তর্জন-গর্জনই সার, মূল্যবৃদ্ধি রোধে কার্যকরী ব্যবস্থা কই

 

 

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি কি করোনা ভাইরাসের চেয়ে কম ঘাতক? উপমা শুনে চমকে উঠবেন না। কারণ মূল্যবৃদ্ধি নিঃশব্দ ঘাতক হয়ে কত পরিবারকে শেষ করে দিচ্ছে তার হিসাব সরকার রাখে ন়া!

ধূর্ত মালিকরা করোনা পরিস্থিতিকেকাজে লাগিয়ে বহু কর্মী ছাঁটাই করছে, অনেকের বেতন কমাচ্ছে। ফলে জনগণের দুর্দশা সীমাহীন। এই অবস্থায় সমস্ত খাদ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি সঙ্কট জর্জরিত মানুষের উপর মারাত্মক আঘাত। মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের ৯০ শতাংশ পরিবার প্রায় অনাহার অর্ধাহার এবং অপুষ্টির কবলে। অপুষ্টির কারণে দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। যার প্রত্যক্ষ কারণ মূল্য বৃদ্ধি।

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সবচেয়ে বেশি ছ্যাঁকা লাগছে আলু কিনতে গিয়ে। ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি জ্যোতি আলু! কোনও কালে শুনেছেন? অন্যান্য সবজিও ৫০ থেকে ৮০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করছে। পাইকারি বড় ব্যবসায়ী মহল এবং সরকারের কেউ কেউ বলছেন, টানা বৃষ্টির জন্য এতটা দাম বেড়েছে। কিন্তু সবুজ সবজির দাম বাড়ার জন্য বৃষ্টিকে যদিও কিছুটা দায়ী করা যায়! আলুর দাম বাড়বে কেন? আলু তো গুদামে চলে গেছে মার্চ-এপ্রিলে। তার দাম বৃদ্ধির সাথে বৃষ্টির সম্পর্ক কি? বাস্তবে আলুর দাম বাড়ছে মজুতদার ফাটকাবাজদের দৌলতে। কাঁচা সবজির দামও চাষির হাত থেকে বাজারে আসার মধ্যে ৩০-৪০ টাকা বেড়ে যায় এই আড়তদার এবং পাইকারি বাজারের বড় ব্যবসায়ীদের দৌলতেই। এদের নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকা কী?

কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার মুখে যাই হম্বিতম্বি করুক, তাদের ভূমিকা কার্যত মজুতদার ফাটকাবাজদের স্বার্থ রক্ষা করছে। রাজ্য সরকারের ব্যাখ্যা, আলুর উৎপাদন খরচ কেজি প্রতি ১৩ টাকার মতো। তাই পাইকারিতে তা কেজি প্রতি ২২ টাকায় বিক্রি করার ছাড়পত্র দিচ্ছে সরকার। তাহলে নাকি কেজিতে অন্তত ৯ টাকা লাভ থাকবে চাষির। এই বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার চাষির অবস্থা সম্পর্কে সরকারের হয় কোনও ধারণা নেই, না হলে জেনেশুনে তারা মিথ্যা বলছে। বেশিরভাগ চাষি যখন আলু বিক্রি করেছেন তখন কিলোতে ৬-৮ টাকার বেশি ওঠেনি। মুষ্টিমেয় বড় চাষি কিছুটা আলু নিজেরা হিমঘরে রাখলেও বেশিরভাগ চাষির পক্ষে বেশিদিন আলু ধরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ টাকা আটকে থাকলে তার ধার শোধ হবে না। ফলে আলু ওঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তা চলে গেছে বড় আড়তদার, মহাজনের কবলে। বেশিরভাগ চাষির হাতে এখন আলু নেইও। কাজেই দাম বেঁধে দেওয়ার সুবিধা পুরোটাই লুটে নেবে তারাই। পাইকারি বাজারে আলু বা সবজির দাম কত হবে তা ঠিক করে এইসব আড়তদার, মজুতদারদের সংগঠিত চক্র। তার উপর সমস্ত খাদ্য ফসলের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার ‘ফরোয়ার্ড ট্রেডিং’য়ের নীতি চালু করায় মাঠে ফসল থাকতে থাকতেই তা নিয়ে শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলা চলে। ফাটকার কারবারিদের কারসাজিতে দাম যখন তখন বাড়ে-কমে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার সম্প্রতি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনকে অকার্যকরী করে দিয়েছে। কৃষি পণ্যের পাইকারি এবং খুচরো ব্যবসাতে দেশি বিদেশি একচেটিয়া মালিকদের ঢোকার অবাধ রাস্তা খুলে দিয়েছে। বড় বড় কোম্পানিগুলিকে অধিকার দিয়ে দিয়েছে দাদন দিয়ে চাষিকে চাষ করানোর। এই সব কোম্পানির হাতেই চলে যাবে ফসলের দাম নির্ধারণের একচ্ছত্র অধিকার। ফলে ক্ষুদ্র-মাঝারি কৃষক, ছোট ব্যবসায়ীরা চরম সংকটে পড়বেন।

