৭৪ বর্ষ ১৭ সংখ্যার গণদাবীতে ‘অনলাইন শিক্ষাঃ শিক্ষা গৌণ, মুখ্য মুনাফাই’ শীর্ষক রচনাটিতে অনলাইন শিক্ষার মূল দিকটি তুলে ধরা হলেও, মুনাফা শিকারিদের উগ্র লালসা মেটাতে সরকারের অতি ব্যগ্র প্রয়াসে শিক্ষার প্রাণসত্তা নাশের ভয়াবহতার আরেকটি দিক অনালোচিত থেকে গেছে মনে করি।
জাতীয় শিক্ষানীতির এক একটি ক্ষতিকর বিষয় দ্রুত রূপায়ণের জন্য ইউজিসি ক্রমাগত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে নির্দেশ পাঠিয়ে চলেছে। ‘ব্লেন্ডেড মোড’ তেমনই একটি নির্দেশ। এই মোডে ৪০ শতাংশ অনলাইন এবং ৬০ শতাংশ অফলাইন শিক্ষার সাধারণ নির্দেশ রয়েছে। কিন্তু ব্লেন্ডেড মোড সম্পর্কিত ইউজিসি-র ৪৮ পাতার ডকুমেন্টটি ভালভাবে পড়লেই বোঝা যায় আক্রমণটা আরও মারাত্মক। সেখানে বলা হয়েছে, অনলাইন টিচিং ৭০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। সহজেই বোঝা যাচ্ছে, যতটা অনলাইন টিচিং বাড়বে, ঠিক ততটাই অফলাইন টিচিং কমবে। ফলে, পুরো প্রথাগত শিক্ষাকেই অনলাইন নির্ভর করে তোলা হচ্ছে। তাতে বর্তমান কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হয়ে উঠবে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত অনলাইন শিক্ষার সেন্টার। করোনা পরিস্থিতিতে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গুগুল মিটে বা জুম অ্যাপে যে অনলাইন ক্লাস চলেছে, সেখানে পড়ানোর সময় ছাত্ররা সরাসরি যুক্ত থেকেছে– যাকে বলা হয় সিনক্রোনাস পদ্ধতি। কিন্তু ব্লেন্ডেড মোডে তার থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অ্যাসিনক্রোনাস পদ্ধতির উপর। এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আপলোড করা ভিডিও ছাত্ররা নানা অ্যাপের মাধ্যমে দেখে শিখবে। শিক্ষককে সরাসরি পাবে না।
আবার ব্লেন্ডেড মোডে অফলাইন শিক্ষার কথা যেটা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে থাকছে ফিল্ড ভিজিট, স্পোর্টস, ফিজিক্যাল ট্রেনিং, অ্যাপ্রেনটিসশিপ, ফিজিক্যাল ল্যাব, এমনকি লাইব্রেরি থেকে বই দেওয়া নেওয়া পর্যন্ত। শিক্ষকদের ভূমিকা শুধু ১০-১৫ মিনিটের প্রারম্ভিক বলা বা সারাংশ টানা। এভাবে শিক্ষার বহু দিনের পরীক্ষিত পদ্ধতিকে বাতিল করে শিক্ষাকে কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রিত পণ্যে পরিণত করতে চলেছে।
অ্যাসিনক্রোনাস পদ্ধতিতে শিক্ষকেরও তেমন প্রয়োজন হবে না। টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপের মতো যারা বৃহৎ শিক্ষা ব্যবসায়ী, অর্থাৎ যে গ্রুপের পরিচালনায় বহু কলেজ রয়েছে, তারা একজন শিক্ষককে দিয়ে একবার একটি ক্লাস ভিডিও করে আপলোড করিয়ে নিলে, সেটা দিয়েই সবগুলি কলেজের ক্লাস করে নেবে। তার ফলে বেশি শিক্ষক নিয়োগ না করে, আপলোডেড ভিডিওগুলি অ্যাসিনক্রোনাস মোডে বছরের পর বছর চালিয়ে যেতে থাকবে।
বিশ্বব্যাপী মন্দা পরিস্থিতিতে কর্পোরেটের মুনাফা লোটার উর্বরক্ষেত্র হয়ে উঠবে শিক্ষা। শিক্ষকহীন ব্যবস্থায় ডিগ্রি হবে শিক্ষা নয়। শিক্ষকের কাছ থেকে মূল্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রভৃতি মনুষ্য-গুণ অর্জনের কোনও সুযোগ তাদের থাকবে না।
তপন চক্রবর্তী
বেহালা, কলকাতা