টিকার ফাঁপা হিসাব দিয়ে ব্যর্থতা ঢাকা যাবে না

দেশজুড়ে মহা আড়ম্বরে পালন করা হল করোনা ভ্যাকসিনের ১০০ কোটি ডোজ পূর্ণ হওয়ার দিনটি। সমস্ত সরকারি বেসরকারি চ্যানেলে সারাদিন প্রচার চলল। সারা দিল্লি আলোয় মুড়ে দেওয়া হল। চতুর্দিকে সাজো সাজো রব। মোদি বন্দনায় মেতে উঠল ভক্তের দল। ‘শক্তিমান’, ‘বাহুবলী’ এমন কল্পজগতের মহাবীরদের সাথে তুলনা করা হল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির।

কেন্দ্রীয় সরকারের দাবির সাথে বাস্তবের মিল কতটা! ১০০ কোটি ভ্যাকসিন শুনলে মনে হবে, দেশের ১০০ কোটি মানুষ বোধহয় দু’ডোজ ভ্যাকসিন পেয়ে গেছেন। বাস্তবটা একেবারেই তা নয়। ১৩৯ কোটির দেশে দু’ডোজ ভ্যাকসিন পেয়েছেন মাত্র ২৯ কোটি মানুষ, যা জনসংখ্যার ২১ শতাংশ মাত্র। ২৪ থেকে ২৫ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এখনও প্রথম ডোজই পাননি। এর মধ্যে রয়েছেন ৬০ বছরের বেশি বয়সি প্রায় ৩ কোটি মানুষ। এ বছরের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক সব মানুষকে টিকা দেওয়ার সরকারি অঙ্গীকারের ফানুস চুপসে যাচ্ছে বাস্তব হিসেব আর টিকাকরণের ধীরগতিতে। তা হলে ১০০ কোটি ভ্যাকসিনের প্রচার বিজেপির আর একটি জুমলা ছাড়া আর কী!

তা হলে কেন এই চটকদার প্রচার? করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে গণচিতার মর্মান্তিক দৃশ্য, গঙ্গায় শত শত মৃতদেহ ভেসে যাওয়ার দৃশ্য মানুষ ভোলেনি এখনও। সামান্য অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করতে করতে অসংখ্য মানুষের অসহায় মৃত্যু দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কঙ্কালটিকে বেআব্রু করে দিয়েছিল। অথচ এর দায় কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেউই নিতে চাননি। মানুষ যখন মরছে, তখন মোমবাতি জ্বালানোর, থালা বাজানোর, হাততালি দেওয়ার নিদান দিয়েছিলেন যিনি, তিনি এর দায় এড়াবেন কোন যুক্তিতে! করোনা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের যা করার প্রয়োজন ছিল, তা করার জন্য সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের পরে যথেষ্ট সময় পেলেও সরকার তার যথাযথ ব্যবহার করেনি।

পরিবর্তে একের পর এক বিভ্রান্তিকর বাণী দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। একটা পরিপূর্ণ ভ্যাকসিন নীতিও ঘোষণা করতে পারেনি সরকার। এই ব্যর্থতার বিরুদ্ধে জনমনে প্রবল ক্ষোভ রয়েছে। আসলে সেই ব্যর্থতার দায় ঢেকে ফেলতেই মিথ্যার রাংতায় মুড়ে ১০০ কোটি ভ্যাকসিনের এই ঝলমলে প্রচারের আয়োজন। দেশের সাধারণ মানুষ মূল্যবৃদ্ধির চাপে জেরবার। রান্নার গ্যাস ১০০০ টাকা ছুঁই ছুঁই, পেট্রল-ডিজেল ১০০ পার, ভোজ্য তেল ২০০ টাকা, ওষুধ থেকে সবজি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাগামছাড়া। অন্য দিকে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার। এই পরিস্থিতিতে ১০০ কোটি ভ্যাকসিনের প্রচারের জৌলুস, জীবন যন্ত্রণায় জর্জরিত মানুষের সামনে নিষ্ঠুর পরিহাস ছাড়া আর কী হতে পারে!

এ এক প্রচারসর্বস্ব সরকার। সরকারের কার্যকলাপ দেশের মানুষ সমর্থন করছে না, এই ভয় থেকেই প্রচারের জৌলুসে মানুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে চায় সরকারের নেতা-মন্ত্রীরা। যেখানে প্রয়োজন ছিল যত দ্রুত সম্ভব সকলকে ভ্যাকসিন দেওয়া, সেখানে মোদির জন্মদিনকে ‘স্মরণীয়’ করে রাখতে কিছুদিন ভ্যাকসিন সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে ওই দিন ১ কোটি ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। এ কোন সভ্য সমাজ! রাজতন্ত্রের যুগে রাজার জন্মদিন কিংবা জমিদারের বিড়ালের বিয়ে মহা আড়ম্বরে হত। আজ করোনা অতিমারির এই দুঃসহ আকালে এ কোন রাজার বিলাসিতা!

বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা প্রচার করছেন, বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দিচ্ছে সরকার। সত্যি কি তাই? বিগত ৪৫ দিনে ২২ বার পেট্রলের দাম বেড়েছে। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা যাচ্ছে সরকারি কোষাগারে। দাম কমানোর দাবি উঠলে, নির্লজ্জতার মাথা খেয়ে সরকারের তোষামোদকারীরা বলছে, দাম কমালে চলবে কেন, সেই টাকাতেই তো ভ্যাকসিন। তা হলে বিনামূল্যে কোথায়? জনগণের টাকা নিয়েই তো ভ্যাকসিন! অথচ বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রচার চলছে। তা ছাড়া, করোনা মোকাবিলার গাজর ঝুলিয়েই তো পিএম কেয়ার্স ফান্ড খোলা হয়েছিল। সরকারি কর্মচারীদের এক দিনের মাইনে থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের হাজার হাজার কোটি টাকা এই ফান্ডে ঢালতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেই ফান্ড থেকে কেন টিকা দেওয়া হচ্ছে না? কেন তেলের ট্যাক্সের ওজর তুলতে হচ্ছে? আসলে দেশের মানুষের থেকে সত্য গোপন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত তাঁদের অজস্র মিথ্যার আশ্রয় নিতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক রীতি লঙ্ঘন করে বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দে্র ভ্যাকসিন বিক্রির নিদান দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সম্পূর্ণ দাম দিয়েই সেখানে কিনতে হচ্ছে ভ্যাকসিন। রাত জেগে লাইন দিয়ে ভ্যাকসিন নেওয়ার ধকল নিতে না পেরে অনেকেই বাধ্য হয়েছেন বেসরকারি কেন্দে্র ভ্যাকসিন নিতে। সরকারের ১০০ কোটির মধ্যে এরাও যুক্ত আছে, সে সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বিশ্বের আর কোনও দেশে ভ্যাকসিনের শংসাপত্রে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির ছবি নেই। আমাদের দেশে আছে। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের দরবারে ভারতকে ঠাট্টার বিষয় করে তুলেছেন। শংসাপত্রে ছবি, জন্মদিনে ১ কোটি ভ্যাকসিন, ১০০ কোটি ভ্যাকসিনের তথাকথিত সাফল্য যদি নরেন্দ্র মোদির হয়, তাহলে করোনার কারণে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর দায়ও নরেন্দ্র মোদিকেই নিতে হবে।

গণদাবী ৭৪ বর্ষ ১২ সংখ্যা ২৯ অক্টোবর – ৪ নভেম্বর ২০২১