জিও বিশ্ববিদ্যালয় নাকি দেশের শ্রেষ্ঠ ৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি ছা–পোষা ‘হরিপদ কেরানি’দের কথা ছেড়ে দিন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সাথে যুক্ত তাবড় শিক্ষাবিদদের কাছেও কি এমন তথ্য ছিল কোনও দিন!
কোথায় সেটি? জানা গেছে নবি মুম্বইয়ের কাছে একটি খোলা মাঠই নাকি সেই উৎকৃষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান রূপ, আগামী তিন বছরে বিল্ডিং হিসাবে যার রূপান্তর ঘটবে আপাতত বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ হল লকলকে সবুজ ঘাস আর চোরকাঁটার কিছু ঝোপ৷ ক্লাসঘর, ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি এসব কোনও কিছুরই যে অস্তিত্ব নেই না থাক, তবু তার উদ্যোক্তার নাম মুকেশ আম্বানি এবং নিতা আম্বানি– রিলায়েন্স কোম্পানির মালিক৷ এঁদের প্রসাদে চাটার্ড প্লেন চড়ে দলের প্রচার করে বেড়ান নরেন্দ্র মোদি–অমিত শাহরা৷ বিজেপির ভোট বৈতরণীর কড়ি যাঁদের টাকার থলি থেকে আসে, তাঁদের না–জন্মানো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতশ্রেষ্ঠ মান শুধু মাঠের ঘাস দেখেই কেন্দ্রীয় ‘এক্সপার্ট’ কমিটি যদি বুঝেই না ফেলল, তবে তাদের আর সরকারি মাইনে দিয়ে রাখা কেন?
ঘটনা হল, কেন্দ্রীয় সরকারের মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার এন গোপালস্বামীর নেতৃত্বে একটি এক্সপার্ট কমিটিকে দায়িত্ব দিয়েছিল দেশের মধ্যে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বেছে নিয়ে উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসাবে তুলে ধরতে৷ সেই কমিটি তিনটি সরকারি ও দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আম্বানিদের এখনও তৈরি না হওয়া ‘জিও বিশ্ববিদ্যালয়’কে বেছে নিয়েছে প্রথম ৬টি শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম হিসাবে৷
জানা গেছে, যে প্রতিষ্ঠানগুলিকে কমিটি উৎকর্ষতার স্ট্যাম্প দেবে তাদের ‘পূর্ণ স্বাধিকার’ দেবে সরকার৷ অর্থাৎ যথেচ্ছ ফি নেওয়া থেকে শুরু করে যথেচ্ছভাবে বিদেশি ছাত্রদের ভর্তি নেওয়া, কোর্সের সময়কাল, সাবজেক্ট কম্বিনেশন, শিক্ষকদের বেতনের পরিমাণ, তাঁদের যোগ্যতার মান সহ সবকিছুই বেসরকারি কর্তারা একতরফাভাবে ঠিক করতে পারবেন৷ সেখানে ছাত্ররা কিছু শিখুক– না শিখুক, টাকাটাই হবে মুখ্য বিষয়, সরকার হস্তক্ষেপ করবে না৷ আসলে শিক্ষার উৎকর্ষতা যাচাইয়ের নামে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করলে কত লাভ উঠবে তা দেখারই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই এক্সপার্ট কমিটিকে৷ মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক বলেই দিয়েছে সারা বিশ্বের ‘দায়িত্বশীল বিনিয়োগকারীরা’ যাতে ভারতের শিক্ষা ক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগ করে তার জন্যই এই ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ যাচাই৷ সেই কারণেই এই কমিটির মাথায় মোদি সরকার বসিয়েছে কোনও শিক্ষাবিদকে নয়, একজন আমলাকে৷ সরকারি এই এক্সপার্ট কমিটির ব্যাখ্যা অনুযায়ী উৎকর্ষের মানে দাঁড়িয়েছে উঁচু মানের পড়াশোনা–গবেষণা নয়, দেশি–বিদেশি নানা প্রতিষ্ঠানের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে নামী–দামি স্ট্যাম্পের জোরে সার্টিফিকেটের দাম বাড়ানো৷ উৎকর্ষতার এই স্ট্যাম্প আসলে শিক্ষা ব্যবসার বিজ্ঞাপন৷ আর বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির হয়ে বিশ্বজুড়ে এই বিজ্ঞাপনের দায়িত্বটি নিয়েছে মোদি সরকার৷
জিও বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হচ্ছে ‘গ্রিনফিল্ড ইউনিভার্সিটি’৷ অর্থাৎ সবুজ মাঠের বিশ্ববিদ্যালয়৷ তৈরি হওয়ার আগেই এর মালিককে কম সুদে ব্যাঙ্ক টাকা ধার দেবে৷ যদি বিশ্ববিদ্যালয় আদৌ তৈরি না হয়, ব্যাঙ্কের ধার শোধের কী হবে? অসুবিধা নেই, ব্যাঙ্কঋণ ফাঁকির নায়ক নীরব মোদি কিংবা বিজয় মালিয়ার পাশে থাকা বিজেপি সরকার কি আর তখন আম্বানিদের পাশে দাঁড়াবে না? লোভে লোভে এয়ারটেল কোম্পানি, বেদান্ত গোষ্ঠীর মতো নানা শিল্পপতি গোষ্ঠীও গ্রিনফিল্ড ইউনিভার্সিটি তৈরির লাইনে রয়েছে৷ এরা সবাই একখণ্ড করে জমি দেখিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি করছে৷ তারাও উৎকর্ষের স্ট্যাম্প পকেটে পুরল বলে!
