ডেঙ্গুকে মহামারী ঘোষণা করে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মোকাবিলায় নামতে হবে

ডেঙ্গু সহ মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা দেশে মহামারীর আকার নিয়েছে৷ একে রুখতে সরকার চূড়ান্ত ব্যর্থ শুধু নয়, বিজ্ঞানবিরোধী নানা তত্ত্ব খাড়া করার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার ও পুর প্রশাসন৷

কয়েক দশক আগে পর্যন্ত ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগগুলি ইতিহাস হয়ে গিয়েছিল৷ অনেক আগে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এ রাজ্যে ঘটত৷ গত চার বছর ধরে আবার এই রোগগুলি মহামারী আকারে ফিরে এসেছে৷ সাধারণভাবে এই রোগে মৃত্যুর হার কম  হলেও ভোগান্তি এবং আর্থিক ক্ষতি মারাত্মক৷ একদিকে রোগ নির্ণয়, রোগের চিকিৎসা এবং রোগীর কর্মক্ষমতা লোপ পাওয়ায় অন্তত তিন–চার সপ্তাহ কর্মদিবস নষ্ট হওয়া– যে কোনও নিম্নবিত্ত–দরিদ্র মানুষের পক্ষে আর্থিকভাবে বিপর্যয়কর৷ এমন রোগগুলি গত চার বছর ধরে রাজ্যে বেড়ে চলেছে৷ বেড়ে চলেছে মৃত্যুর সংখ্যাও৷ তার কিছু কারণও আছে৷ যেমন, পুঁজিপতিদের স্বার্থে পরিবেশ রক্ষার তোয়াক্কা না করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা, অনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণ, মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সারা বছর ধরে নজরদারির কাজে পরিকাঠামো এবং সরকারের সদিচ্ছার অভাব, প্রতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রকৃত সংখ্যা চেপে যাওয়া ইত্যাদি৷ এর ফলে একদিকে যেমন, মশার (ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে এডিস ইজিপ্ঢাই) বংশের সাংঘাতিক বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, তেমনই সারা বছর মশা মারার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা, তা প্রায় না করায় রোগ ছড়িয়েছে– কলকাতা থেকে জেলায়৷ শহর থেকে গ্রামে৷

 

সবচেয়ে বড় বিষয়, ডেঙ্গু সহ মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে চরম অমানবিক, অগণতান্ত্রিক এবং অবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ৷ যে কোনও প্রতিরোধযোগ্য রোগের মানুষের মৃত্যুমিছিল কত বড়, তা এ রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে কত বেশি বা কম, এই বিচার যারা করেন তারা আর যাই হোক মানবিক মুখ নন, হতে পারেন না৷ অথচ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণের আগেই সরকারের সাফ কথা– অন্য রাজ্যগুলিতে এর প্রকোপ এবং ভয়াবহতা বহু গুণ৷

সরকার প্রকাশিত রোগীর সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা যদি সত্যিও হয়, তাহলেও মানুষের মৃত্যু নিয়ে কোথায় কম, কোথায় বেশি এ যুক্তি খাড়া করা যায় না৷ করলে তা সমস্ত নীতি– নৈতিকতা, মানবিকতার সীমাকেই লঙঘন করে, সরকার একমাত্র সেই কাজটাই করে চলেছে৷