এই রাজ্য সরকার লোক দেখানো পুলিশি নজরদারি চালাতে পারে, কিন্তু তা এই চক্রের গায়ে আঁচড়টিও কাটবে না। কার্যকরী কিছু করতে গেলে এই সর্বনাশা নীতির বিরুদ্ধতা করার প্রয়োজন।

মূল্যবৃদ্ধিতে আরও ইন্ধন দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের লাগাতার পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ানোর নীতি। তার ফলে পরিবহণের ভাড়া বেড়েছে। বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। সরকার গত এক বছরে ধারাবাহিক ভাবে গ্যাসের দাম ১০০ টাকার মতো বাড়িয়েছে। গ্যাসে ভর্তুকি প্রায় তুলেই দিয়েছে। করোনা সংকটের মধ্যে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে সরকার এ কাজটি করেছে। যখন জনগণের পাশে দাঁড়ানো জরুরি ছিল তখন সরকার এ ভাবে জনগণের উপর উৎপীড়ন চালিয়েছে।

অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের গদির জোরকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি একদিকে আওয়াজ তুলছে ভোটে জিতলে তারা সোনার বাংলা গড়বে। অন্যদিকে রাজ্যের তৃণমূলও বলে চলেছে তাদের রাজত্বে ‘এগিয়ে বাংলা’। কংগ্রেস-সিপিএমও এখন জনদরদের ভেক নিয়ে মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে বলে চলেছে। অথচ এই দলগুলি যখন যেখানেই ক্ষমতায় থেকেছে মূল্যবৃদ্ধিতে ইন্ধন দিয়েছে। কৃষিপণ্যকে বৃহৎ পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার কাজটা শুরু করেছে কংগ্রেস। সিপিএম পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকার সময়তেই চুক্তি চাষ, আলু, ধান, পাট সহ সমস্ত ফসলে অবাধ মজুতদারি-ফাটকা চলতে দিয়েছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনকে প্রয়োগ করে দাম কমানো দূরে থাক, এই আইনকে দুর্বল করা তারাই শুরু করেছে। এখন বিজেপি কেন্দ্রে তা পুরো তুলেই দিল। এস ইউ সি আই (সি) দল বারবার দাবি করেছে এই পরিস্থিতিতে মানুষকে সুরাহা দিতে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলি খাদ্য সহ সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চালু করুক। কিন্তু কোনও দলের সরকার সেই কাজটি করেনি। ফলে একথা আজ পরিষ্কার এই দলগুলির একে অপরের বিরুদ্ধে তোলা স্লোগান থেকে এদের প্রকৃত চরিত্র বুঝলে ভুল হবে। এরা সকলেই পুঁজিপতিশ্রেণির সেবাদাস হিসাবেই কাজ করে চলে। বুঝতে হবে ভোটে সরকার পরিবর্তনের দ্বারা এই চক্র থেকে মুক্তি নেই। কারণ পুঁজিবাদী অর্থনীতি এই মূল্যবৃদ্ধির আঁতুড়ঘর। তাকে উৎখাত না করলে এর ছোবল থেকে রেহাই মিলবে না।

(ডিজিটাল গণদাবী-৭৩ বর্ষ ৬ সংখ্যা_২১ সেপ্টেম্বর, ২০২০)