নির্বাচন একটি প্রহসন মাত্র, বিপ্লবই শোষণমুক্তির একমাত্র রাস্তা
বার্তা তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের
২৬ নভেম্বর, জামশেদপুরের সাকচি আমবাগান ময়দান থেকে সবে মাত্র শুরু হয়ে মিছিলটা গোল চক্করে ঢুকেছে৷ ভেসে এল একটা মন্তব্য– প্রায় ৩০ বছর বাদে লাল ঝান্ডার এতবড় মিছিল দেখছে জামশেদপুর৷ নানা ভাষা, নানা পরিধান, কিন্তু একই লক্ষ্যে অবিচল দৃপ্ত কণ্ঠস্বরগুলি তখন স্লোগান তুলছে, দুনিয়ার খেটে খাওয়া মানুষ এক হও৷ হাজার হাজার কণ্ঠ ছড়িয়ে দিচ্ছে, সারা দুনিয়ার মুক্তিকামী মানুষ যার স্বপ্ন দেখে–সেই শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের আহ্বান৷ মিছিল এগিয়ে চলল এস ইউ সি আই (সি)–র তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের প্রকাশ্য অধিবেশনস্থল বিষ্টুপুর জি টাউন ক্লাব ময়দান অভিমুখে৷ প্রায় স্তব্ধ জামশেদপুর শহর৷ রাস্তার দু’ধারে দাঁড়ানো অসংখ্য মানুষের চোখে গভীর প্রত্যাশা৷ মিছিল যে এত বিশাল হতে পারে তা কল্পনা করতে পারেনি বিজেপি সরকারের প্রশাসন৷ পূর্ব সিংভূমের জেলা কমিশনার ফোন করেছেন দলের এক রাজ্য নেতাকে৷ এত বড় মিছিল কোনও বামপন্থী দল ঝাড়খণ্ডের বুকে করতে পারে তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর৷ বললেন, আপনাদের এত লোক আছে, তাতে টাটানগর পুরো স্তব্ধ হয়ে যাবে তা ভাবতে পারিনি৷
বেলা ১২টার অনেক আগেই জি টাউন ক্লাব ময়দানে শুধু হাজার হাজার মাথা৷ সভা শুরু হতে না হতে মাঠ উপচে দুইপাশের রাস্তাও বন্ধ৷ পরদিনের স্থানীয় সংবাদপত্রের অভিমত অন্তত ৫০ হাজারের জমায়েত ছিল এই সমাবেশে৷ যদিও বাস্তবে ঝাড়খণ্ডের নানা এলাকা এবং আশপাশ থেকে সংগঠিত জমায়েতই ছিল ৫০ হাজারের বেশি৷ টাটানগরের বহু সাধারণ মানুষ এসেছিলেন শুনতে, কী বলে এস ইউ সি আই (সি)৷ কিন্তু মাঠে ঢোকার মতো জায়গা না পেয়ে পাশের রাস্তাতেই দাঁড়িয়ে শুনেছেন নেতাদের বক্তব্য৷ দুপুরের রোদে পুড়ছে মানুষ, তবু ছায়ার খোঁজে উঠে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারছেন না তাঁরা৷ বিষ্টুপুর থেকে স্টেশন যাওয়ার অটোচালক সুরেশের জিজ্ঞাসা– বিজেপি বলুন, কংগ্রেস বলুন, ঝাড়খণ্ড পার্টি বলুন, তারা মিটিংয়ে লোক আনতে পয়সা দেয়, মদ দেয়৷ আর আপনাদের লোকেরা নিজেদের পয়সা দিয়ে বাস ভাড়া করে দূর–দূরান্ত থেকে কেন এসেছেন? কী পাবেন? তাও এত লোক সকাল আটটা থেকেই জামশেদপুর প্রায় অচল হয়ে গেছে
শুরু হয়েছে সভা৷ অটো থেকে নেমে গভীর কৌতূহলে ভিড়ের পাশেই বসে পড়লেন সুরেশ মাহাতোর মতোই বেশ কয়েকজন অটোচালক৷ বোঝার চেষ্টা করছেন কমরেড প্রভাস ঘোষের ভাষণ৷ সমাবেশের অসংখ্য মানুষ বুঝে নিতে চাইছেন আসন্ন দিনগুলিতে কী করতে হবে তাঁদের৷
