এ যেন অবিকল গুজরাট দাঙ্গার মডেল। ঠিক তেমনই আগে থেকে সংখ্যালঘু মানুষদের বাড়ি, দোকান চিহ্নিত করে রাখা, তারপর বেছে বেছে একই কায়দায় সেগুলিতে আগুন লাগানো, লুঠতরাজ চালানো। একই রকম ভাবে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে, কোথাও তাদের সহযোগিতায় তাণ্ডব চালানো। সেই একই রকম নীরবতা নরেন্দ্র মোদির। পার্থক্য শুধু, সেদিন তিনি ছিলেন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী, আর এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। অমিত শাহ, যিনি এই গোটা কুকীর্তির মূল কারিগর, তিনি সেদিন ছিলেন গুজরাটের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আজ কেন্দ্রীয় সরকারের। গোটা দেশজুড়ে, এমনকি দেশের বাইরেও যখন এই একতরফা হত্যাকাণ্ডের, বর্বরতা, নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রবল ধিক্কার উঠছে, তখনও প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনের কারও মুখে একটিও কথা নেই। যেন কিছু হয়নি, কিংবা সবই স্বাভাবিক।
ভাবা যায়, ভারতের মতো একটা দেশের রাজধানী শহরে, প্রকাশ্য দিনের আলোয় দিনের পর দিন দুষ্কৃতীরা শাসক দলের নেতাদের নেতৃত্বে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে! পুলিশ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয়, প্রশাসন নীরব। তিন দিন পর প্রধানমন্ত্রী টুইট করলেন, যেন সকলে শান্তি বজায় রাখে। কাদের উদ্দেশে তাঁর এ বার্তা? কাদের দায়িত্ব শান্তি বজায় রাখা? দেশের সাধারণ মানুষের? তারা তো সব সময় শান্তির পক্ষে। কোথাও কোনও দিন সাধারণ মানুষ অশান্তি তৈরি করে? দিল্লির অশান্তি তো বাধিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দলের নেতারাই। তাঁদের নেতৃত্বে বাছাই করা দুষ্কৃতীরা। তারাই তো ‘গোলি মারো শালোঁ কো’ বলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল দাঙ্গার আগের কয়েক দিন থেকে। এ সব জেনেই তো প্রধানমন্ত্রীর এমন শান্তির বুলি!
![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2020/03/protest-_delhi-riot-in-patna.jpg)
কয়েক দিন ধরে জ্বলল রাজধানী। মৃতের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৪৬-এ পৌঁছেছে। হয়ত আরও বাড়বে। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলে গেরুয়া পতাকা হাতে নিয়ে, বন্দুক উঁচিয়ে তাণ্ডব চালাল আরএসএস-সংঘ বাহিনী। বাড়িঘর, দোকান পাট, স্কুল পর্যন্ত তছনছ করে দিল। চলল অবাধ লুটতরাজ। লাগানো হল আগুন। কালো ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশে যতই উঠতে লাগল ততই দুষ্কৃতীরা উল্লাসে স্লোগান তুলল ‘‘এক হি নারা এক হি নাম “ জয় শ্রীরাম জয় শ্রীরাম”। সাংবাদিকদের মাথায় লাঠি মারা হল। দুর্বৃত্তরা সাংবাদিকদের হুমকি দিয়ে বলেছে, ‘তোরা কোন ধর্মের আগে পরিচয়পত্র দেখা’। হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে ‘ইয়ে হিন্দুয়োঁ কা লড়াই’। অতএব ছবি তোলা যাবে না।
![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2020/03/Anti-NRC-Michhil-at-Coochbihar.jpg)
দেশে কোনও সরকার আছে কি না, তার কোনও স্বরাষ্ট্র দপ্তর আছে কি না, তার কোনও মন্ত্রী আছে কি না, তাণ্ডবের কয়েক দিন দেশের মানুষ বুঝতেই পারল না। পুলিশের সামনেই দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব চালাল। পুলিশ কাউকে বাধা দিল না। বাস্তবে দুষ্কৃতীরা পুলিশকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করল। সরকারের সমর্থন না থাকলে পুলিশ এভাবে দুষ্কৃতীদের সহায়ক হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে? সব কিছু থেমে যাওয়ার পর এনআইএ প্রধান রাস্তায় বের হলেন। নিপীড়িত এলাকাগুলিতে ঘুরতে ঘুরতে নির্বিকার চিত্তে তিনি বলে গেলেন, ‘যা হওয়ার হয়েছে, এখন থেকে আপনাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমাদের’। একটা সরকারের, তার প্রশাসনের ভণ্ডামি কোথায় পৌঁছালে এমন কথা এত ঠাণ্ডা গলায় উচ্চারণ করা যায়! যে স্বরাষ্ট্র দপ্তর