Breaking News

তাপপ্রবাহঃ পুঁজিবাদী ‘উন্নয়নের’ বোঝা শ্রমিকের ঘাড়ে

 এ বছরও এক অসহনীয় তাপপ্রবাহে পুড়লো কলকাতা তথা সারা ভারত। প্রবল রোদ আর বাতাসের জলীয় বাষ্প মিলে শরীরে প্রবল অস্বস্তিতে ভুগছে মানুষ। গরমে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে রাজ্যে, দেশে। তাপপ্রবাহের জেরে দিল্লি সহ বেশ কিছু রাজ্যে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে ইতিমধ্যেই। যে কোনও নির্মাণ কাজের দিকে তাকালেই দেখা যায় কাঠফাটা রোদ মাথায় নিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। সুরক্ষা বলতে মাথায় জড়ানো একফালি গামছা, সকলের তাও নেই। যে সময় একফোঁটা ছায়ার জন্য মানুষ অস্থির হয়ে যাচ্ছে, রোদের তাপে শরীর জ্বলে যাচ্ছে, সেই সময় এভাবে খোলা আকাশের নিচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করা যতই অসহনীয় হোক, ওঁদের জীবনে এটাই স্বাভাবিক। কাজের সুস্থ পরিবেশ-সুরক্ষা-নিরাপত্তা এই শব্দগুলো যেন এই মানুষগুলোর জীবন থেকে মুছে গিয়েছে কবেই। একটা নির্মাণ কাজ শেষ হলে ক’দিনের মধ্যেই, স্বাভাবিক আবার অন্য কোথাও এই দাবদাহের মধ্যেই হাড়ভাঙা খাটুনির কাজে জুড়ে যেতে হবে ওঁদের, যাঁদের রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘সভ্যতার পিলসুজ’।

ঠিক কতটা ভয়ানক এ দেশে শ্রমিক সুরক্ষার পরিস্থিতি? মে-জুন মাসের বড় সময় ধরে ‘হিট স্ট্রোক’ নিয়ে প্রায়শই রোগীরা এসেছেন দিল্লির নানা হাসপাতালে, যাঁদের অধিকাংশই খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষ, পেটের ভাত জোগাড়ে অসহনীয় গরম সহ্য করে যাওয়া ছাড়া যাঁদের সামনে আর কোনও উপায় খোলা রাখেনি এই সমাজ, এই ব্যবস্থা। এরকম মৃত্যু নিয়ে খবর হলে কদিন একটু নড়েচড়ে বসার ভাব দেখায় সরকার বা কর্তাব্যক্তিরা। যেমন দিল্লির এই ঘটনার পর ‘অভূতপূর্ব তাপপ্রবাহের’ কথা মাথায় রেখে একটু জলের ব্যবস্থা, রাস্তায় জল ছেটানো, নির্মাণকর্মীদের কাজের সময় পাল্টানোর কথা বলেছে সরকার। সত্যিই কি এই তাপপ্রবাহ ‘অভূতপূর্ব’? এই মে-জুন মাসে দেশের বহু রাজ্যে যে তাপমাত্রার পারদ মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তাপপ্রবাহের জন্য নানারকম সতর্কতা জারি করতে হয়, স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, হিট স্ট্রোকে মানুষের মৃত্যু ঘটে এ তো সাধারণ মানুষের প্রতি বছরের অভিজ্ঞতা। গাছ কাটা-অরণ্য ধ্বংস সহ নানা কারণে এই গরম যে বছর বছর আরও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, এও সবার জানা। অথচ শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য আগাম কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজনই মনে করে না কি কেন্দ্র কি রাজ্যের সরকারগুলো। গরমের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে ‘হিট অ্যাকশন প্ল্যান’ নামে একটি পরিকল্পনার খাতায় কলমে অস্তিত্ব আছে বলে শোনা যায়। ‘ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি’র নির্দেশ মেনে স্থানীয় পরিস্থিতি ও প্রয়োজন বিবেচনা করে গরম মোকাবিলার ব্যবস্থা করার কথা এই প্ল্যানের। অথচ এই পরিকল্পনা আদৌ বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, হলে তার সুফল কারা কী ভাবে পাচ্ছেন এসব প্রশ্নের উত্তর মেলে না কোথাও। তবে নিজেদের ঘাম-রক্ত দিয়ে সভ্যতার ইমারত গড়ে তুলছেন যাঁরা, সেই শ্রমিকরা যে এসব প্ল্যান-ট্যানের আওতায় আসেন না, সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তথ্য বলছে, এ দেশে প্রতি পাঁচজন শ্রমিকের মধ্যে চারজনই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। কলে কারখানায় শ্রম দেওয়া হাজার হাজার শ্রমিক, খোলা আকাশের নিচে কাজ করা রাজমিস্ত্রি ও অন্যান্য নির্মাণকর্মী, ডেলিভারি বয়, রাস্তার ফল-সব্জি-খাবার বিক্রেতা, নানা রকম চুক্তিভিত্তিক ঠিকা শ্রমিক, বাড়ি বাড়ি পরিচারিকা, মোট বাহক– এঁরা সবাই পড়ছেন এই ‘অসংগঠিত’ ক্ষেত্রের আওতায়। সরকারি খাতায় এঁদের নাম নেই, নেই কাজের ন্যূনতম নিশ্চয়তা, কোনও নির্দিষ্ট বেতন, সুরক্ষিত পরিবেশ। দীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে শ্রমিকদের আদায় করা অধিকারগুলোই যখন সরকার মানছে না, সংসদে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একের পর এক শ্রমিকবিরোধী আইন পাশ করাচ্ছে, তখন এই অসংগঠিত অনথিভুক্ত মানুষগুলোর অবস্থা যে কি ভয়াবহ তা সহজেই অনুমান করা যায়। ভারতবর্ষের কর্মক্ষম মানুষের প্রায় ৮২ শতাংশ কাজ করেন নানা অসংগঠিত ক্ষেত্রে। ২০২১-২২ এর সমীক্ষা অনুযায়ী এই সংখ্যাটা প্রায় ৪৪ কোটি। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, কর্মক্ষম শ্রমিকদের ৭৫ শতাংশ, প্রায় ৩৮০ মিলিয়ন মানুষকে গরমের বিপদ মাথায় নিয়েই শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে হয়। (সূত্রঃ ডাউন টু আর্থ, ২৯ মে, ২০২৪)। শুধুমাত্র ২৩ মে থেকে ৩ জুন, লোকসভা নির্বাচন চলাকালীন গরমে অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন অন্তত ৭৭ জন, যাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ভোটকর্মী। ‘গণতন্ত্রের বৃহত্তম উৎসব’ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার দায়ভার নিতে বাধ্য যারা, এই ভয়ঙ্কর গরমে তাঁদের উপযুক্ত সুরক্ষা দেওয়ারও দরকার মনে করেনি সরকার। আর আরও অবহেলিত আরও প্রান্তিক যে মানুষগুলো সারা বছর ধরে অমানুষিক খেটে যাচ্ছেন খোলা আকাশের তলায়, তাঁরা এই গরমে কী ভাবে বেঁচে আছেন? কী ভাবেই বা কাজ করছেন? ‘ডাউন টু আর্থ’ সংগঠনের সমীক্ষায় উঠে এসেছে তাঁদের মর্মান্তিক জীবনযন্ত্রণার ছবি।

