২০১৩ সাল৷ নরেন্দ্র মোদি তখনও কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় আসেননি৷ সেই সময়, ভারত সরকার পরিচালিত সংবাদমাধ্যম আকাশবাণী ও দূরদর্শনের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে তিনি ইউরোপীয় সংবাদসংস্থা বিবিসি–র প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ব্যক্ত করে এক টুইটার বার্তায় বলেছিলেন, বিবিসির বিশ্বাসযোগ্যতা আছে৷ সে দিন তাঁর নিশ্চয়ই এ কথাও মনে হয়েছিল, সরকারের কোনও কাজের বিরোধিতা করা মানেই দেশবিরোধিতা নয়৷ সেই বিবিসির ‘ইন্ডিয়াঃ দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ নামের তথ্যচিত্রটির প্রথম পর্ব প্রচারিত হয়েছে ১৭ জানুয়ারি৷ সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই পর্বটিতে উঠে এসেছে নরেন্দ্র মোদির রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া, বিজেপি দলে তাঁর উত্থান ও গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া পর্যন্ত যাত্রাপথ, যেখানে তাঁর মুসলিম বিদ্বেষের মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে৷ দ্বিতীয় পর্ব প্রচারিত হয়েছে ২৪ জানুয়ারি৷ প্রথম পর্বটি প্রচারিত হওয়ার পরই ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রক সেটিকে প্রচারমূলক, ভিত্তিহীন, একপেশে এবং তথ্যসমৃদ্ধ নয় বলে ঘোষণা করেছে৷ এ কথাও বলেছে যে, এই তথ্যচিত্রটি তৈরি হয়েছে সংবাদসংস্থাটির ঔপনিবেশিক মানসিকতার ভিত্তিতে৷
এখানেই শেষ নয়৷ পুলিশ প্রশাসন তার যাবতীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে কোমর বেঁধে নেমেছে যাতে দেশের সাধারণ মানুষ এই তথ্যচিত্রটি দেখতে না পারেন৷ তথ্যচিত্রটি প্রদর্শনে কেন্দ্রীয় সরকার অনেক বিধি–নিষেধ আরোপ করেছে৷ এমনকী তথ্যপ্রযুক্তি আইনের জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করে ইউটিউব ও টুইটারকে এই তথ্যচিত্রের লিংক ও কমেন্ট তুলে নিতে নির্দেশ দিয়েছে৷ অর্থাৎ, এই তথ্যচিত্র দেখাটাও মোদি সরকারের চোখে দেশদ্রোহিতার সমপর্যায়ের অপরাধ৷
ইতিমধ্যেই জেএনইউ, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, আম্বেদকর বিশ্ববিদ্যালয় এবং জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে মোদিজির পুলিশ এই তথ্যচিত্রটি দেখা আটকাতে ১৪৪ ধারা জারি করে ধরপাকডও করেছে৷ অতি সম্প্রতি রাজস্থানের একটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দশজন ছাত্রকে সাসপেন্ড করা হয়েছে৷ ছাত্রদের উপর বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপি গুণ্ডামি করলেও তাদের কোনও শাস্তি হয়নি এবং ভবিষ্যতে হবে, এমন আশাও আজকের ভারতে কেউ করবেন না, কারণ এ দেশে বিজেপির বশংবদ হয়ে মোদির প্রশস্তি গাইলে ধর্ষণ ও হত্যার মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের শাস্তিও মকুব হয়ে যায়, এ সব অসভ্যতা, গুন্ডামি তো তুচ্ছ ব্যাপার৷
কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের আইনমন্ত্রী বলেছেন, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদিকে গুজরাটের দাঙ্গার বিষয়ে ক্লিনচিট দিয়েছে৷ মোদিজির বিরুদ্ধে তথ্যচিত্রে যা দেখানো হয়েছে, কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর মতে তা হল—‘ভারতের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত প্রচার’৷ কাজেই উচ্চতম স্তর পর্যন্ত বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা বুঝিয়ে দিচ্ছেন, নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার আগে বিবিসিকে যতই বিশ্বাসযোগ্যতার সার্টিফিকেট দিয়ে থাকুন, আজ যখন সেই বিবিসি গুজরাট দাঙ্গায় মোদির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তথ্যচিত্র বানিয়েছে, তখন আইনমন্ত্রী