৭ জুন থেকে টানা ২৩ দিন পেট্রোল–ডিজেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার৷ পেট্রোলের দাম বাড়ল মোট ৯ টাকা ১৭ পয়সা এবং ডিজেলের দাম বাড়ল মোট ১০ টাকা ৯৩ পয়সা৷ অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম তলানিতে, মাত্র ৪০ ডলার প্রতি ব্যারেলে৷
করোনার প্রভাবে মানুষের জীবন–জীবিকা যখন বিপর্যস্ত, দেশের অর্থনীতি, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলি যখন ধুঁকছে, তখন এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব জনজীবনে কতখানি হবে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ পণ্যের উৎপাদন, পরিবহণ উভয়ের খরচবৃদ্ধিতে সমস্ত জিনিষের মূল্যবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী৷ অথচ দীর্ঘ লকডাউনের পর অর্থনীতির চাকা যেখানে স্তব্ধ, বেশিরভাগ মানুষেরই কোনও আয় নেই, কাজ হারিয়েছেন অনেকে, বলা বাহুল্য এমন পরিস্থিতিতে তেলের এই লাগাতার মূল্যবৃদ্ধি এক বড ধাক্কা নিয়ে আসবে৷
কিন্তু কেন এই মূল্যবৃদ্ধি? সরকার তো বহু আগেই তেলের দামে বিনিয়ন্ত্রণ ঘটিয়েছে৷ সরকার বলেছে বাজারই ঠিক করবে তেলের দাম৷ তা হলে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম নিম্নমুখী তখন ক্রেতারা সেই সুবিধা পাচ্ছে না কেন? আসলে ভারতে তেলের দামের বিনিয়ন্ত্রণ নীতিটি হল একটা একমুখী রাস্তা৷ বিশ্ববাজারে দাম বাডলে, দেশের বাজারেও দাম বাডে৷ কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশীয় বাজারে দাম কমে না৷
করোনা বিপর্যয়ে বিশ্ববাজারে তেলের চাহিদা যখন পড়ছে, যখন অশোধিত তেলের দাম একেবারে তলায়, তখন প্রায় তিন মাস ধরে তেল সংস্থাগুলি এ দেশে তেলের দাম না কমিয়ে একই জায়গায় ধরে রাখল এবং বিপুল মুনাফা লুটে নিল৷ আবার এরমধ্যেই ৫ মে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রেকর্ড পরিমানে ডিজেলে ১৩ টাকা এবং পেট্রোলে ১০ টাকা শুল্ক চাপালো৷ অথচ এর মাত্র দেড় মাস আগেই সরকার পেট্রোল–ডিজেলে লিটার প্রতি ৩ টাকা শুল্ক চাপিয়েছিল৷ এই দুই শুল্কের মাধ্যমে সরকারের অতিরিক্ত প্রায় দুই লক্ষ কোটি টাকা আদায় হচ্ছে৷ এমনিতেই জ্বালানি তেলের দামের সত্তর শতাংশ হল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির আরোপিত শুল্ক৷ ফলে তেল কোম্পানিগুলির সাম্প্রতিক লাগাতার মূল্যবৃদ্ধির থেকে ভালো পরিমাণ বখরা লোকচক্ষুর আড়ালে সরকারের কোষাগারে ঢুকছে৷ বাস্তবে বিজেপি সরকার যেমন তেল কর্পোরেটগুলিকে অবাধে লুটবার সুযোগ করে দিয়েছে, তেমনি সরকারি কোষাগারকে ভরিয়ে তোলার জন্য জ্বালানি তেলকে কামধেনু বানিয়ে যথেচ্ছ দোহন করে চলেছে৷ এই মুহূর্তে ভারতের থেকে পিছিয়ে থাকা প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে ভারতেই তেলের দাম বেশি৷ এক লিটার পেট্রোলের দাম পাকিস্তানে ৩৩.২৩ টাকা, আফগানিস্তানে ৩৩.৯৯, ভুটানে ৪৯.৮৫, নেপালে ৫৯.৬৭, শ্রীলঙ্কায় ৬৪.৯৬, বাংলাদেশে ৭৮.৫৫, ভারতে ৮৩.০৮ টাকা ভারতীয় মুদ্রায়৷ (তথ্যসূত্র : গ্লোবাল পেট্রোল প্রাইস ডট কম, ২৯ জুন, ২০২০)৷ বিপুল পরিমাণে এই রাজস্ব ভরানোর তাগিদেই বিজেপি সরকার জ্বালানি তেলকে জিএসটির আওতার বাইরে রেখেছে৷ কিন্তু জ্বালানি তেল তো অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি, তার জরুরি প্রয়োজনীয় উপাদান৷ জ্বালানি তেলের যথেচ্ছ মূল্যবৃদ্ধি ক্ষুদ্র ও মাঝারি বহু শিল্পের প্রাথমিক পুঁজির জোগানে সংকট সৃষ্টি করবে৷ পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে, পরিবহণের খরচ বৃদ্ধি করে সংকুচিত বাজারে তাদেরকে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখী করে তুলবে৷ এর ফলে হাজার হাজার শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে৷ বাড়বে বেকার বাহিনী৷ এটা জেনেও বিজেপি সরকার তেলের মূল্যবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে৷ মূল্যবৃদ্ধিতে সাফাই গেয়ে তেলমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান যুক্তি দিয়েছেন যে ‘জ্বালানিতে শুল্ক্ বাড়িয়ে যে আয় তা স্বাস্থ্য পরিষেবায়, লকডাউনের সময় গরিব মানুষকে অর্থ সাহায্য করতে খরচ হয়েছে’৷ মন্ত্রীর এই কথা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? গরিব কল্যাণের জন্য তো পি এম কেয়ার ফান্ড ছিল, সেটাই পুরোপুরি খরচ হয়েছে কি? তার হিসেব সরকার জনগণকে দিয়েছে কি? আসলে বিজেপির ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটদের অনৈতিক ভাবে টাকা পাইয়ে দিতে গিয়ে সরকার সর্বস্বান্ত৷ তার খেসারত দিতেই জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি৷