মালিকদের কর ছাড় দিতে টাকার অভাব হয় না অভাব হয় কৃষকদের ঋণ মকুবে
মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়– তিনটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয়ের অন্যতম কারণ কৃষকদের তীব্র ক্ষোভ৷ যদিও এই ক্ষোভ নতুন কিছু নয়৷ দীর্ঘ কংগ্রেস শাসনে কৃষকরা বঞ্চিতই থেকে গেছে৷ সেই ক্ষোভ নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েই ক্ষমতায় বসেছিল বিজেপি৷ কিন্তু ২০২২ সালের মধ্যে চাষিদের আয় দ্বিগুণ করে দেওয়ার মতো কিছু অলীক প্রতিশ্রুতি ছাড়া কাজের কাজ কিছুই করেনি তারা৷ ফলে কৃষকদের ক্রোধ কমেনি, বরং বেড়েছে৷ সুযোগ বুঝে আসরে নেমে পড়ে কংগ্রেস৷ কল্পতরু সেজে প্রতিশ্রুতি বিলোতে থাকে– ‘আমাদের ভোট দিলে ফসলের ন্যূনতম দাম পাবে’, ‘সব ঋণ মকুব করা হবে’ ইত্যাদি৷ পুঁজিপতিদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যম বিজেপির একমাত্র বিকল্প হিসাবে তাদেরই আরেকটি বিশ্বস্ত দল কংগ্রেসকে তুলে ধরে৷ সেই প্রচারে প্রভাবিত কৃষক–জনতা আবার বাধ্য হয় কংগ্রেসকে ভোট দিতে৷ কৃষকরা যে তাঁদের অসহনীয় দুরবস্থা থেকে রেহাই চান, বিজেপির অপশাসনের পরিবর্তন চান এই ঘটনায় তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হল৷ কিন্তু রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে তাঁরা ধরতে পারলেন না যে এর দ্বারা তাঁরা উত্তপ্ত কড়াই থেকে লাফিয়ে জ্বলন্ত উনুনে পড়লেন৷ তাঁদের জীবনের সমস্যার সমাধান এই সরকার পরিবর্তনের দ্বারা হবে না৷
সামনেই লোকসভা নির্বাচন৷ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির দুর্গতির পর কৃষকদের মন পেতে শুরু হয়েছে ‘কৃষক দরদি’ সাজার কাড়াকাড়ি৷ গত চার বছরে প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতাদের এই কৃষকদের কথা মনে পড়েনি৷ তাদের দুরবস্থা, আত্মহত্যার মিছিল এই রাজনীতির ব্যবসায়ী নেতা–মন্ত্রীদের মনে এতটুকু দাগ কাটতে পারেনি৷ এখন লোকসভা ভোটে পরাজয়ের আশঙ্কায় তাঁদের মনে কৃষক দরদের বান ডেকেছে৷ এই তিনটি রাজ্যে নতুন কংগ্রেস সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রে বিজেপি সরকারও ভাব দেখাতে শুরু করেছে, তারাও ঋণ মকুবের পক্ষে৷
চাপে পড়ে এখন চাষির ঋণ মকুবের প্রশ্নটি আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠতেই কোনও কোনও মহল থেকে রে রে আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে৷ বলা হচ্ছে, সরকার কৃষিঋণ মকুব করলে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ বাড়বে৷ অনেক ‘বিশেষজ্ঞ’ আবার তথ্য দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন তা জিডিপির কত শতাংশ৷ অথচ সরকার যখন পুঁজিপতিদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা করছাড় দেয় তখন এরা টুঁ–শব্দও করে না৷ ব্যাঙ্ক কর্তারা ধুয়ো তুলতে শুরু করেছেন, এতে নাকি বোঝা বাড়বে ব্যাঙ্কগুলির৷ যেন সরকার ঋণ মকুব করলে, তা ব্যাঙ্কগুলি তাদের নিজেদের ভাণ্ডার থেকে মেটাবে৷ বাস্তবে সরকারই তা ব্যাঙ্কগুলিকে মিটিয়ে দেবে৷ পুঁজিপতিরা যখন হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ শোধ না করেও আবার ঋণ নেয়, তখন এই সব কর্তাদের এমন কাঁদুনি গাইতে দেখা যায় না৷ কোনও কোনও কর্তা আবার বলেছেন, এতে কৃষকদের ঋণ শোধের অভ্যেস নষ্ট হয়ে যাবে৷ এই মুহূর্তে সরকারি–বেসরকারি মিলিয়ে ব্যাঙ্কগুলিতে পুঁজিপতিদের শোধ না করা ঋণের ঘোষিত পরিমাণ প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা৷ এতে বোধহয় পুঁজিপতিদের অভ্যেস নষ্ট হয় না? ব্যাঙ্ককর্তারা কিন্তু একবারও সেই প্রশ্ন তোলেন না৷ কী বিরাট সব নীতি–বিশারদরা বসে রয়েছেন ব্যাঙ্কগুলির মাথায় জনগণের কষ্টার্জিত করের টাকায় এদেরই প্রতি মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা বেতন দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে৷ পুঁজিপতিদের সেবা করতে করতে এঁরা তাঁদের এমন ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছেন যে, চাষিরা গোটা জাতির খাদ্য জোগায় তারা দেনার দায়ে প্রতি বছর হাজারে হাজারে আত্মহত্যা করলেও তা তাঁদের চোখেই পড়ে না৷ যেন তারা পুঁজিপতিদের মতো ইচ্ছা করে ঋণ শোধ করে না, তারপর মনের আনন্দে আত্মহত্যা করে!
অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ বলে খ্যাত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন কর্তা রঘুরাম রাজন আবার গরিব কৃষকদের প্রতি দরদে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি লিখে ফেলেছেন যাতে ঋণ মকুবের বিষয়টি আলোচনার চৌহদ্দিতেই আসতে না দেওয়া হয়৷ তিনি বলেছেন, এই ধার অনেক সময়ই গরিব চাষির কাছে পৌঁছয় না৷ হতে পারে তাঁর কথা ঠিক৷ কিন্তু তা হলে দাবিটা তো হবে যে, গরিব চাষিরাও যাতে ব্যাঙ্কঋণ পায় তার ব্যবস্থা কর৷ চাষি যাতে ফসলের ন্যায্য দাম পায় তার ব্যবস্থা কর, সেচ ব্যবস্থার প্রসার ঘটাও, বিদ্যুৎ সার বীজ সস্তা কর, এসব নিয়ে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মুনাফা করা বন্ধ কর, যাতে তাকে ঋণ নিতে না হয়৷ কিন্তু তিনি কিংবা তাঁর সম্প্রদায় তেমন দাবি না করে ঋণ মকুবেরই পুরো বিরোধিতা করলেন৷ এই সব আমলারা তো শেষ পর্যন্ত পুঁজিপতিদের স্বার্থেরই রক্ষক৷ বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ এই আমলাতন্ত্র৷ স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা এত বড় একটি সমস্যাকে মালিকদের চোখেই দেখছেন এবং বিচার করছেন৷ এর সাথে রয়েছে বুর্জোয়া প্রচারমাধ্যমগুলির মিথ্যা প্রচার, যা এমনকী বহু সাধারণ মানুষকেও বিভ্রান্ত করে ফেলে যাতে তারা বিশ্বাস করে, কখনও এমন করে ঋণ মকুব করা উচিত নয়৷
বাস্তবে শাসক দলগুলি এই ঋণমকুবের স্লোগান তুলেছে সংকটগ্রস্ত চাষিদের জীবনে কোনও স্থায়ী সুরাহার জন্য নয়, শুধুমাত্র ভোটে কৃষকদের সমর্থন পাওয়ার জন্য৷ বিগত ৭০ বছর ধরে এ জিনিসই চলে আসছে৷ না হলে তারা কৃষকদের সমস্যাগুলি নিয়ে আগেই ব্যবস্থা নিত৷ কৃষকদের তাদের দাবিগুলি নিয়ে বারে বারে আন্দোলনে ফেটে পড়তে হত না৷ তারা কখনও লং মার্চ করেছে, কখনও দিল্লিতে ধরনা দিয়েছে৷ মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে এমনই এক বিক্ষোভে গত বছর বিজেপি সরকারের পুলিশ গুলি চালিয়ে পাঁচ জন কৃষককে হত্যা করেছিল৷ বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রের পেঁয়াজ চাষিদের আত্মহত্যা এখন প্রতিদিনের ঘটনা৷ কিন্তু কৃষিপ্রধান এই রাজ্যগুলিতেও ব্যাপক সংখ্যায় কৃষকরা আত্মহত্যা করছে৷ সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, মধ্যপ্রদেশে ২০০৪ থেকে ২০১৬–র মধ্যে ১৬,৯৩২ জন চাষি আত্মহত্যা করেছে৷ যার অর্থ দিনে গড়ে তিন জনেরও বেশি৷ ছত্তীসগড়েও এই ১২ বছরে ১২,৯৭৯ জন চাষি আত্মহত্যা করেছে৷ রাজস্থানে ওই সময়ে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি৷ স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে কৃষকদের ক্ষোভ তুঙ্গে উঠেছিল এবং তা এতখানি যে বিজেপি নেতাদের ‘মন্দির ওহি বনায়েঙ্গে’ স্লোগান তাতে এতটুকুও জল ঢালতে পারেনি৷ এরই ফলে কৃষি অধ্যুষিত বহু এলাকায় বিজেপি নেতারা প্রচারে যাওয়ারও সাহস দেখাননি৷ কোথাও কোথাও কৃষকরা তাড়া করে এলাকাছাড়া করেছে বিজেপি নেতাদের৷
