টু–জি কেলেঙ্কারি : ‘খাঁচার তোতা’ জানাল সবই নাকি মায়া

কোথাও কোনও দুর্নীতি খুঁজে পাওয়া গেল না৷ অথচ সরকারি কোষাগারের ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা উধাও! দেশের কোটি কোটি খেটে খাওয়া মানুষের বহু কষ্টার্জিত টাকায় গড়ে ওঠা সরকারি তহবিলের অংশ ছিল তা৷ এই টাকা গায়েব, অথচ ৭ বছর তদন্তের পর মোটা বেতন–সুযোগ–সুবিধাধারী সিবিআইয়ের তাবড় অফিসাররা কোর্টে কিছুই প্রমাণ করতে পারলেন না! নাকি চাইলেন না!

বোফর্স কেলেঙ্কারি, দিল্লির শিখ নিধন যজ্ঞ, কর্ণাটকের খনি কেলেঙ্কারি, অক্ষরধাম মন্দিরে হামলা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস ইত্যাদি অসংখ্য মামলায় সিবিআইয়ের ‘ব্যর্থতার’ তালিকা বেড়েই চলেছে৷ গুজরাটে ২০০২ সালের সংখ্যালঘু গণহত্যার নায়ক বিজেপি নেতা–মন্ত্রীদের বাঁচাতে সিবিআইয়ের ভূমিকা সর্বজনবিদিত৷ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জানেন সারদা মামলায় সিবিআইয়ের লম্ফঝম্পের পর ফলাফল শূন্য৷ ছোট আঙারিয়া, নন্দীগ্রাম, নেতাইয়ের গণহত্যাকারীদের শাস্তি দূরে থাক, সিবিআই তদন্ত কাউকে ধরতেই পারেনি৷ সিঙ্গুর আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবক তাপসী মালিককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনাতেও খুনি ধরতে সিবিআই ব্যর্থ৷ এ নিছক ব্যর্থতা বা অপদার্থতা নয়, এ হল পরিকল্পিত ব্যর্থতা৷ কেন্দ্রে বা রাজ্যের মসনদে যে দলগুলি নানা সময় ক্ষমতায় থেকেছে বা এখন বিরোধী আসনে থাকলেও পরে গদিতে বসতে পারে, তাদের কেষ্ট–বিষ্টুদের অপকর্মের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সিবিআইয়ের মাথাব্যথা কোনওদিনও ছিল না, আজও নেই৷ টু–জি স্পেকট্রাম মামলাতেও বিচারক বলেছেন, সিবিআই প্রথমে খুব তেড়েফুঁড়ে মামলা লড়ছিল তারপর যত দিন গেছে তত যেন উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে তারা৷ তাদের দিশাহীন অবস্থা এবং অতিসাবধানী হয়ে সব দিক বাঁচিয়ে চলার ভাব দেখে মনে হচ্ছিল কী খুঁজতে হবে আর কী প্রমাণ করতে হবে সেটাই যেন সিবিআই জানে না! সিবিআইয়ের হয়ে মামলা লড়ছিলেন যাঁরা সেই স্পেশ্যাল পাবলিক প্রসিকিউটর এবং সিবিআইয়ের নিয়মিত আইনজীবী দু’জনে দুই দিকে চলছিলেন৷ কিন্তু কেন? তাঁরা তো নাবালক বা নিছক এফিডেভিট করার উকিল নন মনে রাখা ভাল, ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে বলেছিল ‘খাঁচায় পোষা তোতা’, অর্থাৎ সে শুধু মনিবের শেখানো কথা আউড়ে যায়৷ সিবিআই–এর প্রাক্তন অধিকর্তা রণজিৎ সিনহাকে টু–জি মামলা থেকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টই৷ ফলে তদন্তের মান কী দাঁড়াতে পারে তা অনুমান করার জন্য বিরাট পণ্ডিত হতে হয় না৷