হয় কথায় নয় কথায় অধ্যাপক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, সাধারণ মানুষ– যে কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দিয়ে জেলে ভরে দেয়, সেই স্বরাষ্ট্রদপ্তর দিনের পর দিন বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, সাংসদ প্রবেশ ভার্মার মতো নেতারা চরম উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়া সত্ত্বেও গ্রেপ্তার করা দূরের কথা, তাঁদের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের করল না। এমনকি বিচারপতি এস মুরলিধর যখন সরকারের এই অসভ্যতা, এই নষ্টামি আর সহ্য করতে না পেরে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে উস্কানিদাতাদের নামে অভিযোগ দায়ের করতে, অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে সরকার রাতারাতি তাঁকে বদলি করে দিল। দাঙ্গার পিছনে সরকারের হাত না থাকলে এসব ঘটতে পারে!
![](https://ganadabi.com/wp-content/uploads/2020/03/Biksov-Ag-Delhi-Incident-at-Midnapur.jpg)
হত্যাকাণ্ড চলাকালীন স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অধীন পুলিশের কাছে ১৩ হাজার ২০০ ফোন গিয়েছিল আক্রমণ, গুলি, অগ্নিসংযোগের খবর দিয়ে। পুলিশ কোথাও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। দিল্লি পুলিশ এতখানি অপদার্থ, পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তর এতখানি নিষ্কর্মা, এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে? বিজেপি নেতা-কর্মীরাও কি তা মনে করেন? প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসব থামাতে কি তাদের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন? না, দেননি। বরং উল্টোটাই সত্য। সরকারের, স্বরাষ্ট্রদপ্তরের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ ছাড়া পুলিশ এ ভাবে নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। এর পরেও কি বিজেপি সরকারকে একটা গণতান্ত্রিক, সভ্য সরকার বলা যায়? শুধুমাত্র সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে বলেই একটা শাসক দল শুধুমাত্র ধর্মের কারণে একাংশ মানুষের উপর এমন গণহত্যা চালাতে পারে? গণতন্ত্রের এত বড় অপব্যবহার দেশের মানুষ মেনে নেবে!
অমিত শাহ কলকাতায় এসে বক্তৃতা দিয়ে বাংলায় সরকার গড়বেন বলে দাব করে গেলেন। অথচ একবারও দিল্লি গণহত্যার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন না। এই হত্যাকাণ্ডের পুরো দায় যে তাঁর তা একবারও স্বীকার করলেন না। তিনি সভা শেষ করে সোজা কালিমন্দিরে চলে গেলেন কি রক্তাক্ত হাতে পুজো সার্থক হবে মনে করে!
এই একতরফা হত্যাকাণ্ড আটকাতে তথাকথিত বিরোধী দলগুলি কী ভূমিকা পালন করল? সদ্য দিল্লির নির্বাচনে মানুষ বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ায় চ্যাম্পিয়ান সেজেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তাঁরই রাজ্যে আক্রান্ত মানুষগুলিকে রক্ষা করতে কী ভূমিকা পালন করলেন তিনি? সে ভূমিকা কি চরম কলঙ্কজনক নয়? জনগণের সমর্থনে সদ্যই নির্বাচিত হয়েছেন তিনি এবং তাঁর দলের আরও ৬২ জন বিধায়ক। মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল কিংবা তাঁর দলের এইসব বিধায়কেরা কেউই পথে নামেননি, দাঁড়াননি অসহায় মানুষগুলিকে বাঁচাতে। দাঁড়াননি আক্রান্তদের পাশে। পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রী রাজঘাটে গিয়ে ধরনার মস্করা করেছেন। যখন সাধারণ মানুষ প্রাণের তোয়াক্কা না করে ভিন্ন ধর্মের মানুষকে বাঁচাচ্ছেন দাঙ্গাবাজদের আক্রমণ থেকে তখন মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সঙ্গে পুলিশ না থাকার অজুহাত তুলেছেন। এই না নামাটাই কি কেজরিওয়াল সাহেবের নরম হিন্দুত্বের লাইন? তিনি নাকি দিল্লিবাসীর উন্নয়নের কাণ্ডারি? এ বার তিনি নিশ্চয় সেই উন্নয়নের ডালি নিয়ে হাজির হবেন সন্তানহারা, স্বামীহারা, সব হারা মানুষগুলির পাশে? বার্তা দেবেন তাঁদের সঙ্গে থাকার? ধিক এই ভ্রষ্টাচারী রাজনীতিকে!