২১ থেকে ২৫ নভেম্বর ঘাটশিলার মার্কসবাদ–লেনিনব ঘোষ চিন্তাধারা শিক্ষাকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হল এস ইউ সি আই (সি)–র তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধি অধিবেশন৷ এ যুগের অন্যতম মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক কমরেড শিবদাস ঘোষ গড়ে তুলেছিলেন এই দলকে৷ সারা দেশ জুড়ে আজ ছড়িয়েছে দলের সাংগঠনিক বিস্তার৷ রাজ্যে রাজ্যে হাজার হাজার শ্রমিক–কৃষক–মধ্যবিত্ত-ছাত্র-যুব-মহিলা দলের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন৷ দরিদ্রের পর্ণকুটির থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের একচিলতে ঘরের শান্তির নীড় আজ পুঁজিবাদী শাসন–শোষণের আক্রমণে ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে৷ আত্মঘাতী কৃষক, হতাশ বেকার যুবক, কাজ হারানো শ্রমিকের দীর্ঘশ্বাসে, লাঞ্ছিতা নারীর আর্তনাদে দেশের আকাশ–বাতাস ভারী হয়ে উঠছে৷ প্রাকৃতিক সম্পদে উপচে পড়া ভারতের জল–জঙ্গল–জমি–খনি লুঠ করছে দেশি–বিদেশি একচেটিয়া পুঁজি মালিকের দল৷ মানুষ দিনে দিনে রিক্ত–নিঃস্ব হচ্ছে, অন্যদিকে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের ঘরে জমছে মানুষের রক্ত নিঙড়ানো ধনের পাহাড়৷ শিবদাস ঘোষের চিন্তায় দীক্ষিত বিপ্লবী কর্মীরা এই শোষণ–শাসন–বৈষম্যের অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে অবিচল সংগ্রামে নিয়োজিত৷
কিন্তু প্রয়োজন আজকের দিনের উপযুক্ত বিপ্লবী কর্মী হিসাবে গড়ে ওঠার নিরলস সংগ্রামের ঢেউ তোলা৷ স্বার্থপরতা, আত্মম্ভরিতা, নাম করার ঝোঁক, আরাম আয়েসের লোভের মতো কাদামাটি ক্রমাগত বিপ্লবী কর্মীদের মধ্যেও জমতে পারে, হুঁশিয়ারি দিয়ে গিয়েছিলেন কমরেড শিবদাস ঘোষ৷ কোটি কোটি মানুষের শোষণ যন্ত্রণায় শুধু কাঁদলেই বিপ্লবী হওয়া যায় না৷ এই ব্যথা যদি শোষণ অবসানের হাতিয়ার সঠিক বিপ্লবী পার্টিকে চিনে নেওয়ার মতো চেতনার জন্ম দিতে না পারে তাহলে এ লড়াই ব্যর্থ হয়ে যাবে৷ তারপরেও দরকার মার্কসবাদ–লেনিনব উন্নততর উপলব্ধি, যা কমরেড শিবদাস ঘোষ বিশেষীকৃত করে গেছেন, তা অর্জন করা৷ না হলে পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদের আজকের দিনের তীব্র আক্রমণকে রোখা যাবে না৷ তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল জাত বিপ্লবী গড়ে তোলার সংগ্রামকে বিকশিত করে দলের অসংখ্য কর্মীকে এই কাজের উপযুক্ত করে তোলা৷ তার সাথে জনজীবনের গভীর সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই আন্দোলন গড়ে তোলার পথনির্দেশ রচনা করা৷ তাই নিছক আনুষ্ঠানিকতা আর নির্বাচনী কৌশলের গোলকধাঁধায় পড়ে শব্দের মারপ্যাঁচ ভর্তি প্রস্তাবগুচ্ছ গ্রহণের চেষ্টা এই পার্টি কংগ্রেসে ছিল না৷ নানা রাজ্য থেকে নির্বাচিত ৭৯৭ জন প্রতিনিধি এবং অবজারভার পার্টি কংগ্রেসে অংশ নেন৷ আগস্ট মাসের শেষ থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে লোকাল সম্মেলন, জেলা সম্মেলন এবং রাজ্য সম্মেলনে স্তরে স্তরে দলের সদস্যরা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতির দলিলের উপরে অসংখ্য সংযোজনী–সংশোধনী এনেছেন৷ নানা স্তর পেরিয়ে তা এসে পৌঁছেছে পার্টি কংগ্রেসের কাছে৷