এই মামলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দেখা যাক৷ ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ল্যান্ডলাইন ও মোবাইল পরিষেবার লাইসেন্স বন্টন করার জন্য কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের টেলিকম দফতর দরপত্র আহ্বান করে৷ শেষ তারিখ ছিল ১০ অক্টোবর৷ কিন্তু ২০০৮ সালের ১০ জানুয়ারি হঠাৎ করে তারা জানায় যারা ১ অক্টোবরের মধ্যে দরপত্র দিয়েছিল শুধু তাদেরই যোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে৷ ফলে জমা পড়া ৫৭৫টি আবেদনের ৪০৮টিই বাতিল হয়ে যায়৷ অভিযোগ ওঠে সাত বছর আগেকার দর রেখে এবং সময় পাল্টে কিছু বিশেষ সংস্থাকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ২০০৯ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় ভিজিলেন্স কমিশন সিবিআইকে এ বিষয়ে তদন্ত করতে বলে৷ দিল্লি হাইকোর্টও বলে অনিয়ম হয়েছে৷ ওই বছরই ২০ নভেম্বর কর্পোরেট  জনসংযোগ সংস্থা বৈষ্ণবী কমিউনিকেশনস–এর আধিকারিক নীরা রাডিয়ার সঙ্গে টাটাদের কথোপকথনের একটি  অডিও টেপ কেন্দ্রীয় আয়কর দফতর থেকে প্রকাশ হয়ে গেলে জানা যায় টাটা, রিলায়েন্সের মতো একচেটিয়া গোষ্ঠী কীভাবে সরকারি নীতিতে প্রভাব খাটিয়েছে৷ ২০১০ সালের ৩১ মার্চ সর্বোচ্চ সরকারি হিসাব পরীক্ষক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) জানান, এই প্রক্রিয়ার পুরোটাই ছিল অস্বচ্ছ এবং পক্ষপাতদুষ্ট৷ ১৩ সেপ্ঢেম্বর সুপ্রিম কোর্টে ৭০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে তিনটি মামলা দায়ের হয়৷ তৎকালীন কেন্দ্রীয় টেলিকম ও যোগাযোগ মন্ত্রী এ রাজার কৈফিয়ত তলব করে সর্বোচ্চ আদালত৷ কয়েকদিন বাদে সুপ্রিম কোর্টকে ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট) জানায় বিদেশি মুদ্রা আইনও ভাঙা হয়েছে৷ ১০ নভেম্বর ২০১০ সিএজি বলে গোটা প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা, নিলাম না করে ইচ্ছামতো স্পেকট্রাম বিলি ইত্যাদি কারণে রাজকোষের ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে৷ সুপ্রিম কোর্ট স্পেকট্রাম প্রাপক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেয়৷ অভিযোগ ওঠে এ রাজার দল ডিএমকে প্রধান করুণানিধির কন্যা কানিমোঝির টিভি চ্যানেলে এই ক্ষেত্রে প্রাপ্ত ঘুষের ২০০ কোটি টাকা ঢালা হয়েছে৷ ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট এই মামলার বিচারের জন্য বিশেষ আদালত গঠন করে৷ ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্টই অনিয়মের অভিযোগে ১২২টি টেলিকম সংস্থার লাইসেন্স বাতিল করে দেয়৷ প্রশ্ন ওঠে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের ভূমিকা নিয়েও৷ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলেন, শরিকদের নিয়ে চলতে গেলে অনেক আপস করতে হয়৷ অর্থাৎ তিনিও দুর্নীতি অস্বীকার করেননি৷ শুধু কংগ্রেসের বদলে ডিএমকে–র মতো শরিকরা দায়ী বলেছিলেন৷ এই মামলায় ডিএমকে নেতা এ রাজা, কানিমোঝি যেমন গ্রেফতার হয়েছিলেন, তেমনই একাধিক উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার সহ এসার গোষ্ঠীর অংশুমান ও রবি রুইয়া, লুপ টেলিকম সংস্থার কিরণ খৈতান, আই পি খৈতান প্রমুখ কর্পোরেট জগতের কর্ণধার যাঁরা ভোডাফোন, ডোকোমো, ইউনিনর ইত্যাদি নানা বৃহৎ কোম্পানির সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করছিলেন, তাঁরাও অভিযুক্ত হন৷