সহ দেশের সরকারের চোখে তারা অবশ্যই ভারতবিরোধী, পক্ষপাতদুষ্ট এবং অপরাধী৷ প্রসঙ্গত ক’দিন আগেই বিজেপি ঘনিষ্ঠ পরিচালক বিবেক অগ্ণিহোত্রীর ‘দি কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিটিকে ঘিরে যখন ইতিহাসবিকৃতি এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ প্রচারের অভিযোগ উঠেছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী সহ এই নেতা-মন্ত্রীরাই বলেছিলেন, তাঁরা ইতিহাস খুঁডে সত্য তুলে আনতে চান, মানুষকে সত্য জানাতে চান৷ ওই ছবিটির প্রচারে ভারত সরকার একেবারে সর্বশক্তি নিয়ে নেমেছিল৷ অথচ প্রেক্ষাপট যখন গুজরাট দাঙ্গা, তখন ইতিহাসের চর্চা বা আলোচনায় তাঁরা একেবারেই আগ্রহী নন৷
প্রশ্ন হচ্ছে, এই তথ্যচিত্রে যদি ভুল একপেশে তথ্যই দেখানো হয়ে থাকে, মোদিকে মিথ্যে দোষারোপ করা হয়ে থাকে, কেন্দ্রীয় সরকার তা পর্যালোচনা করে বিবৃতি দিতে পারত, ঘটনা উল্লেখ করে দেখাতে পারত যে ছবিটির বক্তব্য কোথায় ভুল৷ তা না করে ছবিটিকে একেবারে নিষিদ্ধ করে দিতে হল কেন! সমাজমাধ্যম থেকে তুলে নিতে হল কেন! দেশের মানুষ ছবিটি দেখলে এবং পাশাপাশি বিজেপি শিবিরের বক্তব্য শুনলে কী অসুবিধা ছিল! তা হলে তো গুজরাট দাঙ্গার ইতিহাস ঘেঁটে সত্য-মিথ্যে যাচাইয়ের একটা সুযোগ মানুষ পেতেন৷ মোদি সরকার কিন্তু সে পথ মাডাল না৷ বরাবরের মতোই তাদের স্বভাবসিদ্ধ আগ্রাসী কায়দায় আক্রমণ চালিয়ে বিরুদ্ধতা আটকানোর চেষ্টা করল৷ দেশে দেশে যুগে যুগে এমনটা করার প্রয়োজন শাসকের তখনই হয়, যখন সে ভয় পায়, যখন সে সত্যকে চাপা দিতে, আড়াল করতে চায়৷ নরেন্দ্র মোদির মুখ্যমন্ত্রিত্বের সময় গুজরাটের গণহত্যায় কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ গিয়েছিল, অসংখ্য বাডিঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ হয়েছিল, ধর্ষণ-হত্যা সহ নারকীয় অত্যাচার হয়েছিল সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর৷ তাতে কি গুজরাটের তৎকালীন রাজ্য সরকারের কোনও দায় ছিল না! তাদের অগোচরে তো এসব ঘটেনি৷ রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে এই জঘন্য অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং শাস্তির কোনও ব্যবস্থা যে নরেন্দ্র মোদি করেননি বা করতে চাননি, তার অজস্র প্রমাণ সেই সময়ের বিভিন্ন লেখা, রিপোর্ট, প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতায় আছে৷ নানা মানবাধিকার সংগঠন, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক দলের প্রবল সমালোচনার মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং আরএসএসএর একনিষ্ঠ সেবক অটলবিহারী বাজপেয়ী বাধ্য হয়ে নরেন্দ্র মোদিকে ‘রাজধর্ম’ পালন করতে বলেছিলেন৷ এই গুজরাট কাণ্ডের অভিঘাতেই ২০০৫ সালে আমেরিকা নরেন্দ্র মোদিকে ভিসা দিতে অস্বীকার করেছিল৷ কোনও বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত ছাডাই এসব ঘটেছিল কি! গুজরাটের ঘটনায় যদি বিজেপি–আরএসএসের ইন্ধন নাই থাকে, গুজরাট দাঙ্গার ওপর নির্মিত আরও দুটি ছবি পারজানিয়া (২০০৫) এবং ফিরাক (২০০৮) এর মুক্তি ও প্রদর্শনে তারা বাধা দিয়েছিল কেন! সুপ্রিম কোর্ট নরেন্দ্র মোদিকে ক্লিনচিট দিলেও এ সব প্রশ্ণের উত্তর ভারতবাসী আজও পায়নি৷ ভবিষ্যতেও যাতে না পায়, গোটা দেশে একটা শ্বাসরোধকারী ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে যাতে নরেন্দ্র মোদি সহ বিজেপি-আরএসএস এর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ণ তোলার সাহসটাকেই মেরে দেওয়া যায়, তাই বিজেপি শিবিরের এই উদ্যোগ আয়োজন৷
