মানব সমাজ যে জ্ঞান সম্পদ আহরণ করেছে, তা আয়ত্ত না করেই সাম্যবাদী হওয়া যায়– এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে চলার অর্থ মহা ভুলের খপ্পরে পড়া। যে সম্মিলিত জ্ঞানের ফসল সাম্যবাদ, তাকে আয়ত্ত না করে কেবলমাত্র সাম্যবাদী স্লোগান ও সাম্যবাদী বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তসমূহ শেখাই যথেষ্ট– এই রকম ভাবলে ভুল হবে। মানব জাতির জ্ঞানভাণ্ডারকে একত্রিত করার মধ্য দিয়ে কী ভাবে সাম্যবাদের উদ্ভব ঘটেছে, মার্ক্সবাদই তা দেখিয়েছে।
আপনারা শুনেছেন এবং পড়েছেন যে, সাম্যবাদী তত্ত্ব, সাম্যবাদের বিজ্ঞান মূলত মার্ক্সেরই সৃষ্টি। তিনি প্রতিভাশালী ঠিকই, কিন্তু মার্ক্সবাদের এই তত্ত্ব আজ আর কেবলমাত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন সমাজতন্ত্রীর নয়, এটা আজ বিশ্বব্যাপী সেই লক্ষ কোটি সর্বহারার তত্ত্বে পরিণত হয়েছে, যারা পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তা প্রয়োগ করছে। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, কেন মার্ক্সের শিক্ষা সবচেয়ে বেশি বিপ্লবী শ্রেণির লক্ষ কোটি হৃদয় জয় করতে সমর্থ হল, তার একটিই উত্তর– পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষ যে জ্ঞান অর্জন করেছে, তারই দৃঢ় ভিত্তির উপর মার্ক্স তাঁর তত্ত্বকে দাঁড় করিয়েছিলেন। মানব সমাজের বিকাশের নিয়ম পর্যবেক্ষণ করে মার্ক্স উপলব্ধি করেন, পুঁজিবাদী সমাজ অবশ্যম্ভাবীরূপে সাম্যবাদে পরিণতি লাভ করবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, মার্ক্সর্ পুঁজিবাদী সমাজের নির্ভুল, পুঙ্খানুপুঙ্খ এবং গভীর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ও বিজ্ঞানের এ-তাবৎকালের সমস্ত সৃষ্টিকে একত্রিত করেই এই কথাটি প্রমাণকরেছিলেন। কোনও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়কেও অবজ্ঞা না করে মানব সমাজের সকল সৃষ্টিকে সমালোচকের দৃষ্টিতে তিনি পুনর্গঠিত করেছিলেন। মানুষের চিন্তাপ্রসূত সব সৃষ্টিকে তিনি পুনর্বিবেচনা করেছেন, বিচারের বিষয় করে তুলেছেন এবং শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনের কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, বুর্জোয়া সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ এবং সংস্কারে আচ্ছন্ন কেউ তা পারেননি।
যেমন ধরুন, সর্বহারা সংস্কৃতির কথা বলতে গেলে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে– আমরা এই বিষয়টি ধরতে পারব না, যদি না, পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করতে পারি যে কেবলমাত্র সঠিক জ্ঞান আর মানবজাতির সামগ্রিক বিকাশের ধারায় প্রাপ্ত সংস্কৃতির রূপান্তর সাধনের মধ্য দিয়েই সর্বহারা সংস্কৃতি সৃষ্টি করা যাবে। সর্বহারা সংস্কৃতি আকাশ থেকে পড়েনি। যারা নিজেদের সর্বহারা সংস্কৃতির বিশেষজ্ঞ ভাবে, এটা তাদেরও আবিষ্কার নয়। এ সবই মূর্খতা। পুঁজিবাদী, সামন্তী ও আমলাতান্ত্রিক সমাজের গোলামির ভিতরে থেকেও মানবজাতি যে জ্ঞান সঞ্চিত করেছে, সর্বহারা সংস্কৃতি নিশ্চিতরূপে তারই বিকাশের যুক্তিসঙ্গত পরিণতি। এই সকল পথই আমাদের সর্বহারা সংস্কৃতির দিকে নিয়ে চলেছে এবং নিয়ে যেতে থাকবে। যেমন রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র মার্ক্সের হাতে নতুন রূপ গ্রহণ করে দেখিয়েছে মানবসমাজকে কোথায় পৌঁছাতে হবে। দেখিয়েছে, শ্রেণি সংগ্রামের পথ ধরে সর্বহারা বিপ্লবের সূচনাকে।
আমাদের মুখস্থ করার কোনও প্রয়োজন নেই, কিন্তু আমরা প্রতিটি ছাত্রের মনকে খাঁটি সত্য ধারণার সাহায্যে উন্নত ও ত্রুটিহীন করতে চাই। প্রাপ্ত শিক্ষাকে মনের মধ্যে পরিপাক করতে না পারলে সাম্যবাদ একটি ফাঁকা বুলিতে পরিণত হবে, একটি সাইনবোর্ড মাত্র হয়ে দাঁড়াবে এবং একজন কমিউনিস্ট এক দাম্ভিক ব্যক্তিতে পরিণত হবে। এই জ্ঞানকে শুধুমাত্র আয়ত্ত করলেই হবে না, একে যাচাই করে গ্রহণ করতে হবে। যাতে একদিকে আপনার মন অপ্রয়োজনীয় বিষয়বস্তুতে ভারাক্রান্ত না হয়, অন্য দিকে আজকের দিনে সুশিক্ষিত মানুষের পক্ষে যে সব সত্য জানা অপরিহার্য, তার দ্বারা আপনাদের মন যেন সমৃদ্ধ হয়। কোনও সাম্যবাদী যদি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে এবং কঠোর শ্রমের সাহায্যে সত্যকে যাচাই না করে, না বুঝেই সাম্যবাদ সম্পর্কে কেবলমাত্র কিছু বিচ্ছিন্ন শুকনো বুলি শিখেই সাম্যবাদের জ্ঞান জাহির করতে থাকে, তা হলে সব দিক থেকেই সে একজন অধঃপতিত কমিউনিস্ট। এ ধরনের ওপর ওপর জানা খুবই মারাত্মক। যদি জানি যে আমার জ্ঞান অল্প, তা হলে আরও বেশি জানার চেষ্টা করব। কিন্তু যদি কেউ বলে যে, সে একজন কমিউনিস্ট অতএব তার আর কিছুই গভীর ভাবে জানার দরকার নেই, তা হলে সে আর যাই হোক, কমিউনিস্ট হতে পারবে না।
‘দি টাস্ক অফ দি ইউথ লিগ’ থেকে
এই লেখাটি গণদাবী ৭৭ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা ৬ – ১২ জুন ২০২৫ এ প্রকাশিত