বিশ্বভারতীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রতিবারই সাহিত্য–বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক জগতে যাঁরা বিশিষ্ট কিছু অবদান রেখেছেন, তাঁদের বিশেষ বিশেষ জনকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করার প্রথা রয়েছে৷ বিশ্বভারতীর আচার্য প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে এই সম্মান প্রদান করেন৷ এটাই রেওয়াজ৷ কিন্তু এ বছর তার ব্যতিক্রম ঘটে গেল৷
বিশ্বভারতীর অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল এ বারের দেশিকোত্তম প্রদানের জন্য সাত জনের নামের যে তালিকা তৈরি করেছিল, কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তর এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর সেই তালিকা খারিজ করে দিয়েছে৷ তার ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে অভূতপূর্বভাবে এ বারের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দেশিকোত্তম সম্মান প্রদান সুচিটাই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়৷
কাদের নাম ছিল সেই তালিকায়? সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ এবং বিশিষ্ট কবি গুলজারের নাম, যাঁরা বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের রাজনীতির কড়া সমালোচক৷ বিশেষত গোধরা কাণ্ডের পর গুজরাটে পরপর যে বর্বর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংগঠিত হয়েছিল, এঁরা তার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন৷ এ ছাড়াও তালিকায় আরও কিছু নাম ছিল যাঁরা বিদ্বজ্জন হিসাবে যথেষ্ট সুপরিচিত হলেও বিজেপি নেতৃত্ব মনে করেছেন তাঁরা তাঁদের মতের বিরোধী৷ সহজ কথায় কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের মানদণ্ডে বিজেপি ঘনিষ্ঠতা না থাকলে দেশিকোত্তম মিলবে না৷
আলোচনার ভিত্তিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল যে সমস্ত বিদ্বজ্জন বা সাংস্কৃতিক জগতের মানুষকে তাঁদের কাজ বিচার করার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান প্রাপক বলে বিবেচনা করছেন, সেখানে মন্ত্রী বা সরকারি আমলারা সেটাকে খারিজ করে দিল– এটা সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারের উপর অত্যন্ত অবমাননাকর হস্তক্ষেপ৷ এমন একটি প্রতিষ্ঠানে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটল যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত৷ সরকারি আমলারা সেই তালিকাই বাছবেন, যাঁরা সরকারের প্রতি অনুগত৷ সরকারের জনবিরোধী পদক্ষেপ দেখেও যারা মুখ বুজে থাকবে৷ প্রতিবাদ জানাবে না৷ কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এমনিতেই শিক্ষার নীতি–নির্ধারক কমিটিগুলির প্রশাসক পরিবর্তন করে গণতান্ত্রিক শিক্ষার প্রসারের জায়গায় পুরনো সামন্ততান্ত্রিক ধর্মীয় রীতি–নীতি ও অবৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রসার ঘটাতে অতিমাত্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে৷ একই সাথে যাঁরা গণতান্ত্রিক সুস্থ চিন্তার দিক থেকে বিজেপির এই ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির বিরোধিতা করছেন, তাঁদের উপর আক্রমণ হচ্ছে, এমনকী মেরেও ফেলা হচ্ছে৷ এই যেখানে দস্তুর, সেখানে দেশিকোত্তম সম্মাননার তালিকা থেকে প্রতিবাদী মানুষেরা বাদ পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু তাঁদের বাদ দিতে গিয়ে দেশিকোত্তম প্রদান সূচিটাই নজিরবিহীনভাবে সমাবর্তন অনুষ্ঠান থেকে ছেঁটে ফেলা হল৷ নগ্ন দলবাজির কী নিকৃষ্ট নজির৷
(৭০ বর্ষ ৪১ সংখ্যা ১জুন, ২০১৮)