পার্টি কংগ্রেসের সূচনা হল ঘাটশিলার শিক্ষা কেন্দ্রে মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষের পূর্ণাবয়ব ব্রোঞ্জ মূর্তিতে মাল্যদান করেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)–র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী, দলের পলিটব্যুরো সদস্য কমরেডস রণজিৎ ধর, মানিক মুখার্জী, অসিত ভট্টাচার্য৷ শ্রমিক শ্রেণির রক্তে রাঙানো লাল পতাকা উত্তোলন করেন কমরেড রণজিৎ ধর৷
প্রতিনিধি অধিবেশনের শুরুতেই কমরেড প্রভাস ঘোষকে চেয়ারম্যান করে নির্বাচিত হল কংগ্রেসের সভাপতিমণ্ডলী৷ শোক প্রস্তাবের পরে নানা দেশের ভ্রাতৃপ্রতিম বামপন্থী এবং কমিউনিস্ট দলগুলির প্রেরিত শুভেচ্ছাবার্তা পাঠ করে শোনালেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড কে রাধাকৃষ্ণ৷ প্রতিবেশী বাংলাদেশের বিপ্লবী দল বাসদ (মার্কসবাদী)–র সাধারণ সম্পাদক কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী এই তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসকে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁর স্মৃতিতে থাকা কমরেড শিবদাস ঘোষের বিপ্লবী সাহচর্যের কথা তুলে ধরলেন৷ আন্তর্জাতিক সাম্যবাদী আন্দোলনের আজকের দিনের সংকটে পথ দেখাতে পারে একমাত্র মার্কসবাদ লেনিনবাদের উন্নত উপলব্ধি কমরেড শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা৷ গভীর আশায় এই পার্টি কংগ্রেসের প্রতি তাঁর আহ্বান– শিবদাস ঘোষের শিক্ষার উপযুক্ত হয়ে উঠুন সমস্ত প্রতিনিধি৷
সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট, আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় পরিস্থিতি সংক্রান্ত প্রস্তাব ও দলের গঠনতন্ত্রের বিষয়ে কিছু সংশোধনীর উপর পাঁচদিন ধরে প্রতিনিধি এবং অবজারভাররা আলোচনা করেন৷ দলকে ত্রুটিমুক্ত করার সংগ্রামে সংগঠনের স্তরে স্তরে আত্মসমালোচনা–সমালোচনার যে প্রক্রিয়া নেতৃত্ব শুরু করেছেন, সেই প্রক্রিয়াতেই কেন্দ্রীয় কমিটির সমস্ত সদস্যের সমালোচনা–আত্মসমালোচনা রিপোর্ট কংগ্রেসে পড়ে শোনানো হয়৷ নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি, কন্ট্রোল কমিশন, এডিটোরিয়াল বোর্ড নির্বাচন করে পার্টি কংগ্রেস৷ কমরেড প্রভাস ঘোষ পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন৷ কমরেড মুবিনুল হায়দার চৌধুরী এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)–র প্রতিনিধিদের হাতে রক্তপতাকা তুলে দেন কমরেড প্রভাস ঘোষ৷ তাঁরা কমরেড প্রভাস ঘোষের হাতে উপহার তুলে দেন৷
তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের শেষে প্রতিনিধিরা ফিরেছেন নতুন এক সংগ্রামের শপথ নিয়ে৷ তাঁদের চোখ–মুখ উজ্জ্বলতর৷ মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা জিন্দাবাদ, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব জিন্দাবাদ ধ্বনি বুকে নিয়ে দেশের প্রান্তে প্রান্তে ফিরে গেলেন তাঁরা৷