প্রবল গণঅসন্তোষের সামনে পড়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার পেট্রল এবং ডিজেলের উপর চাপানো চড়া হারের উৎপাদন শুল্ক সামান্য একটু কমিয়েছে। তাতেই বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা দীপাবলির উপহার বলে একেবারে দু’হাত তুলে শোরগোল শুরু করেছেন। সরকার দাম কমিয়েছে পেট্রলে ৫ টাকা আর ডিজেলে ১০ টাকা। এর ফলে রাজ্য ভ্যাট কিছুটা কমবে। এর ফলে সামগ্রিকভাবে পেট্রলে ৭ টাকা এবং ডিজেলে ১১ টাকার মতো করে কমছে। অথচ বিজেপি কেন্দ্রীয় গদি দখলের পর পেট্রলে উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়েছে ২৩ টাকার বেশি, ডিজেলে প্রায় সাড়ে ২৮ টাকা। এখন সামনে উত্তরপ্রদেশ সহ কয়েকটা রাজ্যের ভোট থাকায় জনমতকে বিভ্রান্ত করতে আপাতত তেলের কিছুটা দাম কমানোর কথা বললেও গ্যাসের হাজার টাকায় তারা হাত দেয়নি।
এ কথা সবাই জানেন যে বর্তমানে পেট্রলের ১০৬ টাকা দরে দামের অংশ মাত্র ৪৪ টাকা। বাকিটা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কর। কেন্দ্রীয় করই বেশি। এখন রাজ্যগুলোও কর কমাক, এই আওয়াজ বিজেপি তুলছে। অবশ্যই রাজ্য সরকারকে কর কমাতে হবে। কিন্তু কেন্দ্র কি যা করতে পারত তার পুরোটা করল? আদৌ না। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই আরও কয়েকবার দাম বাড়ানোর জন্য তেল কোম্পানিগুলো মুখিয়ে আছে। সরকার কি তা আটকাবে? তেল কোম্পানিগুলির দাবি মেনে পেCল এবং ডিজেলের দামে সব নিয়ন্ত্রণই তারা তুলে নিয়েছে। বিনিয়ন্ত্রণের শুরুটা অবশ্য কংগ্রেস করে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সবটাই লাগামছাড়া।
২০২০ সালের এপ্রিলে যখন অপরিশোধিত তেলের দাম ১৬ ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল সেই সময় ভারতে যাতে দাম অনেকটা না কমে তা নিশ্চিত করতে পেট্রলে ১০ টাকা এবং ডিজেলে ১৩ টাকা শুল্ক বাড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। এমনকি বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কার্যত শূন্যের নিচে নেমে যাওয়ার সময়েও দেশবাসীকে কম দামের সুবিধা দেওয়া দূরে থাক, তেল কোম্পানিগুলির বিপুল লাভ এবং সরকারি করের ভাগ বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের উপর দামের বোঝা তারা ক্রমাগত বাড়িয়েছে।
লক্ষণীয়, এবার দাম কমানোর সময় কেন্দ্রীয় সরকার সেস কমায়নি, কমিয়েছে এক্সাইজ ডিউটি। কারণ এক্সাইজের ভাগ পায় রাজ্যগুলি, সেসের ভাগ দিতে হয় না। ফলে রাজ্যকে দেয় টাকার পরিমাণ কমলেও কেন্দ্রীয় লাভে হাত পড়বে না। যদিও তেলে কেন্দ্রীয় করের বড় অংশই চেপে আছে সেস হিসাবে। রাস্তা ও পরিকাঠামো উন্নয়ন, কৃষি পরিকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি নানা নামের সেস কেন্দ্রীয় সরকার তেলের উপর চাপিয়ে রেখেছে। যে নামেই সেস চাপানো হোক না কেন, তা কি জনগণের উপকারে খরচ হয়েছে? একেবারেই না। বিজেপি সরকার এই তহবিলকে কাজে লাগিয়েছে একচেটিয়া পুঁজি মালিকদের কর মকুব করার কাজে। গত বছর তেল থেকে কেন্দ্রীয় সরকার আয় করেছিল ৩.৩৪ লক্ষ কোটি টাকা। এ বছরের লক্ষ্য ছিল ৪ লক্ষ কোটি টাকা। তার মাত্র ৪৫ হাজার কোটি সরকার ছেড়ে দিচ্ছে। এই আয়ের বড় অংশ গেছে করোনা কালে কর্পোরেট কর মকুব, বাড়তি ঋণ দিয়ে একচেটিয়া মালিকদের পুঁজি জোগানো ইত্যাদি কাজে।
তেলের চড়া দামের ফলে সাধারণ মানুষ মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার হয়েছে। ছোট পুঁজির ব্যবসা, কৃষকের নাভিশ্বাস উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণে বোঝা যায়নি যে তাদের এ নিয়ে কোনও মাথাব্যথা আছে। বরং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা একাধিকবার বলেছেন এমন কিছু দাম বাড়েনি যে চিন্তিত হতে হবে। কেন্দ্রের এক মন্ত্রী বলেছেন, তেলের বাড়তি শুল্ক থেকে বিজেপি সরকার বিনা মূল্যে টিকা দিচ্ছে। তাহলে পিএম কেয়ার্সের টাকাগুলো কোন কাজে অদৃশ্য হয়ে গেল সে প্রশ্নের উত্তর তাঁরা দিচ্ছে না কেন?
সাধারণ মানুষের ঘাড় ভেঙে সরকারের সাথেই মুনাফার পাহাড় বানাচ্ছে তেল কোম্পানিগুলি। রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ইন্ডিয়ান অয়েল গত বছর মুনাফা করেছে ২১ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। আম্বানিদের রিলায়েন্স মুনাফা করেছে ৩১ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানির মোট মুনাফা ৫০ হাজার কোটির বেশি। যা বিগত কয়েক বছরের বাৎসরিক মুনাফার কয়েক গুণ বেশি। অথচ দেশে করোনা মহামারিতে তেলের চাহিদা কমেছে ৯.১ শতাংশ। অর্থাৎ কম তেল বেচেও অনেক বেশি মুনাফা করেছে সরকারি বেসরকারি কোম্পানিগুলি। এর জোরে রিলায়েন্স সৌদি আরবের অ্যারামকোর সাথে গাঁটছড়া বেঁধে বিশ্ব বাজারে বড় শক্তি হয়ে উঠছে। আদানি কিংবা এসারের মতো কোম্পানিও বেশি বেশি করে ভারতের তেল বাজারে ভাল ব্যবসা জমিয়েছে। ভারত পেCলিয়ামকে এই সব ধনকুবেরদের হাতেই বেচে দিতে চাইছে সরকার। এই বিপুল মুনাফার ফাঁদে পড়ে জনসাধারণের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসছে। তাই এই সামান্য দাম কমানো, কিংবা রাজ্যগুলোর ভ্যাট কমানো প্রধান বিষয় নয়। আজ প্রধান প্রয়োজন তেল, গ্যাসের মতো জনজীবনের অত্যাবশ্যক পণ্যগুলিকে মুনাফার কবল থেকে মুক্ত করে জনমুখী রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য হিসাবে দেখা, প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে জনসাধারণের কাছে সস্তায় তা পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু তেল কোম্পানির বিপুল লাভ আর বাড়তি কর আদায়ের লোভে এ কাজ পুঁজিপতিদের সেবাদাস সরকার করবে না। করতে হলে জনমত সংগঠিত করে আন্দোলন গড়ে তুলে তার চাপে তাকে বাধ্য করতে হবে।