এনআরএস মেডিকেল কলেজে ল্যাবরেটরি অ্যাটেন্ডেন্টের (ডোম) ৬টি শূন্যপদে নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। ন্যূনতম যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাশ, বেতন মাসে ১৫ হাজার টাকা। মাত্র ২৭ দিনে ৮ হাজার আবেদন জমা পড়েছে–ইঞ্জিনিয়ার প্রায় ১০০, স্নাতকোত্তর প্রায় ৫০০, স্নাতক ২ হাজারের বেশি। দেখে চক্ষু চড়কগাছ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরই। এই ঘটনা এ রাজ্যের তথা দেশের চাকরির জন্য হাহাকারের মর্মান্তিক চিত্রটিকে আরও একবার প্রকাশ্যে নিয়ে এল।
২০১৭-তে মালদহ মেডিকেল কলেজ, ২০১৯-এ কোচবিহার মেডিকেল কলেজ এই পদের বিজ্ঞাপন দিয়ে একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে কামারহাটির সাগর দত্ত হাসপাতালে ইন্টারভিউয়ে বেশ কিছু উচ্চশিক্ষিত সহ কয়েক হাজার প্রার্থী এসেছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। এর আগে একই রকম ছবি দেখা গিয়েছে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং অন্যান্য রাজ্যে। অনেক কম বেতনের ক্লার্কের চাকরি পেতে মরিয়া চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং, এমবিএ, এমনকি পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের।
অর্থনীতিবিদরা পর্যন্ত বলছেন, ‘কর্মহীনতা সাংঘাতিক জায়গায় পৌঁছেছে। করোনার আগে থেকেই দেশজুড়ে এই অবস্থা। করোনায় দেশের বেকারত্ব ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে।’ তবে যে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা কর্মসংস্থানের, সাধারণ মানুষের উন্নয়নের এত গল্প শোনাচ্ছেন! ভারত ৩ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি এবং বিশ্বের বৃহৎ অর্থনীতির অংশীদার বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। সারা দেশের বেকারত্বের চিত্র দেখে আত্মসন্তুষ্ট রাজ্যের মন্ত্রীরা দাবি করছেন, রাজ্যে বেকার যুবকের সংখ্যা কমে গেছে! এরপরও কি তারা এই দাবি করবেন?
শিল্প নেই, কলকারখানা বন্ধ, অসংগঠিত ক্ষেত্রে অল্পবিস্তর কাজের সুযোগ থাকলেও সেখানে ঘোর অনিশ্চয়তা– কাজের এবং বেতনের। ফলে সরকারি যে কোনও চাকরির, সামান্যতম বেতনের সুরক্ষার সুযোগ পেলে তাকেই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরছেন কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়ানো বিপুল বেকার-বাহিনী। ব্যক্তিগত এবং সাংসারিক জীবনে চরম অনটনের শিকার এই সব যুবকরা নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে বলি দিয়ে, লাশকাটা ঘরের কাজ পাওয়ার জন্য তাই এইভাবে বিশাল লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছেন। উচ্চশিক্ষিত এই যুবকরা যারা এই কাজ পাবেন তাঁরা যে শিক্ষা দক্ষতা অর্জন করলেন, সামাজিক যে সম্পদ এই শিক্ষাদানে ব্যয়িত হল– এ কি তার চরম অপচয় নয়?
রাজ্য তথা দেশে এই মর্মান্তিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হল কেন? আর্থিক উদারিকরণের ৩০ বছর অতিক্রম করল ভারত, বিশ্বের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী মহলে সংস্কার নীতির বাহবা কুড়োচ্ছে শাসক বিজেপি। কংগ্রেসের পথে হাঁটা বিজেপির এই সংস্কার নীতির সুফল নাকি এতটাই ফলেছে যে, ডিজিটাল অ্যান্ড সাস্টেনেবল ট্রেড ফেসিলিটেশন সমীক্ষা অনুযায়ী ভারত বহু উন্নত দেশকে ছাড়িয়ে ব্যবসায়িক উন্নয়নে ৯০ শতাংশের বেশি নম্বর পকেটে পুরে ফেলেছে (আনন্দবাজার পত্রিকা-২৪ জুলাই ‘২১)। কিন্তু এই ব্যবসায়িক লাভ গেছে কার ঘরে? প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নেতারা দু’বেলা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষকে বোঝাচ্ছেন, ভারতের উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখযোগ্য। এই সমীক্ষাই বলছে, উন্নয়ন হচ্ছে সমাজের মুষ্টিমেয় উপরতলার মানুষের– দেশের এক শতাংশ সুবিধাভোগী শ্রেণি, একচেটিয়া পুঁজিমালিকদের। নিরানব্বই ভাগ সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে, শোষণ করে, জাতীয় সম্পদ লুঠ করেই তাদের এই আর্থিক রমরমা। সর্বত্র সাধারণ মানুষের ভয়ঙ্কর দুর্দিন চলছে, বেকারির হার তরতর করে বেড়ে চলেছে। খাতায়-কলমে সরকারি হিসেবে মানুষের উন্নয়নের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হচ্ছে না। এই কথাটা কোনও বুর্জোয়া পণ্ডিতও আজ অস্বীকার করতে পারছেন না। বুর্জোয়া সংস্কারের পক্ষে তাঁরা যত বড় বড় কথাই বলুন, শ্রেণি বিভাজনের (মালিক-শ্রমিক) এই নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য (ধনী-দরিদ্র) বৃদ্ধির পুঁজিবাদী ফর্মূলাকে তাঁরা এড়িয়ে যেতে পারছেন না। এক শ্রেণির সীমাহীন লোভই যে আর এক শ্রেণির ভয়ঙ্কর দুর্দশার জন্য দায়ী, এই ভয়াবহ বৈষম্যের কারণ যে শোষণমূলক, ব্যক্তিমালিকানামূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, তা চাপা থাকছে না। ভয়াবহ বেকারির কারণও যে, মালিকের সর্বোচ্চ মুনাফার উপর নির্ভর করে থাকা এই ব্যবস্থা, তার স্বরূপটাই প্রকাশ্যে এসেছে করোনা অতিমারির এই দুঃসময়ে। তাই ক্ষমতাসীন দলগুলির দয়াভিক্ষা নয়, নেতাদের সহানুভূতি কুড়োনোর চেষ্টা করে নয়, মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে গেলে একদিকে কাজের দাবিতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, অন্যদিকে যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আজ বেশিরভাগ মানুষকে কর্মহীন অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে তাকে ভাঙার লড়াইয়ে সামিল হতে হবে।