কতখানি তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে মানুষের শরীর? সমতলের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছাড়ালেই ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তরের সংজ্ঞা অনুযায়ী তা তাপপ্রবাহ। কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ ইন ইউনাইটেড স্টেটস-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী সর্বাধিক ৩৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা এবং ৩০ শতাংশ আপেক্ষিক আর্দ্রতা পর্যন্ত নিরাপদে কাজ করা যেতে পারে। অথচ এ বছরের এই দীর্ঘ তাপপ্রবাহে উত্তর ও মধ্য ভারতে হরিয়ানা রাজস্থান দিল্লি সহ বহু রাজ্যে তাপমাত্রা এই সীমা ছাড়িয়ে গেল, কোথাও কোথাও ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছুঁয়ে ফেলল এবং তার মধ্যেই ধুঁকতে ধুঁকতে অসুস্থ হয়ে কাজ করে যেতে বাধ্য হলেন শ্রমিকরা। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বহুদিন আগে লিখেছিলেন– ‘হাতুড়ি শাবল গাঁইতি চালায়ে ভাঙিল যারা পাহাড়ঙ্গপাহাড় কাটা সে পথের দু’পাশে পড়িয়া যাঁদের হাড়।’ আজ ভারতবর্ষ পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম ইট উৎপাদক দেশ, ২৩ মিলিয়ন শ্রমিকের দিনরাতের শ্রমে প্রতি বছর তৈরি হয় ২৩৩ বিলিয়ন ইট। অথচ সেই ইটের তৈরি ইমারতের তলায় কত শ্রমিকের কান্না আর নিরুপায় যন্ত্রণার ইতিহাস চাপা পড়ে আছে, আজও তার হিসেব নেই। চাষবাসের পরেই দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষ (প্রায় ৭৪ মিলিয়ন) যুক্ত যে পেশার সাথে, সেই নির্মাণকর্মীরা এভাবেই বহু জায়গায় কাজ করছেন। একটি সাম্প্রতিক স্বাস্থ্য গবেষণার তথ্য বলছে, এবারের তাপপ্রবাহে এঁরা অনেকেই আগুন ঝরা গরমে ভারি কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন এমন পরিবেশে, যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সীমার অনেকখানি বাইরে।

হায় রে শ্রমিকের প্রাণ। পুঁজিবাদের মুনাফা লালসা প্রসঙ্গে মার্ক্স লিখেছিলেন, মালিক ততটুকু মজুরিই শ্রমিককে দেয়, যতটুকু পেলে সে কোনওমতে খেয়েপরে বাঁচতে পারে, পরদিন আবার কাজে আসতে পারে। আজকের মালিকের সে দায়টুকুও নেই, কারণ একশো শ্রমিকের মৃত্যু হলে সেখানে ছুটে আসবে আরও পাঁচশো বুভুক্ষু শ্রমিক। নেতা-মন্ত্রীরা মাঝে মাঝেই দেশের উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে জিডিপির গল্পশোনান, অথচ সেই জিডিপির সিংহভাগ গড়ে উঠছে যাদের রক্ত জল করা শ্রমে, তারাই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। প্রযুক্তির এত উন্নতি সত্ত্বেও এই প্রবল গরমে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের অনন্ত দুর্ভোগে কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, কাজের জায়গার সুরক্ষা-নিরাপত্তার নূ্যনতম নিয়ম কানুন কিছুই নেই এই দধীচিদের জন্য। যত দিন যাবে, আরও নিষ্ঠুর আরও অমানবিক হবে মুনাফাসর্বস্ব এই ব্যবস্থার চেহারা। যে সমাজ শ্রমিককে মানুষ মনে করে না, যে সমাজে লক্ষ কোটি শ্রমিকের শ্রমের ফসল চুরি করে মুনাফার পাহাড় বানানোই নিয়মে পরিণত হয়, সেই অসুস্থ সমাজকে ভেঙেই সচেতন শ্রমিককে তৈরি করতে হবে নিজের মুক্তির রাস্তা।