জনসমুদ্র। আক্ষরিক অর্থেই। ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে জনতরঙ্গ এগিয়ে চলেছে রাজপথ ধরে। কিন্তু উত্তাল নয় এ স্রোত– সংযত, সুশৃঙ্খল আর প্রাণবন্ত।
রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ঠাসাঠাসি মিছিলের মুখগুলির দিকে তাকাও। শাসকের মুঠো থেকে দাবি ছিনিয়ে আনার শপথে দৃঢ় সেইসব মুখ। অত্যাচারীর সামনে বুক খুলে দাঁড়ানোর সাহস নিয়ে সূর্যের দিকে মাথা উঁচু করে তাকানো সেইসব মুখ। সাথীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জুলুমের জগদ্দল পাথর সরানোর সংগ্রামে শামিল হতে পারার আনন্দে উজ্জ্বল সেইসব মুখ।
চোখগুলি দেখো তাদের– ঝকঝক করছে আশায়। সমাজজোড়া জঞ্জালের পাহাড় তারা সরাবেই। আগামী প্রজন্মের জন্য সুন্দর এক নতুন সমাজ তারা গড়বেই। সেই লক্ষে্যই প্রিয় দলের ডাকে আজ পথে নেমেছে তারা। মুঠোবাঁধা হাতগুলি তাদের দেখো– স্লোগানের তালে তালে আকাশপানে তলওয়ারের মতো ঝলসে উঠছে যেন!
এ মহামিছিল দেখে মনে পড়ে যায় বইয়ে পড়া বিপ্লবোন্মুখ রাশিয়ার সেই দিনগুলির কথা। মনে পড়ে ‘রুশ বিপ্লব প্রবাহ’ বইয়ে মিছিলনগরী পেত্রোগ্রাদের ছবি। হ্যাঁ, আজ যে ২১ জানুয়ারি– মহান লেনিনের মৃত্যুদিন! প্রিয়তম সেই নেতার ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষের ওপর মানুষের যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা শোষণ অবসানের স্বপ্ন নিয়ে সেই ১৯১৭ সালে পথে নেমেছিল রাশিয়ার জনসাধারণ। হাতে তাদের লাল পতাকা। মার্কিন সাংবাদিক আলবার্ট রিস উইলিয়ামসের সেই অনবদ্য বর্ণনা– ‘১৯১৭ সালের গোটা বসন্ত আর গ্রীষ্মকাল জুড়ে চলল মিছিলের পর মিছিল… মিছিলের পুরোভাগে এখন পাদ্রি-পুরুতের বদলে জনগণ… হাতে তাদের লাল পতাকা, কণ্ঠে বিপ্লবের গান।….’ মার্কিন সাংবাদিক ছবি এঁকেছেন– ‘… বিশাল স্রোতের মতো সেই মিছিল গর্জে চলেছে নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক দিয়ে। … সবার মাথার উপরে টকটকে লাল ফেনার মতো ঝলমলিয়ে আন্দোলিত হচ্ছে হাজার লাল পতাকা। …’
রাশিয়ার সেইসব মিছিলের নদী শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল বিপ্লবের সমুদ্রে। নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন আর সেই স্বপ্নে পৌঁছানোর লক্ষে্য রাশিয়ার জনগণের দিনরাত এক করা, ঘাম ঝরানো মেহনত ভাসিয়ে নিয়েছিল সমাজের যা কিছু আবর্জনা। গোটা পৃথিবী অবাক হয়ে দেখেছিল এক নতুন সূর্যোদয়।
এই পৃথিবীরই বুকে স্বর্গ গড়ে তোলার স্বপ্ন সফল করার সাহস জুগিয়েছিলেন যিনি, আজ সেই মহান নেতার মৃত্যুদিবসে একুশে জানুয়ারির এ মহামিছিলও পা বাড়িয়েছে নতুন ভোর আনবে বলে। নিকষ অন্ধকারের বুক চিরে একদিন না একদিন নতুন সূর্য ছিনিয়ে আনবেই এ মিছিল। ততদিন লড়াই জারি রাখব আমরা। আশা আর স্বপ্ন বুকে নিয়ে কাটিয়ে দেবো দুর্বিষহ রাতগুলি।