আসলে, ভেতরে ভেতরে নরেন্দ্র মোদিরাও জানেন, দেশের মানুষের মনে ক্ষোভের পাহাড জমা হচ্ছে, মন্দির-মসজিদ, ভারত-পাকিস্তান করেও সেই আগুন চাপা দেওয়া যাচ্ছে না৷ কেন্দ্রীয় সরকার যতই নরেন্দ্র মোদিকে ভারত-মসিহা বলে তুলে ধরুক, মোদি আর ভারতকে সমার্থক করে দেখাতে চাক, দেশের মানুষ প্রতিদিন হাডে হাডে টের পাচ্ছেন, মোদির বিজ্ঞাপনের ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ বা ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র সাথে তাঁদের নিত্যদিনের রুজিরুটির সমস্যার কোনও সম্পর্ক নেই৷ এই মোদি জমানায় ক্ষুধা সূচকে ১১৯টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭-এ পৌঁছেছে, বেকারত্বের হার রেকর্ড ছুঁয়েছে, ঐতিহ্যের নামে যাবতীয় বিকৃত ইতিহাস ও অপবিজ্ঞানের প্রচার চলছে, বাডছে ধর্মীয় হিংসা নারী নির্যাতন৷ আর এ সব নিয়ে প্রশ্ণ তুললেই সরকার দেশদ্রোহী রাষ্ট্রদ্রোহী ছাপ মেরে দমনমূলক আইন প্রয়োগ করে জেলে পুরছে প্রতিবাদীদের৷ এতে বিশ্বের দরবারে ভারতের মাথা যতই নিচু হোক, কেন্দ্রের সরকার এ নিয়ে চিন্তিত নয়, অন্য রাষ্ট্রপ্রধানরাও নিতান্ত বাধ্য না হলে এ সবের সমালোচনা করেন না৷ কারণ আজকের দুনিয়ায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো সকলেই পরস্পরের শোষণের দোসর, তাদের পারস্পরিক বাণিজ্যিক সম্পর্কের সাথে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের কোনও সম্পর্ক নেই৷ তাই কিছু দিন আগে কাশ্মীর ফাইলসের সমালোচনা করার জন্য যেমন ইজরায়েলি পরিচালক নাদাভ লাপিডকে তাঁর নিজের দেশের সরকারের রোষে পডতে হয়েছিল, তেমনই ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনকও বলেছেন, এই তথ্যচিত্রের বক্তব্যের সাথে তিনি সহমত নন৷ তবে যে যাই বলুক, মোদি সরকার খডকুটো অাকডে ধরার মতো করে এই তথ্যচিত্র আটকানোর যতই চেষ্টা করুক, সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলবেন, গুজরাটের কলঙ্কিত অধ্যায়ের জন্য মোদি সহ বিজেপিকে বারবার কাঠগডায় দাঁড করাবেন৷
এই তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করার দ্বারা ভারতে ইতিমধ্যেই তলানিতে ঠেকা ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা’র প্রকৃত চেহারাটা আরও একবার দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হল৷ বিজেপি সরকার বুঝিয়ে দিল, সংবাদমাধ্যম এবং শিল্পমাধ্যমকে তারা একটি স্বাধীনতাই দিয়েছে, তা হল মোদিজির এবং তার শাসনের গুণকীর্তন করার অবাধ অসীম স্বাধীনতা৷
প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে যে প্রশ্নোত্তর পর্ব দেখা যায় তা যে এক ধরনের মোটা দাগের নাটক, তাও সকলে জানেন৷ কাকে দিয়ে কী প্রশ্ন করানো হবে তা যেমন সাজানো থাকে, প্রশ্ন শুনে অস্বস্তির ভাব দেখিয়ে শেষে মোক্ষম উত্তরটি দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুন্সিয়ানা দেখানোর নাটকও গত একশো মাস ধরে দেশের মানুষ দেখে আসছেন৷ ‘মন কি বাত’-এর নির্ধারিত বিষয়ে প্রশ্নর বাইরে তাঁর পক্ষে প্রতিকূল কোনও প্রশ্ন করলে ‘শহুরে নকশাল’ সে না হয়েই যায় না৷ এমনকি কলমধারী সমালোচকদের তিনি বন্দুকধারীদের সমান বিপদজনক বলে প্রকাশ্যে হুমকি দিতেও এতটুকু দ্বিধা করেননি৷
অনুগত বাধ্য প্রজা না হয়ে যাঁরা কলম ধরেছেন, মানবাধিকারের কথা বলেছেন, তাদের অনেকের স্থান হয়েছে অন্ধকারার অন্তরালে৷ অবশ্য তারপরেও প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলতে পারেন, ‘যে কোনও সমালোচনাই হচ্ছে গণতন্ত্রের জন্য শুদ্ধিযজ্ঞ’৷ এমন শাসকবর্গ যেখানে রাষ্ট্র চালকের আসনে, সেখানে দেশের ভেতরে সংবাদমাধ্যমের ব্যবসায় নিয়োজিত যাঁরা, তাঁরা মোদি স্তুতির বাইরে যেতে ভয় পাবেন এটা স্বাভাবিক৷ কিন্তু দেশের বাইরের কিছু সংবাদমাধ্যম বড়ই বেয়াড়া৷ তাদের সবটা নাগাল পাওয়ার ক্ষমতা মোদি সরকারের নেই৷ বিবিসি তেমনই একটি সংবাদসংস্থা৷ অতএব তার প্রচারের অপছন্দ অংশ আটকানোর এই ব্যর্থ চেষ্টা সরকারের৷