সিবিআই বিশেষ আদালতের এবারের রায় দেখে কংগ্রেসের নেতারা উল্লসিত যে, তাদের জমানার একটি দুর্নীতির অভিযোগ অন্তত কমল৷ কিন্তু বিষয়টি আদৌ কি তাই? লাইসেন্স বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি জিএস সিঙভি এবং অশোককুমার গাঙ্গুলির ডিভিশন বেঞ্চ সে সময় স্পষ্ট ভাষায় বলেছিল এই লেনদেন জনস্বার্থবিরোধী, সমতা রক্ষার নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত৷ যৌথ সংসদীয় কমিটিও দুর্নীতির কথা বলেছিল৷ কিন্তু সিবিআই আদালতের বিচারকের মন্তব্যই বুঝিয়ে দিচ্ছে এই দুর্নীতির ঝাঁপি উদঘাটিত হোক তা সিবিআই চায়নি৷ কিন্তু কেন? প্রথমত, এই মামলায় কর্পোরেট জগতের একাধিক ব্যক্তির নাম জড়ানোয় শিল্পপতি মহল বিনিয়োগ গেল গেল বলে রব তুলে দেয়৷ ফলে তাদের খুশি করার দায় ছিল সরকারের উপর৷ পুঁজিবাদের প্রবক্তারা মুখে বলে অবাধ প্রতিযোগিতা৷ কিন্তু শিল্প গড়বে, আইন মেনে ব্যবসা করে অবাধ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মুনাফা ঘরে তুলবে, পুঁজিবাদের সে যুগ চলে গেছে বহুকাল আগে৷ এখন ফাটকার কারবার আর উচ্চপদস্থ আমলা–নেতা–মন্ত্রীদের প্রভাবিত করে, ঘুষ দিয়ে মুনাফা কামানো ছাড়া পুঁজিপতিদের আর কোনও উপায় নেই৷ এর নাম ক্রোনি ক্যাপিটালিজম৷ এখন একজন পুঁজিপতি আলাদা করে অসৎ হয় না, পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটাই দুর্নীতিগ্রস্ত৷ বিজেপি কংগ্রেসের মতো বুর্জোয়া দলগুলি এদের নায়েব–গোমস্তার মতো কাজ করে বলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এদের কারও পক্ষে প্রকৃত অর্থে সম্ভব নয়৷ বিজেপি জমানায় আম্বানি–আদানিরা যে বেপরোয়া কার্যকলাপ চালাচ্ছে, কংগ্রেস ফিরে এলে কি তার বিচার করতে পারবে? একইভাবে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসি জমানার বিচার সিপিএম করেনি, সিপিএম জমানার কোনও দুর্নীতির বিচার তৃণমূল করতে পারেনি৷ এই মামলাতেও সিবিআইয়ের কোনও অফিসারের সাধ্যই ছিল না প্রকৃত পদক্ষেপ করার৷  দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস এখন কেন্দ্রীয় সরকারি মসনদে না থাকলেও বিজেপির বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ দেখে কর্পোরেট মহল এখন ডুবন্ত কংগ্রেসকে আবার ভাসিয়ে তুলতে চাইছে৷ এটাই ওদের দ্বিদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য৷  গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রতি সংবাদমাধ্যমের সমর্থন এ কারণেই৷ ভারতের মতো পুঁজিবাদী দেশে পুলিশি তদন্ত থেকে বিচারব্যবস্থা কোনও কিছুই যে একচেটিয়া মালিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে পারে না তা বলাই বাহুল্য৷ ফলে কংগ্রেসের মুখ বাঁচানোটাও পুঁজিপতিদের দরকার, যাতে দরকারে আবার তাকে গদিতে বসিয়ে সেবা নেওয়া যায়৷ তৃতীয়ত, মাত্র কিছুদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ডিএমকে প্রধান করুণানিধির সঙ্গে দেখা করে তাঁকে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নিবাসে আতিথ্য গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছেন৷ তারপরেই করুণানিধি কন্যা কানিমোঝি ও তাঁর দলের নেতা এ রাজার ছাড়া পেয়ে যাওয়া যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ৷ ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতিতে দীর্ঘ দিন ধরেই এটা প্রায় প্রথায় দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষমতাসীন দল অন্যান্য দলের দুর্নীতিকে হাতিয়ার করে তাদের ব্ল্যাকমেল করে৷ সিবিআইকে কাজে লাগিয়ে কখনও গ্রেপ্তার করে, কখনও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ছাড়িয়ে আনে৷ বিজেপি এই খেলাতে যথেষ্ট দক্ষ৷ কংগ্রেসও ঠিক এই কাজ করত জয়ললিতা কিংবা মায়াবতীর দলকে ধরে রাখতে৷ ডিএমকের সাথে কংগ্রেসের দূরত্ব বাড়াতে বিজেপি সিবিআইকে এই রকম অথর্বের ভূমিকায় অভিনয় করালো কি না সে সন্দেহও উঠছে৷

বোফর্স, টু–জি, বাংলায় সারদা, নারদ, মধ্যপ্রদেশে ব্যপম কেলেঙ্কারি – কোথাও সিবিআই বা ইডি কোনও সংস্থাই দুর্নীতিগ্রস্তদের ধরে শাস্তির ব্যবস্থা করেনি৷ একদিকে যেমন নির্বাচনী ইস্যু হিসাবে অভিযোগগুলি জিইয়ে রাখার তাগিদ থাকে শাসকদলের পক্ষ থেকে, একই সাথে এই প্রতিটি দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতা–মন্ত্রীরা যাদের এজেন্ট হিসাবে দুর্নীতি করে সেইসব প্রভাবশালী পুঁজিমালিকদের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা কোনও আমলা বা বিচারকের নেই৷ ভোটসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলির কাছে দুর্নীতির ইস্যু কেবলমাত্র ভোটের প্রচারের একটি  হাতিয়ার মাত্র৷ এই দলগুলি যে যখন ক্ষমতায় থাকে, দুর্নীতি করে৷ তাই এরা সকলেই একে অপরের দুর্নীতির বিরুদ্ধে গলা ফাটায়, কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্তদের নিয়েই চলে৷ শুধু কে বেশি, কে কম তাই নিয়ে চলে টানাটানি৷ সিবিআইয়ের ভূমিকা যে ধাঁধার জন্ম দিয়েছে অর্থাৎ টাকা গায়েব, কিন্তু কেউ তা চুরি করেনি– এ ধাঁধার উত্তর রয়েছে ভারতের অর্থনৈতিক–রাজনৈতিক ব্যবস্থারই দুর্নীতিগ্রস্ত চরিত্রে৷