ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত একতরফা , প্রতিবাদ করছেন রুষ্ট নাগরিকরা

হাজরা মোড়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ

জনমতের কোনও তোয়াক্কা না করে কলকাতা শহর থেকে ট্রাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। ৫০টি রুটের মধে মাত্র ৩টি রুটে গুটিকতক ট্রাম চলছে। ট্রাম ডিপোগুলিও বিক্রি করে দেওয়া হবে। এর বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করতে কলকাতার রাস্তায় স্বাক্ষর সংগ্রহে নেমেছে এস ইউ সি আই (সি)।

ট্রাম বন্ধ হলে আমি আমার বাচ্চাকে স্কুলে দেওয়া-নেওয়া করব কী করে– ২৫ এপ্রিল হাতিবাগানে এস ইউ সি আই (সি)-র উদ্যোগে প্রচার চলাকালীন বললেন রেণুকা পাল। বললেন, এরকম একতরফা সিদ্ধান্তে সরকার ট্রাম তুলে দিতে পারে কি?

ট্রামে কম পয়সায় খুব আরামে নোনাপুকুর থেকে চাঁদনি চক দোকানে যাই। বেশি পয়সা দিয়ে প্রতিদিন অটোতে যাওয়াও সম্ভব নয়। ট্রাম তুলে দিলে আমরা বিপদে পড়ব– ওয়েলিংটন মোড়ে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে স্বাক্ষর সংগ্রহের ফর্মে সই দিয়ে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন মহম্মদ আসরাফ। তিনি পাড়ায় সই করানোর জন্য একটি ফর্মও নিয়ে গেলেন।

হাতিবাগান, ওয়েলিংটন, নোনাপুকুর, হাজরা, টালিগঞ্জ, খিদিরপুর সহ বিভিন্ন এলাকায় দলের কর্মীরা যখন পথচারী এবং অফিস-কর্মচারীদের সই দিতে বললেন, তখন এ ধরনেরই অভিজ্ঞতা হল তাঁদের। সরকার বলছে– ট্রাম চান না বহু মানুষ! সই করতে আসা মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে কিন্তু তেমনটা আদৌ মনে হয়নি। অনেকেই বললেন, শিশু-বয়স্ক-অসুস্থদের জন্য ট্রামের মতো সুবিধার যান আর নেই। সরকারি বাস নেই বললেই চলে। টিকিটের কমিশনের ভিত্তিতে চলা বেসরকারি বাসগুলির পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতায় যাত্রীদের নামা-ওঠা যেমন ঝুঁকির হয়ে যায়, তেমনই যাত্রী তোলার জন্য সেগুলি কখনও এত ধীরে চলে যে যাত্রীদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। ভাড়াও বেশি। তাই বহুজাতিক সংস্থার হাতে ট্রাম কোম্পানির জমি বেচে দেওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলনের স্বাক্ষরপত্রে সই দিয়ে শুধু জোরালো প্রতিবাদই জানিয়ে যাননি তাঁরা, চিরদিনের লড়াকু এই দলের উপরই ভরসা রেখে এই আন্দোলনকে আরও জোরদার করতে সব রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন।

ওয়েলিংটন মোড়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ

এর ব্যতিক্রম কি দেখা যায়নি? একজন পথচারী বললেন, জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে ট্রামের মতো ধীরগতির যান প্রয়োজন কী? স্বেচ্ছাসেবকরা তাঁকে বললেন– বিশ্বে উন্নতমানের ৪০০টি শহরে ট্রামই গুরুত্বপূর্ণ গণপরিবহণ এবং এই দূষণমুক্ত যানে বহু সংখ্যক মানুষ যাতায়াত করেন। যদি এখানেও রাস্তার দু’দিকে বেআইনি পার্কিং বন্ধ করে বিভিন্ন রুটে বেশি সংখ্যায় ট্রাম চালানো হয়, তা হলে এমন নিরাপদ ও কম খরচের যান আর নেই। তখন তিনিও এই যুক্তি ফেলতে পারলেন না।

ট্রামকে মৃত্যুশয্যায় পাঠাতে তৃণমূল সরকার টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর জমি আবাসন কোম্পানিকে এবং গ্যালিফ স্ট্রিট, কালীঘাট ও খিদিরপুরে গোয়েঙ্কা গোষ্ঠীর সি ই এস সি-কে বেচে দিয়েছে। অন্যান্য রুটগুলিতেও শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা ট্রামগুলিকে বসিয়ে রেখেছে, কোথাও ট্রাম রুট পিচ দিয়ে ঢালাই করে দিয়েছে। অর্থাৎ ট্রাম তুলতে সিপিএম সরকারের মতো তৃণমূল সরকারও বদ্ধপরিকর।

কলকাতা শহরের দেড়শো বছরের ঐতিহ্যবাহী সাথী ট্রাম তুলতে সরকারের যুক্তি, রাস্তায় জ্যাম হয়। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় চলা পথচারীরা জানেন, ট্রাম নির্দিষ্ট লাইনে চলে। তার জন্য জ্যাম হয় না। রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাটাডোর, প্রাইভেট কার, ঠেলা রিক্সা, অটো– যেগুলির থেকে পুলিশ-প্রশাসন মোটা টাকার কমিশন নেয়, সেগুলিই কার্যত রাস্তাকে অলিখিত গ্যারেজে পরিণত করেছে। এ জন্যই জ্যাম, যা চাইলে সরকারই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই সরকারের এই প্রতারণামূলক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ সই করছেন। সরকারকে এই জনবিরোধী নীতি প্রত্যাহার করতে বাধ্য করার জন্য প্রতিবাদ-আন্দোলনই একমাত্র রাস্তা– সে কথাই তুলে ধরছেন এস ইউ সি আই (সি) দলের কর্মীরা।