Breaking News

ট্রাম বাঁচাতে রাস্তায় নামার ডাক দিলেন বিশিষ্টজনেরা


কলকাতায় মাত্র দু-তিনটি রুটে কয়েকটি ছাড়া বাকি সব রুটে ট্রাম চালানো বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। যানজট, ট্রামের শ্লথগতি ইত্যাদি বলে কোথাও ট্রামডিপো বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে, কোথাও রিয়েল এস্টেট ব্যবসা চলছে ট্রাম কোম্পানির জমিতে। কোথাও আবার পিচ ঢেলে ট্রাম লাইনই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পরিবহণ দপ্তরের কর্তা থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত সবার কাছে নাগরিকরা ট্রাম রক্ষার দাবি জানালেও তাতে তাঁদের কোনও আগ্রহ চোখে পড়েনি। ১৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী, স্বাধীনতা আন্দোলন ও বহু বামপন্থী আন্দোলনের স্মৃতি বহনকারী কলকাতা ট্রামের এই দুর্দশায় সরব হয়েছেন সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে বহু বিশিষ্টজন। ট্রাম রক্ষার দাবিতে ২০ মে কলকাতার স্টুডেন্টস হলে এক নাগরিক কনভেনশনের আয়োজন করেছিলেন তাঁরা।
কনভেনশনে সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং শিল্পী-সাংস্কৃতিক কর্মী-বুদ্ধিজীবী মঞ্চের যু¢¬ সম্পাদক দিলীপ চক্রবর্তী। বক্তব্য রাখেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল বিমল চ্যাটার্জী, বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়, ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক দেবাশিস ভট্টাচার্য, নাগরিক প্রতিরোধ মঞ্চের আহ্বায়ক প্রাক্তন সাংসদ ডাঃ তরুণ মণ্ডল, রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ অনুপ বন্দে্যাপাধ্যায় প্রমুখ। কনভেনশনে প্রস্তাব পাঠ করেন অধ্যক্ষ ডঃ নীলেশ মাইতি। ট্রামপ্রেমী মানুষের উপস্থিতিতে হল ছিল ঠাসা।


ট্রাম তুলে দেওয়ার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে জোরালো মতামত দেন বিশিষ্ট বক্তারা। তাঁরা বলেন, শিশু, বয়স্ক, অসুস্থরা ছাড়াও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সহ সাধারণ মানুষের জন্য অপরিহার্য যান ট্রাম। দূষণহীন, পরিবেশবান্ধব এই যান বর্তমানে দূষণময় পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যে সব দেশ ট্রাম তুলে দিয়েছিল তারা আবার ট্রাম চালু করছে। বিশ্বের ৪০০টির বেশি শহরে ট্রাম চলছে। শুধু কনভেনশন নয়, ট্রাম বাঁচাতে হলে আমাদের সকলকে রাস্তায় নামতে হবে। এবং এমনভাবে নামতে হবে যাতে সরকারের টনক নড়ে– কনভেনশনে দৃঢ় মত ব্যক্ত করেন বিমল চ্যাটার্জী। বয়সের বাধাকে উপেক্ষা করে তিনি এই আন্দোলনের প্রথম সারিতে থাকবেন বলে জানান। প্রতুল মুখোপাধ্যায় বলেন, আমরা কলকাতার জলাভূমি হারিয়েছি, খোলামেলা পরিবেশ হারিয়েছি, এখন দূষণহীন ট্রামও বন্ধ করে দিচ্ছে সরকার। অপরিকল্পিত নগরায়ণের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
ট্রাম বিশেষজ্ঞ দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, ট্রাম তুলতে যানজটের অজুহাত দেওয়া হয়। অথচ যে রাস্তায় ট্রাম চলে না, সেখানে অন্য গাড়ির গতি কি খুব বেশি? তিনি বলেন, গাড়ি কিংবা বাস খারাপ হয়ে ট্রামরুটের উপর দাঁড়িয়ে গেলে কি সেগুলি তুলে দেওয়ার কথা ওঠে? তা না হলে ট্রাম তোলার কথা কেন? এক একটি ট্রাম ৭০-৮০ বছর চলে। তার পেছনে খরচও হয় অত্যন্ত কম। নানা কারণে ট্রাম দপ্তরে দুর্নীতিও কম। অথচ বেশি খরচের, দূষণ ছড়ানো বাসের পরিবর্তে ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে সরকার নানা অজুহাত দিচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত যে সরকারের দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা, তা তিনি এক এক করে যুক্তি দিয়ে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ট্রাম বন্ধ করার জন্য পরিবহণ দপ্তর এবং ট্রাম কোম্পানি একে অপরকে দোষারোপ করে নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলছে।
তিনি আক্ষেপ করেন, কলকাতায় ট্রাম ডিপো রয়েছে, লাইন রয়েছে, ওভারহেড তার, সাবস্টেশন সহ ট্রাম চালানোর প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থাই রয়েছে। শুধু সরকারের সদিচ্ছার অভাবেই আজ বন্ধ হতে বসেছে ট্রামের মতো অবশ্যপ্রয়োজনীয় পরিবহণ। অনুপ বন্দে্যাপাধ্যায় বলেন, সরকার যদি শ্বেতপত্র প্রকাশ না করে তবে আমাদেরই সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে, যা ট্রাম রক্ষার আন্দোলনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
ডাঃ তরুণ মণ্ডল বলেন, গোটা বিশ্ব পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতায় আতঙ্কিত। ভবিষ্যতের জন্য কি চরম দূষিত একটি পৃথিবী রেখে যাব আমরা? তা না হলে অবশ্যই ট্রাম বাঁচানোর দাবিতে আমাদের রাস্তায় নামতে হবে। তিনি বলেন, কেন্দে্রর বিজেপি সরকার যে ভাবে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেচে দিচ্ছে, ঠিক সে ভাবেই রাজ্যের তৃণমূল সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত এই পরিবহণ ব্যবস্থাটির সমস্ত আর্থিক দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দিতে ট্রাম তুলে দিতে চাইছে। পূর্বতন সিপিএম সরকারও একই উদ্দেশ্যে ও নানা কায়েমি স্বার্থে ট্রাম তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। নাগরিকদের প্রতিবাদে সে অপচেষ্টা সফল হয়নি। এখন তৃণমূল সরকার সেই দায়িত্ব হাতে নিয়েছে। তরুণবাবু বলেন, এর বিরুদ্ধে প্রয়োজন হলে আমরা কলকাতার মেয়র এবং পরিবহণ মন্ত্রীর কাছে যাব। ট্রাম রক্ষার দাবিতে যতদূর যেতে হয় আমরা যাব। সভায় উপস্থিত নাগরিকেরা সোচ্চারে এই প্রস্তাবে সমর্থন জানান। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ট্রামের নিত্যযাত্রী, নিবন্ধকার সমরেন্দ্র প্রতিহার। উল্লেখ্য, একটি মাত্র রাজনৈতিক দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) ট্রাম রক্ষার দাবিতে রাস্তায় নেমেছে। দলের কর্মীরা মহানগরী জুড়ে নাগরিকদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন। তাঁরা ইতিমধ্যে কোম্পানির দপ্তরে ডেপুটেশন দিয়েছেন। আগামী ১ জুন পরিবহণ দপ্তর অভিযানের ডাক দেওয়া হয়েছে।