বিজেপির ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক ও জাত-পাত ভিত্তিক রাজনীতি অপ্রত্যাশিতভাবে সুরাহা এনে দিল প্রাণপুরের বাসিন্দাদের জীবনে! প্রাণপুর ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ জেলার এক ছোট্ট গ্রাম। প্রাণপুর এবং সংলগ্ন কুড়িটি ভিন্ন মৌজার আড়াই লক্ষ বাংলাভাষী জনগণের সমস্যাটি প্রশাসনিকভাবে বেশ জটিল। তাঁরা ঝাড়খণ্ডের নথিভুক্ত ভোটার, ঝাড়খণ্ড সরকার তাঁদের আধার কার্ড, রেশন কার্ড দিয়েছে, কিন্তু তাঁদের জায়গাজমি খাতায়-কলমে পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার কালিয়াচক-২ এবং মানিকচক ব্লকের অন্তর্ভুক্ত। গঙ্গা নদীর গতিধারা পূর্ব দিকে সরে যাওয়ায় গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে নতুন গড়ে ওঠা চরেই তাঁদের বসবাস। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই চরে কোনও রকম কোনও জনবসতির অস্তিত্ব স্বীকার করতে নারাজ। কারণ তাদের মতে সেটি ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’, সেখান থেকে নিয়ম মতো কোনও ট্যাক্স আদায় করা যায় না। প্রায় ৩০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ২১টি মৌজার বাসিন্দারা এই প্রশাসনিক দোলাচলের কারণে চরম অসুবিধার সম্মুখীন। ঝাড়খণ্ড সরকারের কাছে তাঁদের পরিচিতি ‘অস্থায়ী নিবাসী’ (টেম্পোরারি রেসিডেন্ট)। তাঁরা বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সরকারি চাকরির আবেদন করতে পারেন না, এমনকি জাতিগত সংরক্ষণের সুবিধাও পান না তাঁরা। কারণ ঝাড়খণ্ড সরকারের নিয়মমতো এই সুবিধাগুলি পেতে হলে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া আবশ্যক। বিদ্যুৎ সংযোগের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পরিষেবা পেতেও তাঁদের ২০১৯ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখানকার মানুষদের নিয়ে গড়ে উঠেছে, গঙ্গা-ভাঙন প্রতিরোধ নাগরিক অ্যাকশন কমিটি। তাঁরা সেই ২০০০ সাল থেকেই লড়াই চালাচ্ছেন জমিজায়গার সঠিক রেকর্ড করানোর জন্য। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট এই কমিটিকে নির্দেশ দেয় গঙ্গার ভাঙনের সমস্যার উল্লেখ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে নতুন করে জমি সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য জানাতে হবে। আদালত একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে নির্দেশ দেয় এর ভিত্তিতে আইনসঙ্গত ভাবে ওই জমির বৈধ কাগজপত্র তৈরির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কিছুই হয়নি।
কিন্তু সম্প্রতি এই পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে যার সৌজন্যে কেন্দে্রর শাসক দল বিজেপির মুসলিম-বিদ্বেষী রাজনীতি। গতবছর লোকসভায় ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা অঞ্চলের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে দাবি করেছিলেন ঝাড়খণ্ডের কিছু কিছু জেলায় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের প্রবল উপস্থিতি জেলাগুলির জনবিন্যাসগত চরিত্র দ্রুত বদলে দিচ্ছে অর্থাৎ সেই জেলাগুলিতে হিন্দুদের ছাপিয়ে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। তিনি এই সমস্যার প্রতিকারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দ্রুত এনআরসি চালু করার দাবি জানান। ঝাড়খণ্ড বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির নির্বাচনী ইস্তাহারে বলা হয়েছিল সাঁওতাল পরগণার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের জমি জায়গা বাংলাদেশী আনুপ্রবেশকারীরা দখল করে নিচ্ছে স্থানীয় মহিলাদের বিবাহ সূত্রে। ইস্তাহার প্রকাশের সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এক নতুন আইন আনা হবে এই বিষয়ে। যার মাধ্যমে, যে সমস্ত জমি আদিবাসী মহিলাদের কাছ থেকে জোর করে দখল করা হয়েছিল সেগুলি তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং আর যাতে এ ভাবে জমি দখল না হয় সে ব্যাপারে নজর রাখা হবে।