জ্বরের প্রকোপ এ বছর মাত্রাতিরিক্ত৷ উত্তর ২৪ পরগণা, কলকাতা সহ রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই ঘরে ঘরে জ্বরের রোগী৷ বহু গ্রাম এবং শহর প্রত্যক্ষ করছে জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা সেখানে কীভাবে লাফিয়ে বাড়ছে৷ সরকার কিংবা পুর প্রশাসনের চোখে তা পড়ছে না৷ আসলে ডেঙ্গুর কারণে জ্বর হলে তা যে সব পরীক্ষায় ধরা পড়ে, যেমন এন এস–১, আইজিজি, আইজিএম ইত্যাদি পরীক্ষার ব্যবস্থা সরকারি ভাবে এতই অপ্রতুল, সেখানে বহু রোগী এইসব পরীক্ষার আগেই মারা যাচ্ছেন৷ ফলে অসংখ্য রোগীর রোগ নির্ণয় হতে পারছে না৷ মহামারী হলে যেখানে এনভিবিডিসিপি (ন্যাশনাল ভেক্টর বর্ন ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম) নামক কেন্দ্রীয় সংস্থাটির গাইড লাইন সমস্ত রাজ্যে মানতে হয়, সেখানে বলা আছে উপদ্রুত এলাকায় কীভাবে রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷ কীভাবে ভেক্টর অর্থাৎ রোগবাহী পতঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, কীভাবে সারা বছর ধরে রোগের এবং মশার উপর নজরদারি করতে হয়, রোগীর সংখ্যা চাপা না দিয়ে সঠিক সংখ্যাটি নির্ণয় করতে হয় এবং তার উপর দাঁড়িয়ে রোগ প্রতিরোধের পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়৷ যার একটিও সরকার করল না৷ গত তিন বছর ধরে তারা যা করেছে– রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফ্লেক্স টানিয়ে মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর নাম করে কার্যত ডেঙ্গু মহামারীর দায় এবং প্রতিকারের ভার সাধারণ মানুষের উপরই ছেড়ে দিয়েছে৷ আর মাঝেমধ্যে রাস্তার ধারে ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়েছে (সংবাদে প্রকাশ, ব্লিচিং–এর বদলে আটা বা চুনও ছড়ানো হচ্ছে)৷ ব্লিচিংয়ে মশা মরে এমন প্রমাণ কোনও বইয়ে নেই বা কোনও সরকারি গাইডলাইনেও নেই৷ আর চিকিৎসকদের উপর ফতোয়া জারি করছে– ‘ডেঙ্গু’ লেখা যাবে না৷ এর মধ্য দিয়ে যেমন তারা মেডিকেল এথিক্সের উপর আক্রমণ হানছে, তেমনই মানবসমাজকেও তথ্য গোপনের দ্বারা ভয়ঙ্কর এক বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে৷ কারণ, তথ্য যদি ১০ লক্ষের জায়গায় ১০ হাজার হয়, তা দিয়ে তো আর ১০ লক্ষ মানুষের জন্য পরিকল্পনা করা যায় না বা ব্যবস্থা গ্রহণও করা যায় না৷ ঘটনা মনে করিয়ে দেয়, বিগত সিপিএম সরকারও একইভাবে ম্যালেরিয়ার সংখ্যা এবং মৃত্যুর সংখ্যা কম করে দেখাতো৷ কলেরা মহামারীর সময় ‘আন্ত্রিক’ বলে চালাত৷ ঠিক যেমন এ বছর ‘অজানা জ্বর’ বলে চালানো হচ্ছে৷ যা একবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বড় লজ্জা৷ আজ চিকিৎসা বিজ্ঞানের এতদূর অগ্রগতি হয়েছে, যেখানে পিসিআর পরীক্ষার সাহায্যে মলিকিউলার স্তর পর্যন্ত রোগের কারণ নির্ণয় সম্ভব, কীভাবে সেখানে ‘অজানা জ্বর’ থাকতে পারে চিকিৎসকদের উপর ফতোয়া জারিও আজ নতুন নয়৷ নন্দীগ্রাম আন্দোলনে বুলেট ইনজুরি বা ধর্ষণের ঘটনাকে তখনকার সরকার ডাক্তারদের দিয়ে লিখতে বাধ্য করিয়েছিল ‘সাধারণ ইনজুরি’ হিসাবে৷ একদল চিকিৎসক তা করেওছিল৷ আজ আবার সেই পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে৷

ডেঙ্গু সহ মশাবাহিত রোগের প্রতিরোধে মানুষের যেমন সচেতনতা বাড়ানো দরকার এবং সে কাজ সরকারকেই করতে হবে, তেমনই পাশাপাশি সরকার ও পুরসভাগুলির সদর্থক ভূমিকা ছাড়া এই মড়কের হাত থেকে রেহাই নেই৷ প্রকৃতি বিরূপ, তাই ভাইরাস ও মশা তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে, রোগের চিকিৎসা জটিল হচ্ছে– বিজ্ঞানের এত অগ্রগতির যুগে এ কথা চলে না৷ প্রকৃতি তো সব দেশেই পাল্টাচ্ছে৷ এশিয়ায় ভারতের পাশাপাশি এগারোটি দেশের প্রকৃতিই পাল্টাচ্ছে৷ তাহলে সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ায় আজ ডেঙ্গু নির্মূল কীভাবে সম্ভব হল? আসলে মানুষের প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতা, দরদবোধই পারে এই জনস্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে৷ তাই উত্তর কোরিয়া পেরেছে৷ সেদিকে আমাদেরও নজর দিতে হবে৷ তাই অবিলম্বে ১) সরকারকে ডেঙ্গু সহ মশাবাহিত রোগকে মহামারী ঘোষণা করে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তার মোকাবিলা করতে হবে৷ ২) অজানা জ্বর নির্ণয় করতে অবিলম্বে সমস্ত জ্বরের রোগীর এন এস–১, আইজিএম এবং আইজিজি পরীক্ষার ব্যবস্থা বিনামূল্যে করতে হবে এবং তাদের চিকিৎসার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে৷ ৩) সম্প্রতি জ্বর হয়েছে এরকম সমস্ত মানুষের বিনামূল্যে আইজি–৬ পরীক্ষা করে প্রকৃত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ঘোষণা করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে৷ ৪) ডেঙ্গু সহ মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে এবং প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণের জন্য একটি বিশেষজ্ঞ কমিশন গঠন করতে হবে৷