একই রকমভাবে তৃণমূল নেত্রী, যিনি নিজেকে সংখ্যালঘুদের ত্রাতা বলে প্রচার করতে ভালবাসেন, লোকসভার ভোট এলেই বিরোধী ঐক্যের ডাক দেন, তিনি কিন্তু দুর্গত মানুষগুলিকে বাঁচাতে তো কোনও ঐক্যের ডাক দিলেন না। পরিবর্তে পুরীর মন্দিরে ‘শান্তি’ কামনা করেই তাঁর দায়িত্ব সারলেন। এই সব নেতা-নেত্রীদের এই সব আচরণের পিছনে কি একমাত্র ভোটের হিসেবই কাজ করছে না?
কংগ্রেস নেত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিলেন যাতে তিনি সরকারকে রাজধর্ম পালনের নির্দেশ দেন। তিনি কি বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তেমন নির্দেশ দেবেন? তা হলে কেন গিয়েছিলেন তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে? দেশবাসীর সাথে এই প্রতারণার কী প্রয়োজন ছিল! আসলে তিনি গিয়েছিলেন ভোটের হিসেব কষেই।
বাস্তবে ভোটবাজ এই দলগুলির কাছে দেশের মানুষের আশা করার কিছু নেই। মানুষ এদের কাছে এক-একটি ভোটের সংখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষ হিসাবে কোনও মূল্য নেই। বিজেপি যেমন হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করতে, শোষিত মানুষের ঐক্যকে ভেঙে দিতে দাঙ্গা বাধায়, দাঙ্গা বাধাল, বিরোধী দলগুলির হিসেবও উল্টোদিক থেকে একই রকম। আদর্শগত ভাবে, নীতিগত ভাবে আজ পুরোপুরি দেউলিয়া এই দলগুলি। মানুষকে দেওয়ার এদের আর কিছু নেই– একমাত্র প্রতারণা ছাড়া। তাই মানুষকেই আজ এই দাঙ্গার রাজনীতির, ভোট সর্বস্ব রাজনীতির, ভণ্ডামির রাজনীতির পাল্টা জনগণের স্বার্থরক্ষার রাজনীতি গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে। দাঙ্গার সময়ে মানুষের এই ভূমিকারই অজস্র উজ্জ্বল উদাহরণ ছড়িয়ে রয়েছে দিল্লি জুড়ে। বিজেপি অনেক চেষ্টা করেও একে হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গায় পরিণত করতে পারেনি। মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করে হিন্দু এবং মুসলমান সাধারণ মানুষ পরস্পরের প্রাণ বাঁচিয়েছেন, সম্পত্তি রক্ষা করেছেন। সাধারণ মানুষের এই অটুট বিবেকই আজও বিজেপি-আরএসএস বাহিনীর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সামনে প্রধান বাধা। সরকারি নীতির ব্যর্থতার বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভকে বিপথে চালিত করতে বিভেদের রাজনীতিই বিজেপির হাতে একমাত্র অস্ত্র। তাই ভবিষ্যতে এমন হত্যাকাণ্ড আরও অনেক বার ঘটানোর চেষ্টা করবে বিজেপি-আরএসএস বাহিনী। সাধারণ মানুষকে নিজেদের স্বার্থেই সেই ষড়যন্তে্রর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় উভয় ধর্মের মানুষকে নিয়ে গড়ে তুলতে হবে সম্প্রীতি রক্ষা কমিটি। সমাজ মননের গভীরে বাসা বেঁধে থাকা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ নির্মূল করার জন্য গড়ে তুলতে হবে আদর্শগত সংগ্রাম।