রাশিয়ার এক প্রান্তের দেশ ডনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিকের ফ্যাসিবিরোধী প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্ডার জাখারচেঙ্কো রাজধানী শহরের এক রেস্তোরাঁয় বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন গত ৩১ আগস্ট৷ মৃত্যু হয় তাঁর দেহরক্ষীরও, গুরুতর আহত হন তাঁর সঙ্গে থাকা ১২ জন, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন দেশের অর্থমন্ত্রী আলেক্সান্ডার টিমোফিয়েভ৷
বিস্ফোরণের পরিকল্পনা ও রূপায়ণে জড়িত থাকার অভিযোগে ডনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক (ডিপিআর) কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে৷ তাদের মতে ইউক্রেনের গোয়েন্দা বিভাগ ‘এসবিইউ’ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তারই নেতৃত্বাধীন যুদ্ধজোট ‘ন্যাটো’–র মদতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে৷
ইউক্রেনের সঙ্গে ডনেৎস্কের বিরোধ কেন? অনেকেরই হয়ত স্মরণে আছে, পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত, বর্তমানে স্বাধীন দেশ ইউক্রেনে ২০১৪ সালে সরকারবিরোধী অভ্যুত্থান হয় রাজধানী কিয়েভে৷ নয়া–নাৎসি চিন্তাধারার ‘ফ্রিডম পার্টি’–র নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থী এই অভ্যুত্থানে পিছন থেকে বিপুল সমর্থন জোগায় ও সাহায্য করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ৷ তাদের সঙ্গে হাত মেলায় ইউক্রেনের বৃহৎ পুঁজিপতিরা৷ দেশ ছাড়তে বাধ্য হন ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ৷ নতুন সংসদ তৈরি হয়, প্রেসিডেন্ট হন পেট্রো পোরোশেঙ্কো৷ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মদতপুষ্ট নতুন ইউক্রেনীয় সরকার সাম্রাজ্যবাদীদের মনমতো আইন তৈরি করে, দেশের অর্ধেক মানুষের কথ্যভাষা হওয়া সত্ত্বেও সরকারি ভাষা হিসাবে রুশ ভাষার স্বীকৃতি বাতিল করে দেয়৷ এই সময়েই রাশিয়ার দক্ষিণ–পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত ক্রিমিয়ায় গণভোট হয়৷ রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার যুক্ত হওয়ার পক্ষেই পড়ে অধিকাংশ ভোট৷ ফলে ক্রিমিয়া হয়ে যায় রাশিয়ার অঙ্গ৷ এরপর থেকেই ২০১৪–র এপ্রিল মাসে ইউক্রেনের পূর্বদিকের এলাকা ডনবাসের রুশ প্রভাবিত মানুষের বিরুদ্ধে নৃশংস যুদ্ধ শুরু করে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী৷ সেই যুদ্ধ এখনও চলছে৷ রাষ্ট্রসংঘের হিসাবেই এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দশ হাজারের বেশি৷ ওই বছরেরই মে মাসে যুদ্ধবিধ্বস্ত ডনবাস এলাকার জনমতের চাপে তৈরি হয় ডনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিক এবং লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিক, যারা নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করে৷ ওই বছরের আগস্টে ডিপিআর–এর প্রধানমন্ত্রী হন জাখারচেঙ্কো৷ ডনবাস এলাকায় ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে মিলিশিয়াদের লড়াইয়ে সামনের সারির মুখ ছিলেন তিনি৷
এই জাখারচেঙ্কো কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না৷ নয়া–নাৎসিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন তিনি৷ ফলে, যে বামপন্থা–ঘনিষ্ঠ ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী শক্তিগুলি ডনবাস অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তিনি ছিলেন তাদের প্রিয়পাত্র৷ রাশিয়ার সাহায্য ছাড়া ডনবাস এলাকার উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাও ছিল না, কারণ আমেরিকা সহ পশ্চিমের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির অবরোধের কারণে খাদ্য, ওষুধপত্র, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি বহু কিছুর ব্যাপক অভাবে তখন ভুগছিল ওই এলাকা৷ সাথে চলছিল ইউক্রেনের হামলা৷
