‘তাঁহার’ ঠিকানা কি আজ পাতালেই!

অদ্যাবধি নিপাতনে সিদ্ধ ছিল যে, সর্বজ্ঞ, স্বয়ম্ভূ ঈশ্বরের অধিষ্ঠান ঊর্ধ্ব গগনে। তর্পণকালে হোক বা কৃপাকরুণা লাভের আগ্রহকে সংবরণ করিতে না পারা কালে হোক, প্রার্থনা সর্বক্ষেত্রেই ঊর্ধ্বমুখী। গৈরিক বসনে সজ্জিত হইয়া ভক্তকূল বহুদিন ধরিয়া আপ্রাণ চেষ্টা চালাইতেছেন মহাপ্রভুকে নভোমণ্ডল হইতে টানিয়া নামাইয়া মন্দিরের বিগ্রহে বন্দি করিতে। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান, এই বৈদিক বাণীকে অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ভ্রান্ত প্রমাণ করিয়া নানা নামের নানা ছাঁদের নানা আদলের মন্দির কক্ষে ঈশ্বরকে হেফাজতে লওয়ার অভিযান অনেকদিনই শুরু হইয়াছে। তবুও কোনও অজ্ঞাত প্রক্রিয়ায় ঈশ্বরের বোধকরি জামিন মঞ্জুর হইয়া যাইতেছিল। তাই পরিকল্পনা হইল, প্রাপ্তবয়স্ক ঈশ্বরকে খাঁচাবন্দি করার ফিকির বর্জন করিয়া ‘ক্যাচ হিম ইয়ং’ মন্ত্রের বশীভূত করিতে হইবে। তাই একটি ঐতিহাসিক সৌধকে কোদাল শাবল হাতুড়ি সহকারে ধূলিসাৎ করিয়া সেইস্থলে ‘বালক ঈশ্বর’কে হাতেখড়ি দিবার নাম করিয়া স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী হাঁটি হাঁটি পা পা সহযোগে অর্ধনির্মিত স্ফটিক খণ্ডিত ‘জন্মস্থলে’ মহাসমারোহে ঢুকাইয়া দিলেন। ঢাক বাজিল, বাদ্যি বাজিল, বাজি পুড়িল, প্রদীপ জ্বলিল, রেলস্টেশনের কলেবর বৃদ্ধি হইল, আধুনিক সজ্জার বিমানবন্দর রাতারাতি খাড়া হইয়া গেল, বেশ কয়েক গাছা হোটেল, রেস্তোব়াঁ গজাইল। কিন্তু অচিরাৎই বালক ঈশ্বরের দর্শনাকুলের উৎসাহে ভাটা পড়িল। রেলগাড়ি ফাঁকা হইল, বিমানের উত্তরণ-অবনমন মিলাইয়া গেল। অনেকটা খাঁ খাঁ করিতে লাগিল ঈশ্বরের বাল্যভূমি।

গৈরিক অনুচরদের মস্তকে হস্ত। ঈশ্বরকে কিছুতেই বাগে আনা যাইতেছে না। অতঃ কিম! সঙ্গে সঙ্গে কিছু বিশেষ-অজ্ঞ ব্যক্তি আসিয়া উপায় ঠাউরাইলেন– বলিলেন গোড়ায় গণ্ডগোল। ঈশ্বর গগনে নহে, পাতালে অধিষ্ঠান করেন। সেখানে তিনি চাপা পড়িয়া আছেন। অতএব আবার শাবল-কোদাল-হাতুড়ির নিদান ডাকা হইল। বারাণসীর জ্ঞানবাপী মসজিদের নিচে তাহার নাভিশ্বাস উঠিতেছে। অতএব মসজিদ ভাঙিয়া ঈশ্বরকে উদ্ধার করিতে হইবে। ফরমান জারি হইল। কতিপয় অতিশয় জ্ঞানী ব্যক্তি বলিলেন, কেবল বারাণসীতে হইবে না। নিষ্কৃতি পাইবার আশা ছাড়িয়া ঈশ্বর সুড়ঙ্গ গড়িয়া অন্য স্থানেও পাড়ি দিতে পারে। অতএব মথুরার মসজিদেও ঈশ্বরের সন্ধানে খননকার্য চালু করিতে হইবে। কিন্তু মর্ত্যলোকে আবার ঈশ্বরের অনুশাসন তেমন কার্যকরী হয় না–সুপ্রিম কোর্ট ইত্যাদি পার্থিব বাধাবিপত্তি বিস্তর। তাই যুগপৎ উত্তরপ্রদেশের সম্ভল নামক স্থানের মসজিদের তলদেশেও হানা দিতে হইবে। ঈশ্বরের পাতালবাসের অবসান ঘটাইতেই হইবে। নচেৎ ভারতবর্ষ পাঁচ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির নাগাল পাইবে না। বৈদিক যুগের পুনর্স্থাপনা হইবে না, অমৃতকালে গরলের ভেজাল বৃদ্ধি পাইবে। গদি আপাতত না টলিলেও উহার ভিত্তির পোক্ততায় ঘুণ ধরিতে পারে। অতএব ঈশ্বরকে মাটি খুঁড়িয়া বাহির করিতেই হইবে। ডিজিটাল বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদগণকে কানেকানে বলিয়া গিয়াছে, ঈশ্বর যত্রতত্র নহে, কেবল মসজিদ গর্ভেই লুকাইয়া আছেন! অতএব অপারেশন মসজিদ পুরোদমে চালু করা অবশ্যক।