২০০০ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীর আমলে শিক্ষার দিশা নির্ধারণের জন্য বিজেপি সরকার যে শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল তার আহ্বায়ক ছিলেন রিলায়েন্সের মালিক মুকেশ আম্বানি এবং সদস্য ছিলেন শিল্পপতি কুমারমঙ্গলম বিড়লা৷ তাঁরা সুপারিশ করেছিলেন, সরকার উচ্চশিক্ষাকে পুরোপুরি বেসরকারি মালিকদের হাতে ছেড়ে দিক৷ বলেছিলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে এমনভাবে ফি বাড়াতে হবে যাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে তা সমান হয়ে যায়৷ কারণ, একেবারে সাধারণ মানুষও সন্তানকে পড়াতে চায়৷ সেই মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসার জায়গা করে দিতে হবে পুঁজিপতিদের জন্য৷ কমিটি নিশ্চিত করে বলেছিল, কারখানা না চলতে পারে, কিন্তু শিক্ষা ব্যবসায় মুনাফার অভাব হবে না৷
রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার এর আগেই ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬’–তে শিক্ষাকে বিনিয়োগের প্রশস্ত ক্ষেত্র হিসাবে দেখায়৷ তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, ডিমড ইউনিভার্সিটি ইত্যাদির মাধ্যমে পুঁজিপতিদের লাভের বন্দোবস্তও করে দেয়৷ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পড়ে কেবল মাত্র সার্টিফিকেট বেচার জায়গা৷ দেখা যায় কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যে রাজ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে উঠেছে৷ দেখা যায়, পানের দোকানেও ঝুলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড৷ নরেন্দ্র মোদি সরকারের তত্ত্বাবধানে গ্রিনফিল্ড ইউনিভার্সিটির এই রমরমা সাধারণ ঘরের ছাত্রছাত্রীদের কাছে সেরকমইনির্মম রসিকতা হিসাবে এসেছে৷
বিশ্ববিদ্যালয় হল জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান৷ সরকার কিংবা পুঁজিমালিকদের শাসনের বেড়ি থেকে মুক্ত স্বাধীন চিন্তার পরিসর৷ কর্পোরেট পুঁজির ব্র্যান্ডওয়ালা বিল্ডিং তৈরি করে আর ম্যানেজমেন্টের লোক বসিয়ে কখনও জ্ঞানচর্চার এ হেন কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় না৷ শিক্ষাকে পূঁজিপতিদের মুনাফা শিকারের ক্ষেত্রে পরিণত করতে গিয়ে তাদের সেবাদাস বিজেপি–কংগ্রেসের মতো দল এভাবেই আজ শিক্ষার সর্বনাশ করছে৷ এর ফলে শুধু কিছু সাময়িক ক্ষতি নয়, বিরাট ক্ষতি হচ্ছে আগামী প্রজন্ম এবং সমগ্র মানব জাতির৷ বিজেপি সরকারের এমন সর্বনাশা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আজ অবশ্যকর্তব্য৷
(৭০ বর্ষ ৪৮ সংখ্যা ২০ জুলাই, ২০১৮)