স্বাধীনতার ৭০ বছরে কৃষকদের মূল সমস্যাগুলির দিকে নজর দেয়নি কোনও সরকার৷ সার, বীজ, কীটনাশক, সেচের জন্য প্রয়োজনীয় ডিজেলের দাম বেড়েছে লাফিয়ে৷ খরা–বন্যায় জর্জরিত হয়ে, ফসলের ন্যায্য দাম না পেয়ে, ঋণের বোঝা সইতে না পেরে আত্মহত্যার মিছিল তো সেই কংগ্রেস আমল থেকেই চলছে৷ গত কয়েক বছরে এই আত্মহত্যার পরিমাণ আরও বেড়েছে৷ যে নেতারা আজ ঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতির গাজর কৃষকদের সামনে ঝোলাচ্ছেন, বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করে চাষ করার পরও কেন পরের বার চাষের জন্য তাদের ঋণ নিতে হয়, এ প্রশ্নের জবাব সেই নেতারা দেন না৷ ভোটের মুখে আজ তাঁরা কৃষক দরদি সাজছেন, অথচ তাঁদের কৃষক বিরোধী নীতিই কৃষকদের এই দুরবস্থার জন্য দায়ী৷ তাদের উদারীকরণ তথা একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষাকারী নীতির কারণেই সারের দাম আজ আকাশছোঁয়া, বীজ কৃষকদের হাত থেকে চলে গেছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির হাতে৷ বিপুল পরিমাণ ট্যাক্স চাপিয়ে ডিজেলের দামে আগুন লাগিয়েছে তো এই দলগুলিই৷ কৃষি পণ্যের বাজার আজ একচেটিয়া পুঁজিপতিদের মুঠোয়৷ তাদের স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখেই কৃষিপণ্যের আমদানি–রফতানি নীতি ঠিক হয়৷ তারই পরিণতিতে শুধু নাসিকের পিঁয়াজ চাষিরা নয়, আলু, টমেটো, লঙ্কা, তুলো– সব ধরনের চাষিরাই আত্মহত্যা করছে ফড়ে, আড়তদার, কালোবাজারি এবং একচেটিয়া পুঁজিপতির দল কীভাবে চাষিকে শুষে নিয়ে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, বিজেপি–কংগ্রেস নির্বিশেষে সব দলের সরকারই তা ঠায় দাঁড়িয়ে দেখে, কোনও ব্যবস্থা নেয় না৷ কারণ এই সব ব্যবসায়ী–কালোবাজারি তাদের নির্বাচনের খরচ চালানোর, দল চালানোর, বিলাস–ব্যসনে নবাবী জীবন যাপনের খরচ জোগায়৷
আসলে শ্রমিক শ্রেণির মতো কৃষকদেরও তারা দুরবস্থার মধ্যেই ফেলে রাখতে চায়৷ একের পর এক নির্বাচনে তাদের দুরবস্থাই তো এই সব রাজনীতির ব্যবসায়ীদের, একচেটিয়া পুঁজিপতিদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার রাজনৈতিক দলগুলির পুঁজি৷ ভোটের আগে এই দুরবস্থা থেকে রেহাইয়ের লোভ দেখানো আর ক্ষমতায় বসে এদের আরও নিংড়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করা– এই তো তাদের রাজনীতি৷ পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থা যতদিন টিকে থাকবে, পাঁচ বছর অন্তর এই একই নাটকের পুনরাভিনয় চলতে থাকবে৷ পুঁজিপতিদের সেবাদাস এই দলগুলির পক্ষে আজ আর কৃষকদের দুরবস্থা দূর কর সম্ভব নয়৷ এদের কাছ থেকে সামান্য কিছু দাবিও আদায় করতে হলে দরকার সংগঠিত কৃষক আন্দোলন এবং তা হওয়া দরকার সঠিক নেতৃত্বে৷ না হলে সেই আন্দোলনের ফল আত্মসাৎ করবে বুর্জোয়াদেরই কোনও একটি দল এবং তাকে টেনে নিয়ে যাবে সেই নির্বাচনের অন্ধ গলিতে৷