়ন উদারিকরণের নীতি বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলি গ্রহণ করে ১৯৯০-এর দশকে, তারই অন্যতম শর্ত ছিল ভরতুকি কমাও, পারলে বন্ধ কর কিন্তু ত্রাণ প্যাকেজের নামে পুঁজিপতিদের যথেচ্ছ ভরতুকি দিয়ে তাদের সীমাহীন মুনাফার ব্যবস্থা করে দাও। এই ফর্মুলাই মেনে চলেছে পূর্বতন কংগ্রেস সরকার। এখন মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার আরও প্রবল ভাবে তা কার্যকর করছে।

দ্বিতীয় কারণ, গণআন্দোলনের বিশেষ করে বামপন্থী আন্দোলনের দুর্বলতা। শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতা। এ রাজ্যের পূর্বতন সিপিএম সরকার, বিশ্বায়নের সুফল নিতে হবে, সব কিছুর ভাল দিক আছে, খারাপ দিক আছে – এ’সব বলে পুঁজিবাদী বিশ্বায়নকে শ্রমজীবী মানুষের কাছে সহনীয় করার চেষ্টা করেছে। বিশ্ব পুঁজিবাদ তার বাজার সঙ্কটের হাত থেকে সাময়িকভাবে মুক্তির জন্য যে স্কিম এনেছে, তা যে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থে নয়, তার স্বরূপ উদঘাটন করে দিয়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য শ্রমিক শ্রেণিকে প্রস্তুত করার কাজটি তারা কৌশলে এড়িয়ে গেছে। প্রধানত এই দুটি কারণের জন্যই সরকার বেপরওয়া ভাবে জনস্বার্থে ভরতুকি কমাতে পারছে।

কিন্তু পেট বড় বালাই। তাই প্রতারিত মানুষ রাস্তায় নামবেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ার সাথে গ্যাসের দাম হাজার ছাড়িয়ে পরিস্থিতিকে সেই দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। ফলে আর চুপ করে থাকা নয়। পথে ঘাটে বাসে ট্রেনে চায়ের দোকানে সর্বত্র সরকারের এই জনবিরোধী চরিত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। প্রতিবাদে মুখর হতে হবে। সামিল হতে হবে প্রতিবাদী আন্দোলনে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ৪৭ সংখ্যা ১৫ জুলাই ২০২২