ডনবাস এলাকায় যুদ্ধ বন্ধের উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত হয় মিনস্ক্ চুক্তি৷ যদিও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট ইউক্রেন সরকার, যার নেতৃত্বে আছেন দক্ষিণপন্থী পেট্রো পোরোশেঙ্কো, চুক্তি লংঘন করে নিয়মিত জনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলিতে বোমাবর্ষণ করে চলেছে৷ অবিরাম গোলাগুলি, অবরোধ ইত্যাদি সমস্ত রকম অসুবিধার মুখোমুখি হয়েও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মুখ হিসাবে ওই এলাকার মানুষের কাছে জাখারচেঙ্কো ছিলেন জনপ্রিয়৷ তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দিতে সমবেত হয়েছিলেন প্রায় দু’লক্ষ মানুষ৷
এর আগে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা এসবিইউ–এর হাতে খুন হয়েছেন জাখারচেঙ্কো ঘনিষ্ঠ দু’জন জনপ্রিয় মিলিশিয়া কম্যান্ডার৷ জাখারচেঙ্কোর উপরেও এর আগে বেশ কয়েকবার প্রাণঘাতী হামলা হয়েছে৷ এসবিইউ–এর এবারের হামলা এতদিনে সফল হল৷ বোঝাই যায়, পিছনে আমেরিকার সমর্থন না থাকলে ডনেৎস্কের একটি জনবহুল এলাকায় হামলা চালিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করা ইউক্রেনের মতো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে নির্ভরশীল একটি দেশের সরকারের একার পক্ষে সম্ভব ছিল না৷ সেই সম্ভাবনা আরও স্পষ্ট হয়ে গেল যখন ঘটনার পরদিনই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পোরোশেঙ্কোকে ওয়াশিংটনে যুদ্ধাপরাধী সেনেটর জন ম্যাককেইনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে দেখা গেল৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে এই ম্যাককেইন ইউক্রেনের ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সামিল হয়ে দক্ষিণপন্থীদের ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করেছিলেন৷
প্রশ্ন উঠেছে, কেন জাখারচেঙ্কোকে হত্যা করার জন্য এই সময়টিকে বেছে নেওয়া হল৷ বোঝাই যায়, ডনবাস এলাকার গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী সরকারের উপর থেকে তাদের বিশ্বাস টলিয়ে দেওয়াই ছিল হত্যাকারীদের প্রধান উদ্দেশ্য৷ এবং সেই অপচেষ্টা তাদের ব্যর্থ হয়েছে বোঝা যায় জাখারচেঙ্কোর শেষকৃত্যে মানুষের ঢল দেখে৷
এছাড়াও এই হত্যার একটি আন্তর্জাতিক তাৎপর্য আছে৷ এই হত্যা এমন একটি সময়ে সংঘটিত হল যখন সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদের সেনাবাহিনী রাশিয়া, ইরান ও লেবাননের হেজবোল্লার সাহায্যে মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাত থেকে ইডলিব প্রদেশ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে৷ এই ইডলিবই ছিল সন্ত্রাসীদের শেষ শক্ত ঘাঁটি৷ কয়েকদিন আগেই রুশ সামরিক বাহিনী হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, সিরিয়ায় বোমাবর্ষণের পিছনে যুক্তি জোরালো করতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আবার একটা রাসায়নিক হামলা ঘটাতে পারে সিরিয়ায়৷ এই সম্ভাবনার পক্ষে প্রমাণও রাষ্ট্রসংঘের কাছে পেশ করেছে সিরিয়ার প্রতিনিধিরা৷ অনেকের মতে জাখারচেঙ্কোকে হত্যা করে রাশিয়া ও তার সহযোগীদের হয়তো একটা হুঁশিয়ারি দিতে চেয়েছে আমেরিকা৷ সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলা চালানোর ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়ার বদলা নিয়েছে৷
বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, যুদ্ধবিরোধী শান্তিপ্রিয় মানুষকে জাখারচেঙ্কো হত্যাকাণ্ডকে তাৎপর্যহীন স্থানীয় ঘটনা হিসাবে দেখলে চলবে না৷ বরং, বিশ্বের সর্বত্র মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নাক গলানো বন্ধ করতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনকে আরও জোরদার করার আহ্বান জানায় এই ঘটনা৷ এর মধ্য দিয়েই ইউক্রেনে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নায়ক আলেক্সান্ডার জাখারচেঙ্কোকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব৷
(৭১ বর্ষ ৭ সংখ্যা ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)