টু প্লাস টু ইকুয়ালস ফাইভ’৷ পরিচালক বাবাক আনভারি৷ প্রবীণ সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের হত্যার প্রেক্ষিতে নতুন করে ভাবাল মিনিট সাতেকের এই ছবিটি৷
সাদামাটা ছোট্ট ক্লাসরুম৷ স্যার ঢুকতেই থেমে যায় ছেলেদের গুঞ্জন৷ ইন্টারকমে হেডস্যারের ঘোষণা–আজ থেকে স্কুলের পঠনপাঠনে আসবে কিছু পরিবর্তন৷ ছাত্ররা যেন মেনে চলে সব নির্দেশ৷ পড়া শুরু হয় ২+ ২= ৫ দিয়ে৷ দুই যোগ দুই কত হয়? নামতা পড়ার মতো মুখস্থ বলিয়ে ছেলেদের গিলিয়ে দিতে চান শিক্ষক৷ একজন উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু গলায় কিছু বলতে চায়৷ ধমকে থামিয়ে দেন তাকে৷ উঠে দাঁড়ায় আর একজন–দুই যোগ দুই চারই হয় স্যার, পাঁচ হতেই পারে না৷ স্যার আবার ধমকান৷ কে তোমাকে কথা বলার অনুমতি দিয়েছে? এবার কিন্তু ধমকে কাজ হয় না৷ এক বগগা ছেলেটা সমানে জোরগলায় বলে যায়–দুই যোগ দুই তো চার৷ ঝামেলার ভয়ে বন্ধুরা থামাতে চায় তাকে৷ ক্ষিপ্ত স্যার বেরিয়ে যান, ফিরে আসেন উঁচু ক্লাসের তিন ছাত্রকে নিয়ে৷ স্যারের সথে সুর মিলিয়ে তোতাপাখির মতো আওড়ায় তারা– দুই যোগ দুই পাঁচ৷ এবার ওই অবাধ্য ছেলেটার ডাক পড়ে বোর্ডে৷ এটাই তার শেষ সুযোগ৷ নাৎসীদের মতো ব্যান্ড পরা তিন জোড়া হাত কাল্পনিক রাইফেল বাগিয়ে আছে তার দিকে৷ স্যারের রাগী মুখ, বন্ধুদের ভয়ার্ত চোখ৷ একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ছেলেটা৷ নিষ্পাপ মুখে শত সূর্যের আলো৷ তারপর বলিষ্ঠ হাতে লেখে ২+ ২= ৪৷ গুলির শব্দের সাথে বোর্ডে চলকে ওঠে তাজা রক্ত৷ ফুলের মতো শরীরটা টেনে নিয়ে যায় তিনজন৷ ক্লাসে পিন পড়া নৈঃশব্দ৷ ডাস্টার দিয়ে রক্ত মুখে স্যার আবার লেখেন ২+ ২= ৫৷ সবক শেখানোর তৃপ্তি তার ভাবলেশহীন মুখে৷ আবার শুরু হয় নামতা আওড়ানো৷ এবার আর উঠে দাঁড়ায় না কেউ৷ ক্লাসরুমের ওপর দিয়ে প্যান করে ক্যামেরা থামে শেষদিকে বসে থাকা এক ছাত্রের খাতায়৷ ২+ ২= ৫–এর পাঁচটা কেটে চার লিখেছে সে৷
সত্যের আলো এইভাবেই ছড়িয়ে যায় এক মন থেকে অজস্র মস্তিষ্কে, মননে৷ প্রতিবাদের টুঁটি টিপে আটকানো যায় না তাকে৷ আমাদের এই ২০১৭ সালের ভারতের আশ্চর্য মিল ওই দমবন্ধ করা ধূসর ক্লাসরুমটার সাথে৷ গোরক্ষার নামে একের পর এক নিরীহ মানুষের হত্যা, গণেশের মাথায় প্লাস্টিক সার্জারি আর পুষ্পক রথে এরোপ্লেনের কারিগরি, বিবেকানন্দ আর দীনদয়াল উপাধ্যায়কে একই সারিতে বসানোর চেষ্টা, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ বা একটি বিশেষ দেশকে শত্রু বলে দাগিয়ে দেওয়া–এমন আরও বহু অন্যায়, অসত্যের পাহাড় প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে আমাদের চারপাশে৷ ভয়ের কথা– বেশ কিছু মানুষকে সহজেই বিশ্বাস করানোও যাচ্ছে এসব৷ কিন্তু যারা মানতে চাইছি না, নিজেদের এই বিভ্রান্তির বাইরে রাখতে চাইছি– তারাও যথেষ্ট সরব হচ্ছি কি? একটু তর্কবিতর্ক করছি, বড়জোর মতামত দিচ্ছি সোস্যাল মিডিয়ায়৷ এর বেশি ভাবতে চাইছি না খুব একটা৷ কোথাও একা হয়ে যাওয়ার ভয়, কোথাও নিশ্চিন্তে গা বাঁচিয়ে চলার মোহ আটকে দিচ্ছে আমাদের৷ সেই সুযোগেই তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে–দাভোলকর, পানসারে, গৌরী লঙ্কেশ৷ হিন্দুত্বকে মনুষ্যত্বের ওপরে স্থান দিতে না চাওয়া বিরুদ্ধ স্বরকে সমঝে দেওয়ার প্ল্যান৷ তাই কাজ শুধু শান্তি চাওয়া যথেষ্ট নয়৷ এই উগ্র হিন্দুত্বের আড়ালে যুক্তি–বুদ্ধি–মানবিক মন নষ্ট করে দেওয়ার ফ্যাসিবাদী নীল নকশাকে চিনে নেওয়া জরুরি৷ পথে নামা জরুরি৷ আর তার জন্য জরুরি ওই বছর দশকের ছোট্ট ছেলেটির মতো চোখে চোখ রেখে সত্যি বলার হিম্মত৷
সূর্যস্নাতা সেন, কলকাতা–৭০০০০২