গত ১৮ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে রাজমহলে এক মিছিলে বলেন, সাহেবগঞ্জ, রাজমহল এবং আরও বেশ কিছু জায়াগা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী এবং রোহিঙ্গাদের অনৈতিক কার্যকলাপের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এই সব বিজেপি নেতাদের অভিযোগের তীর স্পষ্টতই উপরে উল্লেখিত ২১টি মৌজার বাসিন্দা এই হতভাগ্য বাংলাভাষী মুসলিম জনসমাজের প্রতি। নেতাদের মুখে এই ধরনের অভিযোগ শুনে বিভিন্ন স্তরের অফিসাররা নড়েচড়ে বসেছেন। তাঁরা এই অঞ্চলের গ্রামগুলি সরেজমিন পরির্দশন করেন বাস্তব অবস্থা খতিয়ে দেখতে। পশ্চিম প্রাণপুরে একজন পঞ্চায়েত সদস্য আবদুল হান্নানের কথা থেকে জানা যায়, দু-তিন মাস আগে স্বয়ং মহকুমাশাসক তাঁর টিম নিয়ে এলাকার সকল বাসিন্দাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের নাগরিকত্ব পরীক্ষা করেন।
স্থানীয় এক বিদ্যালয়ের এক পার্শ্বশিক্ষক এরফান আলি বলেন, ‘জীবনে কখনও দেখিনি আমাদের গ্রামকে এত গুরুত্ব দিতে। আমাদের কাছে এই পরিদর্শনগুলি বরং শাপে বর হয়েছে। এর ফলে আমরা আমাদের এই অদ্ভূত ‘না ঘরকা না ঘাটকা’ পরিস্থিতি প্রশাসনের সামনে ভালভাবে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছি, যাই হোক এই সরেজমিন তদন্তের ফলাফল কী পাওয়া গেল? সত্যিই কি এখানকার জনগণ বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী? রিপোর্ট বলছে, সাহেবগঞ্জের দুটি কেস বাদে গোটা সাঁওতাল পরগণার ছ’টি জেলা– গোড্ডা, দেওঘর, দুমকা, জামতারা, সাহেবগঞ্জ এবং পাকুড় জুড়ে আর একজনও বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। ঝাড়খণ্ড সরকার ওই ছয় জেলার ডেপুটি কমিশনারের রিপোর্টের ভিত্তিতে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টকে এই তথ্য জানিয়েছে। দুই বাংলাদেশী নাগরিককে আবিষ্কারের ঘটনার মধ্যে একটি ঘটেছিল কয়েক বছর আগে, রাজমহল সাব ডিভিশনে। সেখানে স্থানীয় মুসলিম বাসিন্দারাই সেই বাংলাদেশী নাগরিককে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেন। ‘ঝাড়খণ্ড জনঅধিকার মহাসভা’ এবং ‘লোকতন্ত্র বাঁচাও অভিযান’-এর পক্ষ থেকে যৌথভাবে করা এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, সাহেবগঞ্জ এবং পাকুড় জেলায় বসবাসকারী এই বাংলাভাষী মুসলিমরা আদতে ভারতীয়, কোনও ভাবেই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী নয়। এদের একটা বড় অংশ হল শেরশাবাদিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁরা কয়েক শতাব্দী ধরে এইসব অঞ্চলে বাস করছেন। এ ছাড়া ওখানে রয়েছেন পসমন্দা এবং অন্যান্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন, যাঁরা কাছাকাছি অন্যান্য জেলা অথবা রাজ্য থেকে এখানে এসে বাস করছেন। ঐতিহাসিকভাবেও বর্তমান সাঁওতাল পরগণার একটি বড় অংশ মধ্যযুগে বাংলার শাসকদের অধীনে ছিল। যাই হোক বর্তমানে এই হইচইয়ের ফলে ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গ উভয় রাজ্য সরকারই এই মানুষগুলির দুর্দশার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা শুরু করেছে। বিধানসভা নির্বাচন মিটলে ঝাড়খণ্ড সরকার এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা চালাবে বলে মালদা জেলা প্রশাসন জানিয়েছে। অন্যদিকে গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ নাগরিক অ্যাকশন কমিটিকে যৌথভাবে জানিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটা সমীক্ষা শুরু করবে যার জন্য অর্থের বরাদ্দ ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখছেন এইসব অঞ্চলের হতভাগ্য মানুষগুলি। বিজেপির অন্ধ মুসলিম বিরোধিতাই তাঁদের এতদিনের সমস্যার সমাধান হওয়ার এক নতুন সম্ভাবনা হাজির করেছে। অনিষ্ট করতে গিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব অনিচ্ছাকৃতভাবেই তাঁদের মঙ্গলের রাস্তা খুলে দিলেন!